পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলতন্ত্র কায়েম করিবার অনিল বিশ্বাস চালিত নীতি যে ভুল ছিল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাহা স্বীকার করিয়াছেন। বিমান বসুর স্থলে দলের রাজ্য সম্পাদক হইয়াছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। এই দুই ঘটনার যে কোনও একটিই বলশেভিক বিপ্লবের সমান যুগান্তকারী। একই সঙ্গে দুই দুইটি বিপ্লব ঘটাইয়া সিপিআইএম-এর চব্বিশতম রাজ্য সম্মেলন যে ইতিহাস সৃষ্টি করিল, আগামী চব্বিশ বছর দল নিশ্চয়ই তাহার ওম পোহাইয়া পরম তৃপ্তি বোধ করিবে। প্রকাশ কারাট এবং তাঁহার বঙ্গীয় সতীর্থরা আপন দলকে পিছন দিকে ঠেলিতে ঠেলিতে যেখানে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, তাহাতে ইহার অধিক কিছু প্রত্যাশা করিবার সামর্থ্যও বোধ করি দলনেতাদের অবশিষ্ট নাই। পশ্চিমবঙ্গের মসনদ হইতে উৎখাত হইবার পরে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত, এখনও তাঁহারা পরাজয়ের বিহ্বলতা কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই। আগামী বছরে বিধানসভা নির্বাচনে তাঁহাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস নহে, ভারতীয় জনতা পার্টি, সুতরাং ব্রিগেডে রবিবার লোক আসিলে তাঁহারা পুলকিত হইয়া ভাবিতেছেন, বুঝি দুই-চারিখান শিকা ছিঁড়িল! জ্যোতি বসু উপস্থিত থাকিলে বড় বিষণ্ণ বোধ করিতেন।
বুদ্ধদেববাবু ভুল স্বীকার করিয়া কোনও অন্যায় করেন নাই। ভুল স্বীকারে কখনও কোনও অন্যায় নাই। কিন্তু বড় বেশি দেরি হইল না কি? একটা গোটা দশক তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কার্যত তাঁহার জমানার শুরুতেই অনিল বিশ্বাস বিদায় লইয়াছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিক্ষার পরিসর হইতে অনিলায়নের ভূতটিকে বিতাড়ন করেন নাই, এমনকী তাহার বিশেষ কোনও চেষ্টাও করেন নাই। শিল্পায়নের লক্ষ্যে সংস্কারের যে তাগিদ তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় পর্বে দেখা গিয়াছিল, শিক্ষায় তাহার কণামাত্র দেখা যায় নাই। কেন, তাহা অনুমান করিতে অসুবিধা হয় না। শিক্ষাঙ্গনের দলতন্ত্র সিপিআইএমের রাজ্যপাট কায়েম রাখিবার একটি প্রধান প্রকরণ হিসাবে দলনায়কদের নিকট স্বীকৃত হইয়াছিল, সেই উচ্চফলনশীল ব্যবস্থাটি পরিবর্তনের সাধ বা সাধ্য, কোনওটাই তাঁহার হয় নাই। আজ দল সর্বহারা হইয়াছে, আজ ফাঁকা অনুশোচনায় কোনও লোকসান নাই। কোনও লাভও নাই। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন, তিনি অনিলায়নের ভুল স্বীকার করিলেও তাঁহার উত্তরসূরি তাহাকেই ঠিক বলিয়া মানিয়াছেন, অতএব এখন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেই অনিলায়ন সমানে চলিতেছে। পশ্চিমবঙ্গ? ন যযৌ ন তস্থৌ।
বিমান বসুর স্থলে সূর্যকান্ত মিশ্র এই ‘পরিবর্তন’ও একই সত্যের উল্টো পিঠ। মানিতেই হইবে, বয়সের বিচারে নেতৃত্বের বয়স প্রায় এক দশক কমিয়াছে। কিন্তু হাতে রহিল ওইটুকুই। ব্যক্তি হিসাবে বিমান বসু বা সূর্যকান্ত মিশ্র কে কেমন, তাহা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। ব্যক্তি গৌণ, চিন্তা বা মানসিকতা মুখ্য। বিমানবাবু যে চিন্তার প্রতিভূ, সূর্যকান্তবাবু যে তাহা হইতে কিছুমাত্র ভিন্ন মানসিকতা পোষণ করেন, তেমন কোনও লক্ষণ তাঁহার কথায় বা কাজে দেখা যায় নাই। সুতরাং মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে, রাজ্য সম্পাদকের নাম বদলাইয়াছে, দলের নীতি ও ধারণার কিছুমাত্র বদল ঘটিবে না। ইউরোপ হইতে লাতিন আমেরিকা দুনিয়া জুড়িয়া বামপন্থীরা নিজেদের সংস্কার সাধন করিতেছেন। ভিয়েতনাম এখন বিশ্বায়নের অন্য নাম। চিন না-হয় দেং জিয়াও পিং-ধন্য, কিন্তু এমনকী কিউবাও দুই চক্ষু কচলাইতেছে। বঙ্গীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্মুখে এখন একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়া। সম্ভবত, অদূর ভবিষ্যতে কিম জং-আনও চোখ হইতে ঠুলিটি খুলিয়া ফেলিবেন, সিপিআইএম তখনও আপন জুরাসিক পার্কের সিংহাসনে বসিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুণ্ডপাত করিবে এবং আতসকাচ সহযোগে ১৯৭৮ সালের পার্টি দলিল পড়িবে।