উন্নয়নের শিকার। যথেচ্ছ বালি তোলার ফলে বিপন্ন চিনের ইয়াংসি নদী। গেটি ইমেজেস।
দলে দলে লোক এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পায়ে হেঁটে। তাদের চার পাশে কাছে-দূরে সব জমি ধুলো-ভরা। অনেক দূরে বহুতল সব বাড়ি। ধুলো, ধুলো, নীরস নির্জল ধুলো। ঘাম নেই, জলের চিহ্ন নেই, মানুষদের পোশাকে ছাড়া কোথাও কোনও রং নেই। ফসল-খেত নেই, কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পর পর তিন বছর বৃষ্টি নেই। তাপ বাড়ছে।
শুকনো মাঠ। গভীর ক্ষতচিহ্নের মতো প্রকাণ্ড সব গহ্বরের পাশে কাঁকর-পাথরের স্তূপ। কিছু ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরি গাছ। পুকুর কাঁদর শুকনো। আধশুকনো ঘাস আর বালি দেখে বোঝা যায় এখানে নদী ছিল, এখন নেই। বালি কেটে ট্রাকে করে বিক্রি হয়। খেতের নরম মাটি কেটে নিয়ে ইট তৈরির জন্য খেজুরগাছ, তালগাছ কেটে পোড়ানো হয়। তাল খেজুর অনেক ক্ষণ জ্বলে। যখন বৃষ্টি হবে, পুরো মাঠের ওপর দিয়ে বিধ্বংস নিয়ে আসবে জল। তার বয়ে যাবার নির্দিষ্ট খাত নেই। নদীর বুকের বালি ছড়িয়ে পড়বে খেতের পর খেত, গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে। অনেক লোক নিজেদের এলাকা ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে কাজ খুঁজতে।
প্রথম ছবিটি মার্কিন দেশের একটি সিনেমার দৃশ্য। ‘ইয়ার্স অব লিভিং ডেঞ্জারাসলি’। নির্জল নির্বীজ খেতের ওপর তাপ বেড়ে চলার উপাখ্যান। দ্বিতীয়টি আজকের পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের যে কোনও অঞ্চলের, যা কুড়ি বছর আগে কৃষিপ্রধান ছিল। সবুজ আর স্যঁাতসেঁতে সেই সব অঞ্চলের নদী-পুকুর-মাটি, ক্রমশ বাতাস হয়ে উঠছে শুকনো, রুক্ষ। তাপ যে বাড়ছে তা বোঝার জন্য কোনও উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন জলবায়ু দফতরের দরকার হচ্ছে না। এমনকী বহু দিন ধরে বহু বার এ সব কথার পুনরাবৃত্তি এক রকম নিশ্চিন্ত ঔদাসীন্যও তৈরি করেছে, বিশেষত সচ্ছল আধুনিক নাগরিক পাঠকদের মনে। ‘এত সব বিপদবাণী সত্ত্বেও পাওয়া তো যাচ্ছে জল’, ‘সত্যি কি আর পাওয়া যাবে না! ও বিজ্ঞান কিছু একটা উপায় বার করেই ফেলবে।’ এ রকম অনেক বৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাসও উদাসীনতাকে খানিক ভরসা দেয়।
কিন্তু শুধু জল পাওয়া যাবে না, বা গ্রীষ্ম ও বর্ষা আরও অনেক তীব্র হবে, বাড়তে পারে সামুদ্রিক ঝঞ্ঝার সংহারমূর্তি এ সব ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অন্য রকম কথা শোনা গেল আইপিসিসি-র চেয়ারপার্সনের সাম্প্রতিক বিবৃতির মধ্যে। রাজেন্দ্র পচৌরি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের সংখ্যা বাড়বে।’ এই ভবিষ্যত্ সম্ভাবনাটি সরাসরি আন্তঃসরকার বিশ্ব উষ্ণায়ন প্যানেলের আলোচনার মধ্যে হয়তো পড়ে না। কিন্তু মানুষের, প্রাকৃতিক সমস্ত উপাদানের অস্তিত্বের সঙ্গে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত রয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গড়ে ওঠা পৃথিবীর প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা, যে একটির বিপন্নতা অন্যটিকে অনেক গভীর সংকটে ফেলে দেবে, সে কথা স্বীকার না করা আইপিসিসি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পক্ষে হয়তো কিছুটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক হত। এই সংকটভাবনা কারও একার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। সারা পৃথিবী থেকে আঠারোশো বিজ্ঞানী জাপানের ইয়োকোহোমা শহরে পাঁচ দিনের সমাবেশ শেষে নিজেদের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন। এবং এই প্রথম নয়, এর আগে অন্তত তিন বার খুবই শঙ্কাজনক এই বিপদবার্তা পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশগুলোর শাসকদের উদ্দেশে দিয়েছেন তাঁরা: শক্তিধর দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ব্যাপারে সংযত না হলে পৃথিবীর জলহাওয়া ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠবে। জ্বরের তাপে ধুকছে মানুষ ও প্রাণীদের একমাত্র আশ্রয় এই নীল-সবুজ গ্রহটি। জ্বর নামার ব্যবস্থা না হলে এর বিকার দেখা দেবে।
বহু শুভবুদ্ধির মানুষ সতর্ক করে চলেছেন, প্রকৃতির সবচেয়ে স্বাভাবিক যে কাজ, নিরন্তর গাছপালা-ঘাস অর্থাত্ প্রাথমিক খাদ্য তৈরি করে চলা, অস্বাভাবিক তাপবৃদ্ধির দরুন সেই কাজ ব্যাহত হচ্ছে। প্রকৃতির ক্ষমতা ক্ষয়ক্ষতি সামলে আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার, কিন্তু সেই ক্ষয়ক্ষতিরও তো কোনও সীমা আছে!
একটা কথা পরিষ্কার। এই অসংযত গ্রিনহাউস গ্যাস আবহাওয়ায় মেশানোর কাজটা তো কোনও দেশেরই সাধারণ মানুষের কৃতকর্ম নয়, এই বিধ্বংস বন্ধ করাও তাঁদের সাধ্যের বাইরে। অল্প কয়েকটি বৃহত্ কর্পোরেট, তাদের বশংবদ কিছু উন্নত দেশের সরকার নিজেদের ধরনধারণ না পাল্টালে এই ক্রমাগত অস্বাভাবিক তাপবৃদ্ধি কমানো সম্ভব হবে না। আবার এ-ও সত্যি যে, প্রাকৃতিক দাক্ষিণ্য-বিরোধী এক সংস্কৃতিও তৈরি হয়ে উঠছে সচ্ছল সমাজে। সামান্য কারণে আশপাশের গাছ কেটে ফেলা, কাঁচামাটি বাঁধিয়ে দেওয়া প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। এ-ও কোনও বিকৃত বুদ্ধির প্রকাশ। ‘ক্ষমতামদ’ শব্দটা তো আমাদের ভাষাতেই আছে। কিন্তু যেমন বুদ্ধিই হোক, তা যে আছে এবং যথেষ্ট সংগঠিত ভাবেই আছে, তাতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। যেমন ধরা যাক, এই সপ্তাহেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে তারা তীব্র সামুদ্রিক ঝড় অথবা প্রতিকূল আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রচার করবেন, কিন্তু তার কারণ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করবেন না। তখন আমরা যেন একটু বুঝতে পারি যে, গাড়োয়ালের গত বছরের বর্ণনাতীত বিধ্বংসকে কেন কেবলই অতিবৃষ্টিজনিত ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ বলে আখ্যাত করা হয়। মার্কিন সাংবাদিক অ্যামি গুডম্যান তাঁর ‘ডেমোক্রেসি নাউ’ পত্রিকার কলামে লেখেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি খনিজ-জ্বালানিজাত টাকায় সাঁতার দিচ্ছে, সেইখানেই ডুবে যাচ্ছে মার্কিন গণতন্ত্র।’ এ দেশেও এখন সবচেয়ে দ্রুত বিস্তারমান শিল্প হয়ে উঠছে খনি ও নির্মাণশিল্প। তারাই উন্নয়নের অভিজ্ঞান। স্পঞ্জ আয়রন, ইটভাটা, বড়, আরও বড় খনি। চওড়া রাস্তা, অগণিত বহুতল, প্রকাণ্ড বাঁধ। এর পিছনে আছে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা বিকারের রুগি যেমন খাদ্যাখাদ্যনির্বিশেষে সব কিছু খেতে চায়।
আইপিসিসি-র প্রতিবেদনটির লেখকদের অন্যতম, বাংলাদেশের বরিষ্ঠ আবহাওয়াবিজ্ঞানী সালিমুল হক ‘ডেমোক্রেসি নাউ’-তে বলছেন, ‘খনিজ-জ্বালানি (কয়লা-পেট্রোল) সরবরাহকারী কোম্পানিগুলির... টিকি বাঁধা আছে খনিজ-জ্বালানির সঙ্গে। কিন্তু আমাদের অবস্থা তেমন নয়। আমরা যদি সত্যিকারের কোনও পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করতে চাই আর বাঁচতে চাই চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাবৃদ্ধি থেকে, তা হলে আমাদের ওই খনিজ-জ্বালানির বাঁধন কেটে বেরিয়ে যেতে হবে।’ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনে নিঃস্ব হতে থাকা এই দেশে কোনও স্পষ্টস্বরে আমরা এই মুক্ত হবার ইচ্ছা প্রকাশ হতে শুন