হাওড়ার ফোরশোর রোডে ভাঙচুর হওয়া বাস। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
বেলা যত গড়াচ্ছে সাধারণ ধর্মঘটের দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মঘটের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর মিলছে।
বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা ২৪ ঘণ্টার পরিবহণ ধর্মঘট এবং বামফ্রন্ট ও বিজেপি-র ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের জেরে মিশ্র প্রভাব পড়েছে সারা রাজ্য। বাদ যায়নি বাস ভাঙচুর থেকে বনধ সমর্থনকারী-তৃণমূল কর্মীদের সংঘর্ষ। জরুরি পরিষেবা হলেও বনধের আওতা থেকে ছাড় মেলেনি রেলের। শহর কলকাতার পাশাপাশি জেলা এবং শহরতলির রাস্তায় সরকারি বাস থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। বেসরকারি বাসের সংখ্যা অপ্রতুলই বলা চলে। ট্যাক্সির সংখ্যাও কম। তার জেরে নাকাল সাধারণ যাত্রীরা। অন্য দিনের তুলনায় এ দিন রাস্তায় লোকজনের সংখ্যাও কম।
ধর্মঘট প্রতিহত করতে রাজ্য প্রশাসন যে কোমর বেঁধে নামবে, সেটা মঙ্গলবারই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন রাজ্য সচল রাখার। সাধারণ ধর্মঘট প্রতিহত করতে এতটাই মরিয়া শাসক দল যে সরকারি কর্মীদের এ দিন অফিসে না এলে বেতন ছাঁটাইয়ের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে। ধর্মঘট সফল করতে এককাট্টা বিরোধীরাও। এ দিন সকাল থেকেই দেখা যায়, ধর্মঘট-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে শাসক দল। তার জেরে ধর্মঘটপন্থীদের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন শাসক দলের কর্মীরা। কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গেও গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েন ধর্মঘট সমর্থনকারীরা।
এ দিন সকালে টালিগঞ্জ-কুঁদঘাট রুটের দু’টি বাসে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। হাওড়া জেলার গোলাবাড়িতে তিনটি সরকারি বাস ভাঙচুর করেন বনধ সমর্থনকারী। গোলাবাড়ি সেতুর উপর একটি বাস এবং গোলাবাড়ি থানা এলাকার সালকিয়া এবং হাওড়া পোর্ট এলাকায় ট্রাম কোম্পানির দু’টি বাস ভাঙচুর করা হয়। হাওড়া শহরেরই ফোরশোর রোডে একটি মিনিবাস লক্ষ করে ঢিল ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। কোনা বাসস্ট্যান্ডে ভাঙচুর করা হয়েছে ১০টি মিনিবাস। যদিও এই ঘটনায় ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। পুলিশ সূত্রে খবর, ডিপো থেকে বাস বার করতে না চাওয়ায় ১০টি বাসের কাচ ভাঙচুর করে তৃণমূল।
যানবাহন কম থাকার সুযোগে এক শ্রেণির ট্যাক্সি এবং অটোচালকদের বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া চাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। পূর্ব শাখায় রেল চলাচল স্বাভাবিক বলে জানিয়েছে রেল। যদিও শিয়ালদহ-হাসনাবাদ শাখার বসিরহাটের ভ্যাবলা স্টেশনে রেল অবরোধ করেন বনধ সমর্থনকারীরা। তার জেরে সকাল ৭টা থেকে ঘণ্টা দেড়েক বন্ধ ছিল রেল চলাচল। নাকাল হন নিত্যযাত্রীরা। পরে রেলপুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধ তুলে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। রেল অবরোধ করা হয় শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ডায়মন্ড হারবারের কাছে বাসুলডাঙা স্টেশনে। পুলিশ গিয়ে হটিয়ে দেয় অবরোধকারীদের।
পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় দূরপাল্লার রেল চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। স্বাভাবিক রয়েছে মেট্রো পরিষেবাও। তবে, মেট্রোয় যাত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা। কলকাতা এবং হাওড়ায় খোলা রয়েছে দোকানপাট। শুধু মধ্য হাওড়ায় কয়েকটি জায়গায় ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে। কদমতলা এবং পঞ্চাননতলায় বন্ধ রয়েছে দোকানবাজার। হাওড়া এবং ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলি খোলা থাকলেও কর্মীদের হাজিরার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ব্যারাকপুরে দোকান-বাজার আংশিক খোলা রয়েছে।
বনধ সমর্থনকারী এবং পুলিশের বচসা। আসানসোলে শৈলেন সরকারের তোলা ছবি।
পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, এ দিন সকালে ট্রাম কোম্পানি এবং দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণের ব্যারাকপুর এবং বেলঘরিয়া ডিপো থেকে রাস্তায় নামানো হয় সব ক’টি বাস। যদিও অন্য দিনের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। কামারহাটি-মোল্লারহাট সড়কে সকালে পুলিশের গার্ড রেল রাস্তার মাঝখানে এনে অবরোধ শুরু করেন বনধ সমর্থনকারীরা। তাঁদের সঙ্গে বচসা এবং হাতাহাতিতে জড়িয়ে প়ড়েন শাসক দলের কর্মীরা। পুলিশের তত্পরতায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে। স্বাভাবিক রয়েছে হলদিয়া শিল্পাঞ্চল। অফিসকাছারি, কলকারখানায় কর্মীদের হাজিরা স্বাভাবিক। দোকানপাট কিছু খোলা থাকলেও অবশ্য রাস্তায় বেসরকারি বাস নামেনি। তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর দাবি: “আর পাঁচটা দিনের মতোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে হলদিয়ায়।”
বনধের আংশিক প্রভাব পড়েছে হুগলিতেও। যানবাহন পুরোপুরি স্তব্ধ। তবে চটকলগুলিতে কর্মীদের হাজিরার সংখ্যা স্বাভাবিক। সকাল ৯টা নাগাদ মগরায় জিটি রোডের উপর স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব অবরোধ কর্মসূচি পালন করার সময় পুলিশ এসে হটিয়ে দেয় তাঁদের। আট বনধ সমর্থনকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের তুলতে গেলে তাঁরা প্রতিবাদে কোতোয়ালি থানার সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বসেন। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বনধের সমর্থনে বামকর্মীরা অবস্থান-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছিলেন। সে সময় তাঁদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শাসক দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে বাঁশ, লাঠি নিয়ে অবরোধকারীদের উপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় আহত হন তিন জন। বড়ঞায় বামেদের মিছিলেও হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বড়ঞায় সাঁইথিয়া-কান্দি সড়কের উপর বনধ সমর্থনকারীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে তৃণমূল। বড়ঞায় যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় নাকাল হন যাত্রীরা। মুর্শিদাবাদের কান্দিতে ১৪ জন এবং খড়গ্রামে এক বনধ সমর্থনকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
উত্তর ২৪ পরগনায় ন্যাজাট-বসিরহাট সড়ক অবরোধ করেন বাম সমর্থকেরা। পুলিশি তত্পরতায় কিছু ক্ষণ পরে অবরোধ ওঠে। জেলারই দেগঙ্গা থানা এলাকায় বিজেপি পার্টি অফিস এবং বিজেপি-র মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনায় আহত হন এক বিজেপি নেতা। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। বসিরহাটে যানবাহন মিলছে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। কিছু স্কুল খোলা থাকলেও তাতে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল কম।
কৃষ্ণনগরে থানার সামনে বনধ সমর্থনকারীদের অবস্থান বিক্ষোভ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম শহরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও বেলপাহাড়ির কিছু কিছু এলাকায় বনধ সর্বাত্মক বলে জানা গিয়েছে। বুধবার রাতে ঝাড়গ্রামে কিছু কিছু এলাকায় বনধ ব্যর্থ করতে মিছিল করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের বাইক বাহিনীও বনধ ব্যর্থ করতে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। খোলা রয়েছে স্কুল-কলেজ। ঝাড়গ্রামে একটি স্কুলে এ দিন সকালে বনধ সমর্থনকারীরা পতাকা পুঁততে গেলে তাঁদের হটিয়ে দেন অভিভাবকেরা।
বীরভূমের কোটেশ্বর মোড়ে সিপিএমের এক সমর্থককে মারধরের সময় ঘটনার ছবি তুলতে গেলে এক চিত্র সাংবাদিকের উপর তৃণমূল সমর্থকেরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ। ওই চিত্র সাংবাদিককে সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জেলারই ময়ূরেশ্বরে বনধ ঘিরে গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে তৃণমূল এবং সিপিএম। পুলিশ এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। লাভপুরে বনধের আংশিক প্রভাব পড়েছে। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। পুরুলিয়ায় জনজীবন স্বাভাবিক থাকলেও রাস্তায় দেখা মেলেনি বাসের। বর্ধমানের আসানসোলের কালীপাহাড়িতে সকাল ৭টা নাগাদ ২ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছিলেন বাম সমর্থকেরা। অভিযোগ, সেই সময় অবরোধকারীদের উপর হামলা চালান শাসক দলের কর্মীরা।
এ দিন সকালে আসানসোল জুড়ে বনধকে কেন্দ্র করে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শাসক-বিরোধী দু’পক্ষই। এখানে বনধের মিশ্র প্রভাব পড়েছে। বৃহস্পতিবারে এমনিতেই বাজার-দোকান বন্ধ থাকে। যেটুকু খোলা থাকে এ দিন সেটুকুও বন্ধ ছিল। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া-শিক্ষকদের উপস্থিতির হার কম। যদিও কয়লাখনিতে উত্পাদনের হার স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। সকালে আসানসোল শহরে সিপিএমের একটি মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, সিপিএম সমর্থকদের মারধর করে তৃণমূলকর্মীরা। পুলিশের বিরুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গে যৌথ ভাবে তাঁদের উপর মারধর করার অভিযোগ করেছে বামেরা। ঘটনায় আটক করা হয় বহু বাম সমর্থককে। বার্নপুরে অবস্থান-বিক্ষোভের সময় কয়েক জন সিপিএম সমর্খককে গ্রেফতার করে পুলিশ। আসানসোলের কাছে মুর্গাসোলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব।