দুর্ঘটনাস্থল।
বড়সড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেল পূর্বা এক্সপ্রেস।
রবিবার সকালে লিলুয়ার কাছে লাইনচ্যুত হল দিল্লিগামী আপ পূর্বা এক্সপ্রেসের ১২টি কামরা। রবিবার সকাল ৮টা ২৫ নাগাদ এই ঘটনার পরে বেশ কিছু ক্ষণ হাওড়া-বর্ধমান মেন ও কর্ড লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনায় কয়েক জন যাত্রী সামান্য আহত হয়েছেন। রেল সূত্রে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, লিলুয়া স্টেশনে ঢোকার আগে পয়েন্টে গোলমাল থাকায় এই ঘটনা ঘটেছে। পূর্বার আটকে পড়া যাত্রীদের তিনটি ইএমইউ লোকালে করে হাওড়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিনের আপ যোধপুর এক্সপ্রেস বাতিল করা হয়েছে। এ দিন দুপুর ৩টের সময় আটক যাত্রীদের নিয়ে একটি বিশেষ ট্রেন দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেয়।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ১২৩০৩ আপ পূর্বা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন-সহ ১২টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে আছে। ট্রেনের যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রেনটি দ্রূত গতিতেই হাওড়ার দিক থেকে আসছিল। আচমকাই ট্রেনটি কেঁপে ওঠে। বাঙ্কে রাখা মালপত্র এ দিক ও দিক হয়ে নীচে পড়তে থাকে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে সে সময়ে দাঁড়িয়েছিল হাওড়ামুখী একটি মালগাড়ি। ওই মালগাড়ির চালক জিষ্ণু নন্দী বলেন, “সিগন্যালের অপেক্ষায় চার নম্বর ফ্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি পাঁচ নম্বর লাইন ধরে ট্রেনটা আসছে। কিন্তু দেখলাম ট্রেনটার অনেক কামরা লাইনের বাইরে দিয়ে ঘষে ঘষে আসছে। কামরাগুলি প্রচণ্ড দুলছে। বড়সড় বিপদ হবে বুঝতে পেরে আমি লাল পতাকা নাড়াতে থাকি। ওই ট্রেনের চালক ব্রেক কষেন। ট্রেনটা তার পরেও বেশ কিছুটা ঘষে ঘষে এগিয়ে আসে।” এই দুর্ঘটনার পরিণতি কী হতে পারত তা ভেবেই এখনও আতঙ্কে শিউরে উঠছেন ট্রেনের যাত্রীরা।
দুর্ঘটনার পরেই পূর্ব রেলের উচ্চপদস্থ অফিসারেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছন। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পূর্ব রেলের জেলারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত বলেন: “কী ভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দেখতে এসেছি উদ্ধার ও লাইন সারানোর কাজ কতটা দ্রুত সারা যায়। যত দ্রুত সম্ভব রেল চলাচলও স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।” ডিআরএম (হাওড়া) বর্তমানে দিল্লিতে। তাঁর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ডিআরএম (শিয়ালদহ) জয়া বর্মা সিংহ। তিনি জানান, এ দিন আপ যোধপুর এক্সপ্রেস ছাড়াও বোলপুরগামী কবিগুরু এক্সপ্রেস এবং শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বাতিল করা হয়েছে। লাইনচ্যুত কামরা সরানো এবং ভাঙা লাইন মেরামতির কাজ সারতে আরও ২৪ ঘণ্টা লাগবে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্য নিরাপত্তা অফিসারের নেতৃত্বে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের পাঁচ জন অফিসারকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত পূর্বার ইঞ্জিন এবং জেনারেটর ভ্যান ছাড়া এস-১ থেকে এস-১১ এবং প্যান্ট্রি কার লাইনচ্যুত হয়ে যায়। লাইনচ্যুত কামরার ধাক্কায় চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ভেঙে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, আরও জোরে ধাক্কা লাগলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লোকজন বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়তে পারতেন। ক্ষতিগ্রস্ত কামরাগুলির নীচের অংশের যন্ত্রপাতি ভেঙে লাইনে পড়ে যায়। কামরার সিড়ি নিচু হয়ে গিয়ে লাইনের পাশে আটকে যায়। ছিঁড়ে পড়ে দুই কামরার মধ্যবর্তী ভেস্টিবিউল। এ দিন ট্রেনের চালকরা জানিয়েছেন, রাজধানী এক্সপ্রেসে যে ধরনের অত্যাধুনিক মানের কামরা থাকে, পূর্বাতেও সেই ধরনের কামরা থাকায় সেগুলি উল্টে যায়নি।
সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এস-৮ এবং এস-৯ কামরা। এস-৯-এ ছিলেন বিষ্ণুপুর বাঁকড়াহাটের বাসিন্দা আশুতোষ নস্কর। তাঁর কথায়, “ইন্টারভিউ দিতে দিল্লি যাচ্ছিলাম। লিলুয়া ঢোকার সময়েই কামরা প্রচণ্ড দুলতে শুরু করে। দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখি লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ট্রেন এঁকেবেঁকে চলেছে।” ওই কামরার আর এক যাত্রী শেখ জাহিরুদ্দিন বলেন, “বাথরুমে ছিলাম। হঠাত্ ট্রেন দুলতে থাকে। দেখলাম, আচমকা ভেঙে গেল বাথরুমের জানলার কাচ। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।” এস-১০ কামরায় ছিলেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। দিল্লিবাসী সুদীপবাবু কলকাতায় কাজে এসেছিলেন, ফিরছিলেন দিল্লিতে। তাঁর অভিজ্ঞতা: “আচমকা ধাক্কা খেলাম। বাঙ্ক থেকে ব্যাগ-বাক্স সব পড়তে আরম্ভ করল। কামরার ভিতর ধুলো-ধোঁয়ায় ভরে গেল। কামরার ভিতরে খোয়া ছিটকে আসতে লাগল। কী করে যে বেঁচে গেলাম ইশ্বরই জানেন।”
যদিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরার যাত্রীদের অভিজ্ঞতা সে রকম নয়। বি-২ কামরায় ছিলেন একটি গানের ব্যান্ডের কয়েক জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে এক জন বলেন, “কিছুটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ট্রেন। ভাবলাম কেউ চেন টেনেছে। নীচে নেমে দেখলাম লাইনচ্যুত হয়েছে ট্রেনটি।”
তবে এই দুর্ঘটনার ফায়দা তুলতে দেরি করেনি চোরেরা। এস-৮ কামরার যাত্রী ব্রিজেশ তিওয়ারি বললেন, “ঘটনার পর ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি। পরে ট্রেনে উঠে দেখি ব্যাগপত্র গায়েব।”
হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৬৪১-৩৬৬০, ০৩৩-২৬৪০-২২৪১/২২৪২
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার ও শান্তনু ঘোষ।