সাফল্যের পর মোদীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ইসরোর চেয়ারম্যান কে রাধাকৃষ্ণণ। ছবি: এপি।
‘মম-এর আজ মঙ্গলের সঙ্গে মিলন হল এবং মঙ্গল পেয়ে গেল মম-কে।’ মঙ্গলের কক্ষপথে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) মঙ্গলযান ‘মম’ (মার্স অরবিটার মিশন) পৌঁছনোর পর এ কথাই বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বুধবার সকালেই এসেছিল সুসংবাদ। সৌজন্যে ইসরো। ইতিহাস তৈরি করে লাল গ্রহের কক্ষে পৌঁছয় ইসরোর মঙ্গলযান। প্রথম চেষ্টাতেই সাফল্য পেলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এ দিন সকালে অভূতপূর্ব এই সাফল্যের সাক্ষী রইলেন প্রধানমন্ত্রী। ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়েছে নাসাও। কয়েক দিন আগেই তাদের যান ‘মাভেন’ও পৌঁছেছে মঙ্গল-কক্ষে। তবে সেই যানের থেকে অনেক কম খরচে ভারতীয় মঙ্গলযানের এই সাফল্য বিস্মিত করেছে গোটা বিশ্বকে। ৪৫০ কোটির এই মঙ্গলাভিযান আগের বছরের অস্কার প্রাপ্ত ছবি ‘গ্রাভিটি’র থেকেও সস্তায় সারা গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়ে এ দিন বলেন, ‘‘আজকের সাফল্য আশা করি আমাদের আরও উজ্জিবীত করবে। আমরা আরও বড় লক্ষ্য ঠিক করব।’’ তিনি জানান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী চাঁদে অভিযানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তা সফল হয়েছে। সেই সাফল্যই আজকের পথ খুলে দিয়েছিল। এ দিনের পর অন্য কোনও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
প্রথমে চন্দ্রযান। তার পরে মঙ্গলযান। পর পর সাফল্যে ঝুলি ভরে উঠেছে ইসরো-র। এ বার চিনকেও পিছনে ফেলে দিল ভারত। প্রায় দশ মাস যাত্রার পর এ দিন ছিল মঙ্গলযানের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ২৪ মিনিট! এত দিন নির্দিষ্ট পথে চলার পরে এইটুকু সময়ের উপরেই দাঁড়িয়ে ছিল সাফল্য-ব্যর্থতার মানদণ্ড। মহাশূন্যে ছুটে চলা ভারতের মঙ্গলযানকে লাল গ্রহের কক্ষপথে বসাতে প্রয়োজন ছিল ওইটুকু সময়। এবং এই সময়টুকু কাটল একেবারে পরিকল্পনামাফিক। প্রথম অভিযানেই সাফল্যের বিরল কৃতিত্ব পেল ইসরো। এর আগে আমেরিকা, রাশিয়া বা ইওরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা প্রথম চেষ্টায় মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছতে পারেনি। প্রতিশ্রুতি মতোই প্রধানমন্ত্রী এই অভিযানের চূড়ান্ত মুহূর্তে ইসরো-র পাশে ছিলেন।
মঙ্গলালোকে
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ কেন্দ্র থেকে পিএসএলভি-সি ২৫ রকেটে চেপে লাল গ্রহ পাড়ি দিয়েছিল মঙ্গলযান। এর পরে বেশ কিছু দিন পৃথিবীর চার পাশে পাক খেতে খেতে নিজের গতি বাড়াতে থাকে মঙ্গলযান। সব শেষে ১ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে লাল গ্রহের দিকে ছুটতে শুরু করে সে। দশ মাস ধরে প্রায় ৬৬ কোটি ৬০ লক্ষ কিলোমিটার পার হয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছে যায় মঙ্গলযান। ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩, চলতি বছরের ১১ জুন এবং ২২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামাফিক এর যাত্রাপথের কোর্স কারেকশন করা হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর ৩০০ দিনের ঘুম ভাঙিয়ে মঙ্গলযানের প্রধান ইঞ্জিন ল্যাম-কে (লিক্যুইড অ্যাপোজি মোটর) প্রায় চার সেকেন্ডের জন্য চালু করে ইসরো। এর আগে গত ১৪ এবং ১৫ সেপ্টেম্বর এই যানের চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রোগ্রাম আপলোড করা হয়। সেই যাত্রায় ল্যাম প্রত্যাশামতোই কাজ করে। এ দিনের শেষ ২৪ মিনিট ছিল সেই প্রোগ্রামেরই পরীক্ষা। অভিযান সফল হলে সব শেষে ওই পথে ঘুর্ণিপাক দেওয়ার কথা মঙ্গলযানের। চালানো হবে হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
ইসরো জানিয়েছিল, এ দিন সকালে মঙ্গলের অভিকর্ষ বলয়ে ঢুকবে মঙ্গলযান। পৃথিবীর পড়শি গ্রহের প্রবল টান রুখে মঙ্গলযানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে বসিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সামলাবে ল্যাম। কিন্তু সব কিছু কি ঠিকঠাক হবে? চিন্তায় ছিলেন ইসরো-র প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা। তবে তাঁরা এ দিন ভোর থেকেই প্রত্যয়ী ছিলেন। একে অপরকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন সমানে। কিন্তু যাঁর মাথায় সব দায়িত্ব, ইসরো-র সেই চেয়ারম্যান কে রাধাকৃষ্ণন ছিলেন কিছুটা চিন্তিত। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসবেন বলে বেঙ্গালুরুর কম্যান্ড সেন্টারে ছিল বাড়তি উৎসাহ।
এ দিন প্রথমে কম্যান্ড মিডিয়াম গেইন অ্যান্টেনায় পরিবর্তন করা হয়। মঙ্গলযান থেকে পৃথিবীর দূরত্ব তখনও প্রায় ২২ কোটি ৪০ লক্ষ কিলোমিটার। এই দূরত্ব থেকে পাঠানো বার্তা পৃথিবীতে আসতে ১২ মিনিট সময় লাগে। অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য তাই নতুন এই মিডিয়াম গেইন অ্যান্টেনা গড়েছিল ইসরো। ভোর ৪টে ১৭ মিনিট থেকে মঙ্গলযানের উপর নজর রাখা শুরু করে এই অ্যান্টেনা। এর পরই মঙ্গলযানের ‘স্বাস্থ্য’ ঠিক আছে বলে জানায় ইসরো।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলযান নির্দিষ্ট কক্ষপথের কাছাকাছি পৌঁছনোর পরে সেটিকে নিজের দিকে টানতে তাকে মঙ্গল। প্রবল অভিকর্ষ বলের প্রভাব কাটাতে ৪৪০ নিউটন শক্তিতে মঙ্গলযানটিকে উল্টো দিকে ঠেলাটাই কাজ ছিল ল্যাম-এর। তবে তার আগে মঙ্গলের উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে হয় মহাকাশযানের মুখ। ল্যাম তখন পৃথিবীর দিকে মুখ করে। সে ঘুরছিল মঙ্গলের দিকে। একে বলে ফরওয়ার্ড রোটেশন। সকাল ৬.৫৭ তে এই কাজ করে ইসরো। এর পরেই শুরু হয় ‘গ্রহণ’। সকাল ৭.১২ তে যানটি মঙ্গলের পিছনে তার ছায়ায় (পৃথিবী ও সূর্য মঙ্গলের যে দিকে তার বিপরীতে) ঢাকা পড়ে যায়। এখানে সূর্যালোক পৌঁছয় না। ফলে যানে থাকা সোলারপ্যানেল কোনও শক্তি সরবরাহ করতে পারে না। তখন যানে থাকা ৩৬ মিলি অ্যাম্পেয়ার ব্যাটারি যানটিতে শক্তি সরবরাহ করে। এই সময়ে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগও ছিন্ন হয়ে যায়। একে ইক্লিপস পিরিয়ড বলে। হিসেব অনুযায়ী ১২ মিনিট স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় টেলিমেট্রি-ও।
মিশন অ্যানালিসিস রুমের ভিতর ও বাইরে জয়োল্লাস। ছবি: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়।
আগে থেকে আপলোড করা প্রোগ্রাম অনুযায়ী সকাল ৭.১৭ মিনিটে ল্যাম চালু করা হয়। করতালিতে ভরে ওঠে মিশন কন্ট্রোল। এই ইঞ্জিনটি চালু হওয়ার পরে মঙ্গলের টান কাটিয়ে ছিটকে বেরোতে চায় মঙ্গলযান। পাল্টা সেটিকে নিজের দিকে টানতে থাকে মঙ্গল। ওই টানাটানি শেষে নির্দিষ্ট কক্ষপথে বসে যায় ‘মম’। খেতে থাকে ঘুর্ণিপাক। কিন্তু পুরো ঘটনাটি ঘটে বিজ্ঞানীদের নজরের আড়ালে। বেঙ্গালুরুর মিশন কন্ট্রোলে এই ‘গ্রহণ’-এর সময়টুকু চূড়ান্ত উৎকন্ঠার মধ্যে কাটে। মোদীকেও সেই উৎকণ্ঠার শরিক হতে দেখা যায়। থমথমে মুখে বসে ছিলেন বেশ কিছু ক্ষণ। মুখে হাত চাপা দিয়ে থাকতেও দেখা যায় তাঁকে। বিজ্ঞানীরা তাঁকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করছিলেন মাঝেমধ্যে।
এর পর লাল গ্রহের পূর্ণগ্রাসে চলে যায় মঙ্গলযান। এই ‘ওকুলেট’ পর্বে সব চেয়ে ভরসা রাখতে হয় অ্যাকসেলেরোমিটার নামের যন্ত্রগুলির উপর। মঙ্গলযানে থাকা এই যন্ত্রগুলি পূর্ণগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার পরে ল্যামকে বন্ধ করে দেয়। ৭.৪২ মিনিটে সেই কাজ হওয়ার কথা ছিল। এবং সব কিছু ঠিকঠাক মিলেও গেল। মঙ্গলের পূর্ণগ্রাস থেকে বেরিয়ে এল মঙ্গলযান। সকাল আটটায় ল্যাম বন্ধ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করে ইসরো। মঙ্গলের নির্দিষ্ট কক্ষে বসে যায় মঙ্গলযান। ইতিহাস সৃষ্টি করল ইসরো-র। গর্বিত ভারত বিশ্বের দরবারে নতুন মর্যাদা পেল।