কন্য়াকুমারীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: ফেসবুক।
সপ্তম তথা শেষ দফার ভোটের প্রচার শেষ করেই সোজা তামিলনাড়ুর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলা, ‘ধ্যানমণ্ডপম’-এ যোগমগ্ন হন। ধ্যান করেন টানা ৪৫ ঘণ্টা ধরে। তবে তাঁর সেই ধ্যানও তামিলভূমে রক্ষা করতে পারল না বিজেপিকে। তামিলনাড়ু রইল পদ্ম-শূন্যই। এনডিএ জোট মাত্র একটি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ, ভোটের ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, ভোটপ্রচারের সময় তামিল আবেগ উস্কে দিয়েও লাভ হয়নি মোদী-অমিত শাহদের।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, তামিলনাড়ুতে এ বারও একপেশে লড়াই হল। রাজ্যের শাসকদল ডিএমকে দাপট দেখাল ফলাফলে। তাদের ঝুলিতে গেল ২২টি আসন। কংগ্রেস পেল ন’টি আসন। ২০১৯ সালের মতো দু’টি করে আসন পেল সিপিএম এবং সিপিআই। ‘ইন্ডিয়া’র অন্য দুই শরিক দল একটি করে আসন পেল এ বারের ভোটে। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এডিএমকে শূন্যে নেমে গেল।
হিন্দিবলয়ে দাপট থাকলেও বিগত লোকসভা নির্বাচনগুলিতে দক্ষিণ ভারতে তেমন ‘প্রভাব’ ফেলতে পারেনি বিজেপি। তাই এ বারের নির্বাচনে দক্ষিণ ভারতে আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে কোনও খামতি রাখতে চায়নি পদ্মশিবির। বিশেষত, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য নিয়ে আলাদা হিসাবনিকাশ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তামিলভূমে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি বিজেপি। কিন্তু এ বার সেই অঙ্ক পাল্টাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মোদী-শাহ। কিন্তু এই জুটির জাদু কাজ করল না।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভোটঘোষণার পর থেকেই বার বার তামিলনাড়ু গিয়েছেন মোদী। রোড-শো থেকে জনসভা, বাদ পড়েনি কিছুই। তামিলনাড়ুর বিজেপি নেতৃত্বও আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন ভোটপ্রচারে। মোদী প্রতিটি সভা থেকেই চেষ্টা করে গিয়েছেন তামিল আবেগ উস্কে দিতে। তা করতে গিয়ে তিনি টেনে এনেছেন কচ্চতীবু দ্বীপকে। ভোটের মুখে মুখেই এই দ্বীপ সংক্রান্ত একটি তথ্য প্রকাশ্যে এসেছিল। তথ্য জানার অধিকার আইনের (আরটিআই) বলে প্রাপ্ত সেই রিপোর্ট সামনে রেখেই
কংগ্রেস এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিশানা করেছিলেন মোদী। জনসভার ভাষণে তো বটেই, সমাজমাধ্যমেও কচ্চতীবু দ্বীপ নিয়ে লেখালিখি করতে দেখা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে।
কচ্চতীবু দ্বীপের অধিকার নিয়ে তামিলনাড়ুতে আন্দোলন চলছে বহু দিন ধরে। তামিলনাড়ুর অনেকের দাবি ছিল, ১৯৭৪ সালের চুক্তি প্রত্যাহার করে কচ্চতীবু দ্বীপ আবার ভারতকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু দু’দেশের কোনও সরকারই সে দাবি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। এ বারের ভোটপ্রচারে সেই আবেগকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মোদী বলেছেন, ‘‘ভগবান রামের নাম রয়েছে, এমন গ্রামের সংখ্যা তো সবচেয়ে বেশি তামিলনাড়ুতেই।’’ যে সূত্রে রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করেছিলেন, তামিলভূমের আঞ্চলিক আবেগ উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি ‘হিন্দুত্ববাদী’ তাসও খেলেছেন মোদী।
নির্বাচনের আগে তামিলনাড়ুর এনডিএ জোটের মধ্যে ভাঙাগড়ার খেলা লেগেই ছিল। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এডিএমকে গত বছরই জোট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা এডিএমকে প্রধান পলানীস্বামী ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে নয়, লোকসভা নির্বাচনে আলাদা জোট গড়ে লড়বে তাঁর দল। সেই ধাক্কা সামলাতে বিজেপি পাশে পেয়েছিল প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অম্বুমণি রামডসের দল পট্টালি মাক্কাল কাচ্চিকে (পিএমকে)। ১৯৯৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনের ফল বলছে, তামিলনাড়ুর মোট ভোটের ৫-৭ শতাংশ ঢোকে পিএমকের ঝুলিতে।
২০১৪ সালে পিএমকে-কে সঙ্গে নিয়েই ভোটযুদ্ধে নেমেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। তাতে সাফল্যও এসেছিল। দ্রাবিড় রাজনীতির দুই প্রধান দল ডিএমকে এবং এডিএমকের প্রার্থীদের হারিয়ে ধর্মপুরী লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন অম্বুমণি। ২০১৯ সালে এনডিএ জোটের সঙ্গে মিলে লড়াই করেছিল অম্বুমণির দল। কিন্তু জেতা আসন ধরে রাখতে পারেনি তারা।
২০১৯ সালের নির্বাচনে ৩৯ আসনের তামিলনাড়ুতে মাত্র একটি আসন পেয়েছিল এনডিএ। তা-ও গিয়েছিল পলানীস্বামীর দলের ঝুলিতে। তবে ২০১৪ সালে এমন অবস্থা ছিল না এডিএমকে দলের। সে বার কোনও জোটে না গিয়ে একাই লড়েছিল জয়ললিতার দল। তামিলনাড়ুর ৩৯টির মধ্যে ৩৭টি আসন জিতেছিল তারা। কিন্তু জয়ললিতার মৃত্যুর পর ধস নামে দলে। তাঁর উত্তরাধিকারী হওয়ার লড়াই নিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধে। প্রথমে জয়ললিতার অনুগামী পনিরসেলভম মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু ভাঙন রুখতে পারেননি। একটা সময়ে তিনিই দল ছেড়ে বেরিয়ে যান। জয়ললিতার বান্ধবী শশীকলা দলের হাল ধরবেন বলে মনে করা হয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে জেল খাটার পরে তিনি এখন স্বেচ্ছাবসরে। তার পরে পলানীস্বামী দলের ভাঙন রুখে রাশ ধরেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই এখন এডিএমকে-র অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ২০১৯ সালে তারা এনডিএ জোটে শামিল হয়েছিল। তবে এ বার সেই জোটে নেই তারা।
তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকে ২০১৪ সালে এনডিএ জোটে ছিল। কিন্তু একটিও আসন তারা জিততে পারেনি। সে বার বিজেপি পেয়েছিল একটি আসন। শূন্য ছিল কংগ্রেসও। তবে ২০১৯ সালে জোটের হিসাব পাল্টে যায়। ভোটে ডিএমকে নেতৃত্বাধীন ন’টি দলের জোটের অন্যতম শরিক ছিল কংগ্রেস। ৩৯টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৮টিতেই জিতেছিল ওই জোট।
২০১৯ সালে যখন বামেরা দক্ষিণ ভারতে শুধু কেরল ছাড়া অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নেমেছিল, তখনও তামিলনাড়ু থেকে দু’টি করে আসন পেয়েছিল সিপিএম এবং সিপিআই। ডিএমকে নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল তারা। এ বারও তাদের দু’টি করে আসন ছেড়েছিল ডিএমকে। বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র শরিকও তারা। ডিএমকে ২১টি আসনে লড়াই করে। ন’টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেস। ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ এবং কেডিএমকে— এই দু’টি আঞ্চলিক দল লড়াই করেছিল একটি করে আসনে। এ ছাড়াও শরিক দল ভিচিকে দু’টি আসনে লড়াই করেছিল। তবে জোটে থাকলেও লোকসভা ভোটে লড়েনি অভিনেতা-রাজনীতিক কমল হাসনের দল ‘মাক্কাল নেধি মইয়ম’ (এমএনএম)। অন্য দিকে, এনডিএ জোটের প্রধান দল হিসাবে বিজেপি একাই ১৯ আসনে লড়াই করেছিল। অম্বুমণির দল লড়েছিল ১০ আসনে। বাকি ১০ আসনে জোটের অন্য দলগুলি প্রার্থী দিয়েছিল।