পিংলায় বিস্ফোরণে মৃত ১২, সিআইডি তদন্তের নির্দেশ মমতার

বেআইনি বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় মৃত্যু হল ১২ জনের। আহত অন্তত চার জন। মৃত ও জখমদের বেশির ভাগই বালক ও কিশোর। বয়স ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। তারা ওই কারখানায় শ্রমিকের কাজ করত। গ্রামবাসীদের অবশ্য দাবি, মৃতের সংখ্যা অন্তত ২০। নিষিদ্ধ বাজি তৈরির পাশাপাশি ওই কারখানায় বোমা তৈরি করা হত বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচি

পিংলা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৫ ১০:২৯
Share:

চিকিত্সা চলছে আহত কিশোরের।

বেআইনি বাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় মৃত্যু হল ১২ জনের। আহত অন্তত চার জন। মৃত ও জখমদের বেশির ভাগই বালক ও কিশোর। বয়স ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। তারা ওই কারখানায় শ্রমিকের কাজ করত। গ্রামবাসীদের অবশ্য দাবি, মৃতের সংখ্যা অন্তত ২০। নিষিদ্ধ বাজি তৈরির পাশাপাশি ওই কারখানায় বোমা তৈরি করা হত বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। এই ঘটনায় ইতিমধ্যেই সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েছে শাসক দলের নামও। যাঁর জমিতে ওই বাজি কারখানা চলত, সেই রঞ্জন মাইতি এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবেই পরিচিত। এ দিন সকালেই পিংলার জলচক থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে রঞ্জনকে। তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব রঞ্জনকে দলের কেউ বলে মানতে নারাজ।

বিস্ফোরণে বাজি কারখানার মালিক রামপদ মাইতি (৩২), তাঁর স্ত্রী রিনা মাইতি (২৮)-রও মৃত্যু হয়েছে। আহতদের মধ্যে তিন জনকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে মুস্তাক আহমেদ নামে এক জনকে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। মুস্তাকের বাড়ি মুর্শিদাবাদের সুতি থানার অরঙ্গাবাদে। পুলিশ সূত্রে অনুমান, মৃতদের মধ্যে তিন জনের বাড়ি পিংলায়। বাকিদের সকলেই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা বলে অনুমান।

Advertisement

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত ৯টা ৪০ মিনিট নাগাদ হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে ব্রাক্ষ্মণবাড় গ্রাম। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ হতে থাকে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় কেঁপে ওঠে ১৫ কিলোমিটার দূরের ডেবরা, সবংয়ের বিভিন্ন গ্রামও। গ্রামবাসীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, কারখানায় ভয়াবহ আগুন লেগেছে। কারখানার ভিতরে একের পর এক জোরালো বিস্ফোরণেরও শব্দ হতে থাকে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ ও দমকল বাহিনী। খড়্গপুর থেকে দু’টি ও মেদিনীপুর থেকে দমকলের একটি ইঞ্জিন রওনা দেয়। তবে পিংলার মণ্ডলবাগ থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড় যাওয়ার সঙ্কীর্ণ মোরাম রাস্তা দিয়ে একটিই ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে। এলাকায় পুলিশ পৌঁছলে তাদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে গ্রামবাসীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে যান জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও কারখানাটি আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। আগুনে কারখানার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি পিক-আপ ভ্যানেরও ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, বাজির মশলা আনা ও বাজারে তৈরি বাজি পাঠানোর জন্য এই গাড়িই কাজে লাগানো হত।


মর্গের সামনে পুলিশি প্রহরা।

ওই গ্রামের বাসিন্দা গীতা প্রধান বলেন, ‘‘রাতে বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। মাটিও কাঁপতে থাকে। প্রথমে ভাবি, হয়তো ভূমিকম্প হচ্ছে। বেরিয়ে দেখি, রঞ্জনদের বাজির কারখানা জ্বলছে।’’ পাশের গ্রাম ডাডরার বাসিন্দা জয়দেব সামন্ত, রবীন মান্নাও বলেন, ‘‘রাত পৌনে দশটা নাগাদ হঠাৎ বাড়ি প্রচণ্ড কাঁপতে শুরু করে। এলাকার মহিলারা শাঁখ বাজাতে শুরু করেন। পরে খোঁজ পাই ব্রাক্ষ্মণবাড় গ্রামে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। সকালে ব্রাক্ষ্মণবাড়ে এসে দেখি, এলাকা লন্ডভন্ড।’’ ঘটনার পরেই পালান রঞ্জন মাইতি। বৃহস্পতিবার সকালে পিংলার জলচক থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফুটতেই দেখা যায়, বিস্ফোরণের তীব্রতায় এলাকা লন্ডভন্ড। ঘটনাস্থলের প্রায় একশো মিটার দূরে বিভিন্ন গাছে কারখানার বাঁশের কাঠামো, সরঞ্জাম, মৃত কর্মীদের দেহাংশ, পোশাকের টুকরো ঝুলতে দেখা যায়। বুধবার রাতেই পুলিশ কয়েকজনের দেহাংশ বস্তাবন্দি করে নিয়ে যায়। এ দিন সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর উদ্ধার কাজ আরও জোরদার হয়। তবে মৃতদের সকলকে শনাক্ত করা যায়নি।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত ৯টা নাগাদ ব্রাক্ষ্ণণবাড় গ্রামের বাসিন্দা শুভেন্দু ভক্ত্যাও রামপদর সঙ্গে বাজি কারখানায় যায়। তারপর থেকে শুভেন্দুর খোঁজ মেলেনি। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা নকুলচন্দ্র মাইতি বলেন, ‘‘শুভেন্দুর ওই কারখানায় যাতায়াত ছিল। বুধবারহ রাতেও রামপদর সঙ্গে ও কারখানায় যায়। তবে বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে শুভেন্দুর খোঁজ মেলেনি। আমাদের ধারণা, ওর মৃত্যু হয়েছে।’’ পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনের দেহাবশেয উদ্ধার হয়।

বাসিন্দাদের দাবি, শুধু বাজি নয়, তার আড়ালে ওই কারখানায় চলত হাতবোমা বানানোর কাজও। এ দিন সকালে ওই এলাকায় পৌঁছয় বম্ব স্কোয়াডের লোকজন। কারখানা থেকে তাঁরা বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা বাজির মশলা গুঁড়ো করা, মশলা মেশানোর যন্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। এ ছাড়াও কারখানায় প্লাস্টিকের বল, স্টোনচিপস্‌ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশের অনুমান, ওই প্লাস্টিকের বলগুলিতে বারুদ ও স্টোনচিপ ভরে হাতবোমা তৈরি করা হত। এই স্টোনচিপগুলি স্প্লিন্টারের কাজ করত।

দীর্ঘ দিন ধরেই বাজি বানানোর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন পিংলার সুদছড়া গ্রামের বাসিন্দা রামপদ মাইতি। আগে নিজের বাড়িতেই বাজির কারবার চালাতেন রামপদ। ২০১২ সালে বাসে করে বাজির মশলা নিয়ে আসার সময় পিংলার মুণ্ডমারির কাছে তা থেকে বাসে আগুন ধরে যায়। পরে সুদছড়া গ্রামের বাজি কারখানাতেও বিস্ফোরণ হয়। সেই ঘটনার পরই সুদছড়ার বাসিন্দারা রামপদকে গ্রামছাড়া করেন বলে অভিযোগ। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা সৌরভ সিংহ বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পর স্ত্রী রিনা মাইতিকে নিয়ে রামপদ ব্রাক্ষ্মণবাড় গ্রামে চলে আসে। তবে ইদানীং গ্রামের বাড়িতেও রামপদ যাতায়াত করত।’’


হাসপাতালে চিকিত্সা চলছে এক আহতের।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৩ সালের প্রথম দিকে রামপদ ব্রাক্ষ্মণবাড় গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জন মাইতির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ি সংলগ্ন রঞ্জনবাবুর একটি জমিতেই গড়ে ওঠে বেআইনি বাজি কারখানা। ওই কারখানায় কোনও রকম অনুমতি না নিয়েই মূলত জলবোমা, গাছবোমা জাতীয় শব্দবাজি তৈরি হত বলে অনুমান। স্থানীয়দের অভিযোগ, আসলে রামপদকে শিখণ্ডি করে বকলমে কারখানা চালাতেন এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত রঞ্জনই। পুলিশকে একাধিক বার কারখানার কথা জানানো হলেও কোনও কাজ হয়নি। এই বাজি কারখানার কাছেই বাড়ি প্রণতি টুডুর। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশকে বেআইনি এই কারখানার কথা একাধিক বার বলেছি। গ্রামবাসীরাও অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।’’

এ দিন ঘটনাস্থলে যান বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য, দলের জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়। এলাকায় যান জেলা তৃণমূল নেতৃত্বও। তাঁরা এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ দিন শমীকবাবু অভিযোগ করেন, ‘‘নামেই বাজি কারখানা। নিশ্চিত ভাবেই এখানে বোমা তৈরি হত। এবং তা পুলিশের যোগসাজশেই হত।’’ গ্রামবাসীরাও পুলিশ-প্রশাসন ও শাসকদলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন।

ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement