পিনারাই বিজয়ন (বাঁ দিকে) এবং রাহুল গান্ধী (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
কেরল রইল কেরলেই! ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছু ঘটল না ‘ঈশ্বরের আপন দেশে’। ২০২৪ লোকসভা ভোটে আসনের নিরিখে এগিয়ে থাকল কংগ্রেস। ১৪টি আসনে জয়ী হল তারা। সিপিএম পেল একটি আসন। তাদের জোটসঙ্গী আরএসপিও পেয়েছে একটি আসন। এই প্রথম বার দক্ষিণের এই রাজ্যে খাতা খুলল বিজেপি। তারা পেল একটি আসন। ওয়েনাড়ে আবারও জয় পেলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। জিতেছেন কংগ্রেসের শশী তারুর।
কেরলের ত্রিশূর আসনে জয়ী হয়েছে বিজেপি। সেখানে অভিনেতা-রাজনীতিক সুরেশ গোপী জয়ী হয়েছেন। হারিয়েছেন সিপিআইয়ের সুরেশ কুমারকে। রাজ্যে প্রায় ১৬.৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। সিপিএম পেয়েছে ২৫.৮২ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছে ৩৫.০৬ শতাংশ ভোট।
কেরলে মোট লোকসভা আসনের সংখ্যা ২০। সেই তুলনায় ‘ঈশ্বরের আপন দেশে’ ওজনদার প্রার্থীর ভার নেহাত কম ছিল না। কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি, তিন বারের সাংসদ থেকে বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি, সিপিআই নেতা থেকে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পুত্র— সকলেই নেমেছিলেন ময়দানে। সারা দেশে ‘ইন্ডিয়া’-র অধীনে হাত ধরে লড়াই করলেও একমাত্র কেরলেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মুখোমুখি লড়াই কংগ্রেস এবং বামেদের।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে সবচেয়ে কঠিন লড়াই ছিল বিজেপির। তাদের লড়াই ছিল দেশের ‘সবচেয়ে শিক্ষিত’ রাজ্যের লোকসভা আসনে খাতা খোলার। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা, বালাকোটকাণ্ডের পর সারা দেশে যখন ‘মোদী ঝড়’ বইছে, তখনও কেরলে ১৫টি আসনে লড়াই করে শূন্য পেয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস জিতেছিল ১৫টিতে। তাদের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) জিতেছিল মোট ১৯টি আসনে। সিপিআই জিতেছিল একটিতে।
২০১৪ সালের ‘মোদী হাওয়া’ও পৌঁছতে পারেনি দক্ষিণের এই রাজ্যে। বিজেপি ছিল শূন্য। কংগ্রেস জিতেছিল আটটি আসনে। ছ’টি আসনে জিতেছিলেন বাম প্রার্থী। দু’টিতে জিতেছিলেন সিপিএম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। কেরলে খ্রিস্টান ভোটব্যাঙ্কই বরাবর এগিয়ে দিয়েছে কংগ্রেসকে। লোকসভা ভোটে তাদের সেই ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। ‘হাতিয়ার’ করেছিল মেরুকরণকে।
ঘটনাচক্রে, ২০১৯ সালে রাহুল গান্ধীর কাছে প্রায় ‘মসিহা’ হয়ে এসেছিল কেরলের তুলনামূলক কম পরিচিত পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র ওয়েনাড়। অমেঠিতে রাহুল হেরেছিলেন। ওয়েনাড় তাঁর মান বাঁচিয়েছিল। ২০২৪ সালে সেই ওয়েনাড়েই আবার প্রার্থী হয়েছিলেন রাহুল। তবে এ বার তাঁর লড়াই ছিল কঠিন। রাজ্যের শাসক জোট লেফ্ট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) প্রার্থী করেছিল সিপিআইয়ের অ্যানি রাজাকে। তিনি সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজার স্ত্রী। রাহুলকে ‘সংসদ-ছাড়া’ করতে বদ্ধপরিকর ছিল বিজেপিও। তাদের রাজ্য সভাপতি কে সুরেন্দ্রন নিজেই নেমেছিলেন ময়দানে। ওয়েনাড়ে তিনিই ছিলেন বিজেপির প্রার্থী। শেষ হাসি যদিও হেসেছেন রাহুলই। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপির শীর্ষনেতারা ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’-এর ডাক দিয়েছিলেন বহু দিন আগেই। সেই লক্ষ্যে কেরলে কংগ্রেসকে ধাক্কা দিতে চেয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেসের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলে পরিচিত আসনগুলিতে চক্রব্যূহ রচনা করতে চেয়েছিল তারা। তিরুঅনন্তপুরমে তিন বারের সাংসদ তারুরেরও লড়াই ছিল কঠিন। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজেপির টিকিটে মাঠে নেমেছিলেন বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর। তিরুঅনন্তপুরম আসনে ২০১৯ এবং ২০১৪ লোকসভা ভোটে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। সেই সুযোগটাই এ বারের ভোটে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বিজেপি। সিপিএম এই আসনে প্রার্থী করেছিল তিরুঅনন্তপুরমেরই প্রাক্তন সাংসদ পান্নিয়ান রবীন্দ্রনকে। যদিও জয়ী হয়েছেন তারুই। এই নিয়ে চতুর্থবার। জিতে তিনি জানান, এই ভোট বিজেপিকে শিক্ষা দেবে।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী কেরলে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ মুসলিম। সেই হিসাবকেই কাজে লাগিয়ে ভোট জিততে মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল বিজেপি। ‘হাতিয়ার’ করেছিল সুদীপ্ত সেন পরিচালিত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিকে। সেখানে দেখা গিয়েছিল, কী ভাবে চার কলেজছাত্রীর ‘মগজধোলাই’ করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসআইএসে নিয়োগ করা হয়। ছবিতে দাবি করা হয়েছিল, কেরলে ৩২ হাজার হিন্দু এবং খ্রিস্টান মহিলাকে ধর্মান্তরিত করে আইএসআইএসে যোগদান করানো হয়েছে। তাঁদের পাঠানো হয়েছে সিরিয়া এবং ইরাকে। সেই নিয়েই সরব হয় বিজেপি। কেরল থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগদান নিয়ে যদিও অনেক বছর ধরেই সরব ছিল তারা। ‘লভ জিহাদ’ নিয়েও ময়দানে নেমেছিল। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই অবশ্য তৎপর হন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। ছবিটি দূরদর্শনে দেখানো নিয়ে আপত্তি জানান। নিজের রাজ্যেও বিধিনিষেধ জারি করেন।
এই মেরুকরণের মাধ্যমেই কেরলে খ্রিস্টান ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কেরলের মোট ভোটারদের মধ্যে ১৮ শতাংশ খ্রিস্টান। কেরলে খ্রিস্টানেরা বরাবর ভোট দেন কংগ্রেসকে। কারণ, তাঁরা ‘ঈশ্বরে অবিশ্বাসী’ বামেদের তেমন পছন্দ করেন না। সে কারণেই ২০১৪ সালে সারা দেশে কংগ্রেস যখন মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল, তখনও কেরলে তারা একাই পেয়েছিল আটটি আসন। কংগ্রেসের সেই খ্রিস্টান ভোটব্যাঙ্কেই ভাগ বসাতে চেয়েছিল বিজেপি। খ্রিস্টান অধ্যুষিত পথনমথিট্টায় তারা প্রার্থী করে কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একে অ্যান্টনির ছেলে অনিল অ্যান্টনিকে। ভোটের আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন অনিল। তাঁর হয়ে সভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। ওই আসনে অনিলের বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন বিদায়ী সাংসদ ইউডিএফের অ্যান্টো অ্যান্টনি। তিনি এর আগে তিন বার ওই আসন থেকে জিতেছিলেন। সিপিএম প্রার্থী করেছিল রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাককে। অনিল হেরে গিয়েছেন। তবে ত্রিশূর আসন দখলে রাখতে সমর্থ বিজেপি।
আলাপুঝায় বিদায়ী সিপিআই সাংসদ এএম আরিফের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ কেসি বেণুগোপাল। সেখানে বিজেপি প্রার্থী করেছিল শোভা সুরেন্দ্রনকে। তিনি বিজেপি মহিলার মোর্চার রাজ্য সভাপতি। এর আগে কেরলের কোনও মহিলা বিজেপি নেত্রী জাতীয় স্তরে কোনও পদে বসেননি। আত্তিঙ্গালে কংগ্রেসের বিদায়ী সাংসদ আদুর প্রকাশের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী করেছিল বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি মুরলিধরনকে। ২০১৯ সালে এই আসনে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। তারা পেয়েছিল ২৫ শতাংশ ভোট। সে বার প্রার্থী হয়েছিলেন শোভা। ওই আসনে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই এ বার বিজেপি ময়দানে নামিয়েছিল বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। যদিও এই আসনগুলিতে বিজেপির পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছে। কংগ্রেস ১৪টি আসনই পকেটে ভরেছে।