প্রবন্ধ ১

‘সর্বজনীন’ হয়ে ওঠাই মোদীর চ্যালেঞ্জ

বিরোধীরা যতই একত্র হওয়ার তোড়জোড় করুক, শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা বিরোধীদের নিয়ে নয়, নিজের দল নিয়েই। দলের ভেতরে মতানৈক্য মেটানোই এখন আসল কাজ।সবে শেষ হল জম্মু ও কাশ্মীর এবং ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন। বোঝা গেল, কেন্দ্রীয় শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি যে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আপাতত চলছে, তার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব জায়গায়, সব সময় নরেন্দ্র মোদীর ম্যাজিক কাজ করে না! বিজেপি রাজনীতি দিয়ে ভারতীয় সমাজের মেরুকরণের কাজটাই ভাল হয়। ধরা যাক জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা।

Advertisement

পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

পরিবার। মুলায়ম সিংহ যাদব ও লালুপ্রসাদ যাদব। দিল্লি, ডিসেম্বর ২০১৪। ছবি: পিটিআই।

সবে শেষ হল জম্মু ও কাশ্মীর এবং ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন। বোঝা গেল, কেন্দ্রীয় শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি যে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আপাতত চলছে, তার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সব জায়গায়, সব সময় নরেন্দ্র মোদীর ম্যাজিক কাজ করে না! বিজেপি রাজনীতি দিয়ে ভারতীয় সমাজের মেরুকরণের কাজটাই ভাল হয়। ধরা যাক জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা। হিন্দুপ্রধান জম্মু অঞ্চলে গেরুয়া পার্টি ঝড় তুলতে পেরেছে, কিন্তু প্রবল মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকায় আঁচড়টিও কাটতে পারেনি (কাশ্মীরে মাত্র ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি)। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি (সামগ্রিক ভাবে) ৩১ শতাংশ ভোট পেলেও মনে রাখতে হবে যে, তাদের দলের ২৮২ জন সাংসদের মধ্যে এক জন মুসলিমকেও তারা পায়নি। এর থেকে যা বোঝার মোদী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। যে দেশে সাত জন নাগরিকের মধ্যে এক জন অহিন্দু, সেখানে একটিও অহিন্দু সমর্থন না আনতে পারলে আর যাই হোক, দেশময় ‘সর্বজনীন’ উন্নয়নের গল্পটা কিন্তু ফাঁদা মুশকিল!

Advertisement

তবে এ সব নিয়ে এখনই প্রধানমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর দরকার পড়বে না। জম্মু ও কাশ্মীর এবং ঝাড়খণ্ড, দুটি রাজ্য থেকেই একটি পরিষ্কার বার্তা পাওয়া গিয়েছে: সব কয়টি অ-বিজেপি দল একত্র না হলে শাসকদলের ক্ষমতায় ভাঙন ধরানো অসম্ভব। সারা দেশ জুড়েই বিরোধী দলগুলির যা হাল, তাতে হয়তো ক্রমে এমন একটা প্রয়াস শুরু হতেই পারে। সে প্রচেষ্টা হলেও বিজেপি-র ঘাবড়ানোর কিছু নেই। প্রধান বিরোধী দলগুলির মধ্যে যে বিস্তর এবং দুস্তর মতানৈক্য, তা যে সহজে মেটার নয়, বিজেপি ভালই জানে।

ভারতীয় রাজনীতিতে এখন ভারতীয় জনতা পার্টিই হল প্রধান মেরু। এক বার ফিরে দেখা যাক, যখন কংগ্রেস প্রধান মেরু ছিল, কেমন ছিল পরিস্থিতিটা। ১৯৪৭ সালের অগস্ট থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত প্রায় পুরো সময়টাই কংগ্রেস নিজের জোরে সরকারে থেকেছে, মাঝে মাত্র বারো বছর বাদ দিয়ে। মনে রাখতে হবে (বিজেপি বার বার মনে করিয়ে দিতেও ভোলে না) যে, এই সাড়ে চার দশকের কংগ্রেস শাসনে ছয় বছর ছাড়া সব সময়েই কিন্তু গাঁধী-নেহরু পরিবারের কেউ না কেউ দলের মাথায় থেকেছেন, হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, নয়তো সনিয়া গাঁধীর মতো বকলমে প্রধানমন্ত্রিত্ব করে। মাঝের ওই ছয় বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও পি ভি নরসিংহ রাও, কেবল এই দুই জন নেতাকে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী মোদী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি এমন এক ভারত তৈরি করতে চলেছেন যার মধ্যে একমেবাদ্বিতীয়ম পার্টি-র ‘সেই ট্র্যাডিশন’ আর থাকবে না: ভারত হবে কংগ্রেস-‘মুক্ত’। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মনে করে নিতে পারি কী ঘটেছিল ১৯৬৭-এ, কিংবা ১৯৭৭-এ, কিংবা ১৯৮৯-এ, এবং সর্বশেষে, ১৯৯৬ সালে। ১৯৬৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীরা হাত মিলিয়ে নানা প্রদেশের শরিকি সরকার তৈরি করেছিল। ভারতের ইতিহাসে প্রথম বার, কোনও কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যে পা না দিয়েই কলকাতা থেকে অমৃতসর অবধি যাওয়া যেত! ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে, এবং তার পর ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে অ-কংগ্রেসি রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের তীব্র আদর্শগত অনৈক্য সত্ত্বেও সফল ভাবে হাত মেলাতে পেরেছিল। একই চেষ্টা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল প্রথমে দেব গৌড়া ও তার পর ইন্দ্রকুমার গুজরালকে শীর্ষে রেখে। দুই জনের কেউই অবশ্য কংগ্রেসবিরোধী দলের মুখ হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো ‘ক্যারিসমাটিক’ ছিলেন না। এই ইতিহাস মাথায় রাখলে বোঝা যায়, বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি কতখানি আলাদা।

২০০৯ আর ২০১৪ সালের মধ্যে বিজেপির ভোট-শতাংশ বেড়ে ১৮.৮ থেকে ৩১-এ পৌঁছেছে। পাল্লা দিয়ে কমেছে কংগ্রেসের ভোটও, ২৮.৫৫ শতাংশ থেকে ১৯.৩১ শতাংশে। আমাদের গণতন্ত্রে যেহেতু ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল অনুসৃত হয়, অর্থাৎ যে দল অন্যদের চেয়ে তুলনায় এগিয়ে থাকে, সে-ই সরকার গঠনের দায়িত্ব পায়— ভোটে জয় ও পরাজয় দুই-ই বাস্তবের চেয়ে অনেক বড় বলে অনুভূত হয়। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের হাতে মাত্র ৪৪ জন সাংসদ। বাম দলগুলিও নেমে গিয়েছে তলানিতে, মাত্র ১২ সাংসদ তাদের ঝুলিতে। সদ্যগঠিত আম আদমি পার্টির মাত্র চার জন সাংসদ।

অতঃ কিম্? ১৯৭০ সালে যেমন ঘটেছিল, এ বারেও সেই ধারাই দেখা যাচ্ছে, প্রধান দলের বিরোধীদের কী ভাবে এককাট্টা হতে হয়, সেই পথ দেখাচ্ছে বিহার। ২০১৪-র মে মাসে জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই দুই অতিপুরাতন শত্রু সেখানে হাত মিলিয়েছে, জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর নীতীশ কুমার ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লালুপ্রসাদ যাদব নিজেদের পুরোনো ঝগড়া সরিয়ে রেখে কাছাকাছি এসেছেন, পরস্পরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর কোনও পথ না থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেসেরও তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। তারাও বুঝেছে, কেবল এই ভাবেই বিজেপি ও বিজেপি-র ছোটখাটো মিত্র দলগুলির (যেমন, রামবিলাস পাসোয়ানের লোক জনশক্তি দল) মোকাবিলা করা সম্ভব। এই ভাবে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে দিয়ে বিহারে একটা নতুন দ্বিমেরু প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে উঠছে। কী তার ফলাফল, সেটা বোঝা যাবে ২০১৫-র নভেম্বরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের যুদ্ধের সময় এলে।

ডিসেম্বরের গোড়ায় বোঝা গেল, কেবল জেডিইউ এবং আরজেডি-ই নয়, একই হিসেব কষছে অন্যরাও। বাস্তবিক, জনতা পরিবারের সঙ্গে যুক্ত আরও চারটি দল একত্র হতে ইচ্ছুক। উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার নেতৃত্বে কর্নাটকের জনতা দল (সেকুলার), চৌতালা পরিবার পরিচালিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দল, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের প্রতিষ্ঠিত সমাজবাদী জনতা পার্টি। শেষোক্ত দলটি অবশ্য আকারে খুবই ছোট, তাই হয়তো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এরা ছাড়াও আরও একটি দলের নাম করা দরকার, পুরোনো জনতা পার্টির সদস্য বলে যাকে সঙ্গে নিতে অন্যরা খুব একটা ইচ্ছুক নয়। এই শেষ দলটির নাম রাষ্ট্রীয় লোক দল, যার নেতৃত্বে আছেন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী অজিত সিংহ।

মুলায়ম সিংহের সামনে এখন একটা বড় কাজ, পুরনো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলগুলিকে এক জায়গায় আনা। কাজটা হয়তো তত কঠিন হবে না, কেননা অধিকাংশেরই ভৌগোলিক অবস্থান আলাদা, বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন দল। বরং মুশকিল বাধবে যে সব বিজেপি-বিরোধী দল একই অঞ্চলের, তাদের নিয়ে। যেমন, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজনসমাজ পার্টি কিছুতেই সহাবস্থানে উৎসুক হবে না, যদিও মায়াবতীর বিএসপি গত অগস্ট মাসে উত্তরপ্রদেশের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। ২০১৭ সালে সে রাজ্যে বিধানসভা ভোট; তার আগে শত বিজেপি-বিরোধিতা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি না হওয়ারই কথা।

মায়াবতী ও মুলায়মের মতো একই পরিস্থিতিতে আছেন আরও কেউ-কেউ। যেমন, এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা ও ডিএমকে নেতা এম করুণানিধি, কিংবা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাম ফ্রন্ট নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সারদা কেলেঙ্কারিতে আপাতত পর্যুদস্ত। অন্য দিকে জয়ললিতার কর-কেলেংকারির ঘা-ও এখনও শুকোয়নি। বিজেপি সরকার নিশ্চিত ভাবেই বিবিধ সরকারি এজেন্সির সাহায্যে তাঁগের বিরুদ্ধে তদন্ত জোরদার ভাবে চালু রাখবে, যাতে দুই আঞ্চলিক নেত্রীকেই যথেষ্ট চাপে রাখা যায়। সম্ভবত একই ভাবে চাপে রাখার চেষ্টা হবে আর এক নেত্রীকেও। মায়াবতীর বিপুল সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তিও এখনও হয়নি। ওড়িশার নবীন পট্টনায়কের দলও জাতীয় স্তরে যথেষ্ট অকেজো। বস্তুত বিজেডি সরকারের বিরুদ্ধে তার নিজের রাজ্যেও এই মুহূর্তে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, ১৫ বছর একনাগাড়ে মুখ্যমন্ত্রী থাকলে এটা হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থাৎ বিরোধীদের কারও অবস্থাই খুব শক্তপোক্ত নয়। তাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ দুর্বল বলা যায়।

সব মিলিয়ে, বিজেপির এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। শাসক দল হিসেবে বরং তার এখন অনেক অন্যান্য ভাবনা। দলের কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী ও নরমপন্থীদের মধ্যে মতানৈক্য অনেক, তাদের মধ্যস্থতা দরকার। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে দলের লিবারেল ও রক্ষণশীলদের প্রবল মতবৈষম্যের মীমাংসাও দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এগুলোই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। তিনি নিজে যখন তাঁর সরকারের ‘সর্বজনীন’ চরিত্র ঘোষণা করছেন, সেই সময়ে তাঁর নিজের দলের ‘পরিবার’-কট্টরবাদীরাই যাতে তাঁকে হাস্যাস্পদ না করে তোলে, সেটা তো তাঁকেই দেখতে হবে।

এত সবের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক জোট নিয়ে মোটেই অহেতুক দুশ্চিন্তা করছেন না শ্রীযুক্ত মোদী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement