প্রবন্ধ ২

সন্ত্রাস না গণতন্ত্র, কোনটা বেছে নেব

মুখ্যমন্ত্রী চাইলে এই অবস্থাটাকে এখনও বদলাতে পারেন। সন্ত্রাস বন্ধ করেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটা প্রকাশ্য বিতর্কের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। সন্তোষ রাণা।আশমিরা বেগমের চোখ দুটো স্থির চেয়ে আছে। সে চোখে প্রশ্ন, রাজনীতি করাটা কি এত বড় অপরাধ যে খুন হতে হবে? গণতন্ত্রের মানে কী, যদি বিরোধিতার স্থান সেখানে না থাকে? বর্ধমানের কেতুগ্রাম নানা কারণে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share:

আশমিরা বেগমের চোখ দুটো স্থির চেয়ে আছে। সে চোখে প্রশ্ন, রাজনীতি করাটা কি এত বড় অপরাধ যে খুন হতে হবে? গণতন্ত্রের মানে কী, যদি বিরোধিতার স্থান সেখানে না থাকে? বর্ধমানের কেতুগ্রাম নানা কারণে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। কিন্তু এ বারে সেটা উঠে এল আক্রান্ত গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে, আনখোনা গ্রামের সিপিএম কর্মী আশমিরা বেগমের হত্যার ভিতর দিয়ে।

Advertisement

এ বারের লোকসভা নির্বাচনের আগে শাসক দল মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায় হুলিয়া জারি করেছিল, যাতে এলাকার মানুষ যেন তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারেন। নির্বাচন কমিশনের ‘নির্ভয়ে ভোট দিন’ আহ্বান একটা নিষ্ঠুর রসিকতা হয়ে থাকল। তা সত্ত্বেও কিছু এলাকায় মানুষ সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়িয়ে ভোট লুঠ আটকে দিয়েছিলেন। আশমিরার সাহসী নেতৃত্ব কেতুগ্রাম ১ নং ব্লকের ১৩ নম্বর বুথে যে ভোট হয়, তাতে সিপিএম এবং তৃণমূল ভোট পায় যথাক্রমে ৩২৪ ও ২১৯। অতঃপর আশমিরার বাড়ি আক্রান্ত হয়, তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর সন্তানরা মাতৃহারা হল, পরিবারের ক্ষতি অপূরণীয়। বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল ভারতীয় গণতন্ত্র।

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকেই মধ্য বাংলার কিছু নেতা খোলাখুলি ঘোষণা করেছেন যে, শাসক দলের বিরুদ্ধে কাউকে প্রার্থী হতে বা ভোট দিতে দেওয়া হবে না। কেউ যদি তবু কথা না শোনে, তা হলে তার লাশ ফেলে দেওয়া হবে। হুমকিটা বাস্তবায়িত হয়, বীরভূমের পাড়ুই থানার বাঁধনর গ্রামে সাগর ঘোষ খুন হন। হত্যায় প্রত্যক্ষ ভাবে উস্কানি দেওয়া নেতাদের সংযত করা তো দূর, তাদের পিঠ চাপড়ানি দেওয়া হল। স্বভাবতই, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে লোকসভা নির্বাচনের কাল পর্যন্ত এবং তার পরেও রাজ্য জুড়ে বিরোধী দলগুলির কর্মী-সমর্থকদের উপর যে সন্ত্রাস, আক্রমণ ও হত্যা চলছে, এবং যার শিকার হচ্ছেন প্রধানত গরিব মানুষ, তার দায়িত্ব বর্তায় রাজ্য সরকারেরই উপর। এখনও পর্যন্ত বামফ্রন্টই রাজ্যে প্রধান বিরোধী হওয়ায় আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। লোকসভা নির্বাচনের পর কিছু মানুষ, প্রধানত নিরাপত্তার কারণে, বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

Advertisement

সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে যে, বহু বুথে শাসক দল একাই প্রায় সব ভোট পেয়ে গেছে। এটা রাজ্যবাসীর রাজনৈতিক মতামতের প্রতিফলন যে নয়, সেটা মোটামুটি ভাবে জনমানসে স্বীকৃত। সংবাদমাধ্যমে ছবি উঠে এসেছে, শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে রাজ্যের নির্বাচনে গোবলয়ের অধুনা পরিত্যক্ত সংস্কৃতি আমদানি করলেন। ২০০৯ ও ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন যে ভূমিকা পালন করেছিল, ২০১৪-তে তার কণামাত্রও দেখা গেল না। এই দখলদারি ছাড়াও তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতত, কিন্তু সেটা ৩৪-এ পৌঁছত কি না, বলা কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, যারই হার-জিত হোক না কেন, এখানে হারানো হল গণতন্ত্রকে, কেড়ে নেওয়া হল মানুষের মৌলিক অধিকার। ভীতি প্রদর্শন ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভোটকে প্রভাবিত করা পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কেশপুরে সিপিএম প্রার্থী যে লক্ষাধিক ভোটে জিতেছিলেন, সেটাকে কেউই স্বাভাবিক ভোটের প্রতিফলন বলতে পারেন না। সেই সময় সিপিএম নেতৃত্বও দুষ্কর্মপারঙ্গম কিছু লোককে ‘পার্টির সম্পদ’ বলে তাদের রক্ষা করেছিলেন। আমি যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, সেই সিপিআই(এমএল)-এর বহু নেতা ও কর্মী, এমনকী সাধারণ সমর্থকরাও বারংবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন, অনেকে খুন হয়েছেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বহু লোককে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে, বহু মানুষ বহু দিন ঘরছাড়া থেকেছেন। শাসক বামরা সে সময় যা করেছিল, সেগুলো ছিল ঘোর অন্যায়। কিন্তু সেই অন্যায়কে সাক্ষী মেনে নতুন অন্যায়গুলোকে যুক্তিসিদ্ধ করার যে প্রবণতা সমাজের একটা অংশে দেখা যাচ্ছে, সেটাও অন্যায়গুলোর মতোই অন্যায়।

দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্টের অন্যায়গুলো পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মেনে নেননি। ২০০৯ বা ২০১১ সালে তৃণমূলের জয় দলটির একক শক্তিতে আসেনি— পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ এই নির্বাচনগুলোতে অগণতন্ত্র ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এমন এক পরিবেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজস্ব বিচারশীলতা প্রয়োগ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন বা বিরোধিতা করতে পারবে; শাসকের সঙ্গে মতভিন্নতার কারণে আশমিরা বেগমদের প্রাণ দিতে হবে না, বিরোধী দলগুলোর পার্টি অফিস দখল হয়ে যাবে না, বা তাদের সমর্থকদের ঘরছাড়া হতে হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বামফ্রন্টের সন্ত্রাসের চেয়ে বহু গুণ বড় হয়ে নেমে এসেছে তৃণমূলের সন্ত্রাস; বামফ্রন্ট কুকর্ম ও অনাচার শুরু করে রাজত্বের মধ্যভাগে, তৃণমূল গায়ের জোরে বিরোধিতা নির্মূল করা এবং গলা টিপে বিপরীত কণ্ঠস্বরগুলোকে রুদ্ধ করাকেই তার শাসনের ভিত্তি করে তুলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের লোকসাধারণের সমস্যার শেষ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের, কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতার, পানীয় জল ও সাফাই ব্যবস্থার, লিঙ্গবৈষম্য ও নারীদের উপর অত্যাচার থেকে হাজারো সমস্যা সমাজকে উৎপীড়িত করছে। এ রাজ্যের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের, আরও এক-চতুর্থাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু; এঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো আরও গভীর ও জটিল। এক কথায়, সমাজে ন্যায্যতার দাবি পূরণে এখনও বহু পথ এগোনো বাকি।

এখন, আমরা কোন পথে এগোব? জঙ্গলমহলে সর্বজনীন ভাবে দু’টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার যে ব্যবস্থা, তা সম্প্রসারিত করা হবে, না সংকুচিত করা হবে, জিন-পরিবর্তিত বীজ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিষয়ে কী করা হবে, মিড-ডে মিল, আইসিডিএস, একশো দিনের কাজের মতো সামাজিক প্রকল্পগুলোকে জোরদার করা হবে না কি সেগুলো সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বিত্তশালীদের মধ্য থেকে উঠে আসা বিরোধিতাটিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে, কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক ও অন্যান্য সম্পর্কগুলো নিয়ে কী ভাবে এগোনো হবে, সিঙ্গুরে পড়ে থাকা জমি নিয়ে কী করা হবে, পাহাড়ের সমস্যা বা উত্তরবঙ্গের ভাষা-সংস্কৃতির সমস্যা, জঙ্গলমহলের অগ্রগতি নিয়ে কী ভাবে এগোনো হবে, ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চাকরিও শিক্ষাতে সংরক্ষণের বিষয়টা নিয়ে কোন পথে যাওয়া হবে— এ রকম বহু বিষয় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে। কিন্তু তার জন্য দরকার জনসাধারণের মধ্যে নির্ভীক খোলামেলা বিতর্ক। আমরা জানি, শুধুমাত্র নির্বাচনী গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অনুশীলন সফল হয় না, তার জন্য প্রকাশ্য আলোচনা একটা বড় ব্যাপার। যেখানে ভোটটাই এত নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত, সেখানে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ লোকসাধারণের কাছে কতটুকু থাকছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হতে বাধ্য। মানুষের মাথার উপর যদি প্রাণঘাতী হুমকির খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়, তা হলে সুস্থ ও ওয়াকিবহাল বিতর্ক চলতে পারে না।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী চাইলে অবস্থাটা এখনও বদলাতে পারেন। তিনি যদি প্রশাসনকে নির্দেশ দেন যে, বিরোধীদের উপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে, তা বন্ধ হওয়া সম্ভব। সন্ত্রাস বন্ধ করেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটা প্রকাশ্য বিতর্কের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। তিনি সেটা করবেন, না কি গণতন্ত্রনাশী সন্ত্রাস ও বিরোধী-ঘাতক নীতি নেবেন, সেটা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। এ মুহূর্তে আশমিরা বেগমের চোখ দুটো শুধু মুখ্যমন্ত্রী নয়, গোটা সমাজটাকে প্রশ্ন করছে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা হবে, না কি দলে দলে দরিদ্র, অসহায়, বিরোধী মতাবলম্বীদের উপর অত্যাচারের মাধ্যমে তার বিনাশকে নিষ্প্রতিবাদে মেনে নেওয়া হবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement