অঙ্গনওয়াড়ি। দুবরাজপুর, বীরভূম। ডিসেম্বর ২০১২। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
মাসে মাসে রিপোর্ট জমা পড়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের। বছর ফুরোলে অবশেষে সব রিপোর্ট একজোট করে সালতামামি। ক্যালেন্ডারি বছর আর আর্থিক বছরের হিসেবনিকেশ এক নয়, তবু নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন এড়ানো যায় না যে, এই সদ্য চলে যাওয়া দু’হাজার চোদ্দোর বছরটায় রিপোর্টের খতিয়ানের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমরা কী পেলাম এবং কী দিলাম। গ্রামীণ মানুষজনের সার্বিক স্বাস্থ্যের হাল কতখানি উন্নত হল। ২০টা জেলা মিলিয়ে ৩৪৩টি ব্লক আর পঞ্চায়েত সমিতি এ রাজ্যে। গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ৩৩৫৭। ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী থাকার কথা ছিল মোট ১৩১৮৬টি সাব-সেন্টার, কিন্তু আমরা পেয়েছিলাম ১০৩৫৬টি; প্রস্তাবিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২১৬৬, কিন্তু গড়ে উঠেছিল ৯০৯টি। অথচ, যথেষ্ট সংখ্যায় চিকিত্সাকেন্দ্র না থাকলেও, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা যেখানে প্রস্তাবিত ছিল ১১২৬৫, সেখানে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল ১২৯৬৬ জন কর্মীকে! অন্তত এমনটাই জানা যাচ্ছে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন দ্বারা প্রকাশিত তথ্য থেকে।
স্বচ্ছ ভারত ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য
আগামী ২০১৯ সালে পালিত হবে গাঁধীজির জন্মের সার্ধশতবর্ষ। লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে: তার মধ্যেই সমস্ত বাড়ি, চিকিত্সাকেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি ও স্কুলগুলোতে হাত ধোয়ার ও পানের জন্য যথেচ্ছ জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। যে-সব বাড়িতে এখনও শৌচালয় নেই, সেখানে আইএইচএইচএল (ইন্ডিভিজুয়াল হাউসহোল্ড ল্যাট্রিন) পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি বাড়ি বাবদ শৌচালয় তৈরি ও নিত্যব্যবহার্য পরিস্রুত জল সরবরাহের জন্য দশ থেকে বারো হাজার টাকা দেওয়া হবে। উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, চিকিত্সাকেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি বা স্কুলে পাইপলাইন অথবা জলাধার তৈরিই আছে, তবু মাসের পর মাস কল থেকে জল পড়ে না। কর্মীরা অভিযোগ জানিয়েছে, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। বাধ্যত শিশুরা নিকটবর্তী পুকুরের জলে হাতমুখ ধুচ্ছে, যেখানকার জল যারপরনাই নোংরা। এই ভাবে ডেকে আনছে পেটের, এমনকী ত্বকের সংক্রমণও। যে-সব বাড়িতে ব্যক্তিগত শৌচালয় এখনও নেই, তাদের প্রসঙ্গ ছেড়েই দিলাম। যাদের আছে, তারাও শুধুমাত্র অ-সচেতনতার কারণে মাঠেঘাটে প্রাতঃকৃত্য সম্পাদন করছে। এতে নিজেও যেমন কৃমির সংক্রমণের শিকার হচ্ছে, তেমনই আশেপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে রোগব্যাধি। যথেষ্ট জ্ঞান নেই, সুযোগেরও অভাব, ফলে মহিলারা পুকুরের নোংরা জলে স্নান করছেন আর দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণে ভুগতেই থাকছেন। সুতরাং, শৌচালয় নির্মাণই শেষ কথা নয়, সমান জরুরি সে-সবের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য-সচেতনতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আরও আরও ওয়াকিবহাল করা।
শিশুস্বাস্থ্য ও অপুষ্টি
এই সব প্রকল্প অনুসারে সরকারি ও আধাসরকারি স্কুল এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শূন্য থেকে আঠারো এবং দশ থেকে উনিশ বছরের সমস্ত শিশুর যথাযথ স্বাস্থ্যপরীক্ষা, রোগনির্ণয় ও পরবর্তী পর্যায়ে নির্দিষ্ট আটত্রিশটি অসুখের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিখরচায় চিকিত্সার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের দেওয়া হচ্ছে সাপ্তাহিক আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টেশন ও ষাণ্মাসিক অ্যালবেনডাজোল ট্যাবলেট। তার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে যৌন সচেতনতার প্রাথমিক পাঠ, মাদকদ্রব্যের অপকারিতা সম্পর্কিত শিক্ষাও। এত সব সুযোগ সত্ত্বেও পরিবহণ সুবিধালাভের জন্য পৌঁছতে পারছে না দূরবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে। শৌচালয় না ব্যবহার করা, খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটা, কাঁচা শাকসব্জি খেয়ে ফেলা ইত্যাদির ফলে উপর্যুপরি কৃমির সংক্রমণকে কতখানি রুখতে পারছে বছরে দু’বার কৃমির ওষুধ? ক্রমাগত আয়রনের অপ্রতুলতায় ভুগতে থাকা বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েগুলোকে কতটুকু সারিয়ে তুলছে সাপ্তাহিক আয়রন বড়ি? উপরন্তু সেই সব ওষুধ প্রয়োগেও তো শিক্ষক অথবা স্বাস্থ্যকর্মীদের বিবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এখনও! সার্বিক ভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে শিশু-কিশোরদের খাদ্যাভ্যাস। যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পৌঁছয়নি, সেখানেও শিশুদের হাতে পৌঁছে গেছে পটেটো চিপসের প্যাকেট। যেখানে মা তার শিশুকে এক বেলা মাছ খাওয়াতে অক্ষম, সেখানেও ভোরবেলা তাকে প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে দু’মিনিটের নুডলস। আর কে না জানে, বিপণনের দুনিয়ায় চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুটির অভিভাবকের কাছেও স্বাস্থ্যকর্মীদের ফ্রি-তে দেওয়া নিউট্রিমিক্স-এর চেয়ে অনেক বেশি ভরসাযোগ্য বাজারচলতি নামী হেলথ ড্রিংক! অত্যাবশ্যকীয় কিছু খাদ্যোপাদান, যা অনায়াসে পাওয়া যেতে পারে রোজকার খাবার থেকেই, সে সবের জন্য আধপেটা খাওয়া কৃষক-শ্রমিক বাবাও অযথা দৌড়ে যাচ্ছে লিভার টনিক অথবা ভিটামিন সিরাপের উদ্দেশ্যে। রাজ্যে কমবেশি ৪০ শতাংশ বিদ্যার্থী এই মুহূর্তে কম ওজন ও রক্তাল্পতার শিকার। এই পরিসংখ্যান বেশ ভীতিপ্রদ বলেই মনে হয়।
মা ও শিশুর সুরক্ষা
সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী এক জন প্রসূতি মায়ের গর্ভধারণের প্রথম দিন থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত ১) স্বাভাবিক প্রসব, ২) সিজারিয়ান সেকশন, ৩) যে কোনও রকম ওষুধপত্র, পরীক্ষানিরীক্ষা ও প্রয়োজনে রক্ত দান, ৪) হাসপাতালে থাকাকালীন খাওয়াদাওয়া, ৫) হাসপাতালে যাওয়া ও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসার খরচ, ৬) রেফারাল-এর ক্ষেত্রে অন্য হাসপাতালে যাওয়া, সমস্তটাই বিনা খরচে হয়। অসুস্থ সদ্যোজাতের ক্ষেত্রে জন্মের পর ৩০ দিন পর্যন্ত সমস্ত চিকিত্সার সুবিধাও নিখরচায় দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের লক্ষ্য: ১) দেশের সার্বিক প্রসবের হার কমিয়ে ২.১-এ নিয়ে আসা, ২) মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে প্রতি ১ লাখে ১০০-য় নিয়ে আসা, ৩) সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার কমিয়ে প্রতি ১ হাজারে ২৫-এ নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে পিছিয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, অসম, রাজস্থান, ওড়িশা, জম্মু-কাশ্মীরের মতো ‘লো পারফর্মিং স্টেট’গুলো। ফলত এ সব রাজ্যে জননী সুরক্ষা যোজনা অনুযায়ী প্রসব সংক্রান্ত নির্ধারিত অর্থের পরিমাণও অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কিঞ্চিত্ বেশি। শেষ আর্থিক বছরের রিপোর্ট দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে ১) প্রসবের হার ১.৮, ২) মাতৃমৃত্যুর হার ১৪৫, ৩) সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার ৩১— যা সমগ্র ভারতের বর্তমান অবস্থার তুলনায় অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। তবে, এই কার্যক্রম চালু হওয়ার সাড়ে তিন বছর পরেও এ রাজ্যের ১০০ শতাংশ প্রসূতিকে আশা-কর্মীরা যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যমী করে তুলতে পারছেন না। কেন এই ব্যবধান? ধর্মীয় কুসংস্কার, অশিক্ষা, পরিবহণ সংক্রান্ত অসুবিধা, সবই বোধ করি এর পিছনে দায়ী। ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য প্রদানের পরেও কি বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা গেছে এ রাজ্যে? মাদ্রাসার ছাত্রীদের আরও বেশি বিদ্যালয়মুখী করে তোলার জন্য একটি করে সাইকেল দেওয়ারও সুবন্দোবস্ত আছে। তবু আটকানো যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ আর অপ্রাপ্তবয়সে সন্তানধারণের প্রবণতা। বেসরকারি রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ সালে এ রাজ্যে মোট মেয়েদের বিবাহের প্রায় ৫৪ শতাংশই ছিল বাল্যবিবাহ। এ সবই মা ও শিশুর মৃত্যুর হার কমানোর পরিপন্থী হয়ে থাকছে আজও।
ফ্যামিলি প্ল্যানিং বিষয়ে একগুচ্ছ সরকারি নির্দেশিকা রয়েছে। সে সব মেনে প্রতিটি ঘরে ঘরে এখনও কিন্তু পরিবার পরিকল্পনার বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। বা গেলেও সে-সব মানছে না অনেকেই। সপ্তম কিংবা অষ্টম সন্তান প্রসব করে মা আর বাচ্চা উভয়েই চরম অপুষ্টিতে ভুগছে, ২০১৪ সালেও শহর কলকাতার মাত্র ত্রিশ কি চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এ হেন ঘটনার উদাহরণ কিন্তু আদৌ বিরল নয়! অতি সম্প্রতি ছত্তীসগঢ়ে একটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং ক্যাম্পে একসঙ্গে ১৩ জন মহিলার মৃত্যু ঘটল। জানা গেল, ভুল ওষুধ প্রয়োগের ফলে এই বিপত্তি। এক দিকে যখন পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে এমনিতেই মহিলারা সচেতনতার অভাবে ভুগছে, তখন এ জাতীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য অপরাধ তাঁদের আরও বেশি দিগ্ভ্রান্ত আর পথভ্রষ্ট করে তুলবে না কি?
‘পোলিয়োমুক্ত’ ভারত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও ১০টি দেশ সমেত এ দেশকে পোলিয়োমুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিল। ভারতের শেষ রিপোর্টেড কেসটি নথিভুক্ত হয় এ রাজ্যেরই হাওড়া জেলায়, ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারিতে। অতঃপর গত তিন বছরে আর কোনও ‘অ্যাকিউট ফ্লাসিড প্যারালিসিস’-এর ঘটনার কথা এ দেশে জানা যায়নি। অবশ্যই আমরা সাফল্যের পথে এক ধাপ এগোলাম। অবশ্যই আমরা এখন পৃথিবীর সেই ৮০ শতাংশ মানুষের মধ্যে পরিগণিত হই, যারা স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত পোলিয়োমুক্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। তবে, গ্রামে গ্রামে পোলিয়ো প্রতিষেধক প্রত্যাখ্যানের ঘটনার ঘনঘটায় কেস রিপোর্টেড না-হওয়া মানেই যেমন একবাক্যে পোলিয়ো মায়লাইটিস না-হওয়া নয়, তেমনই ২০১৪-র পোলিয়োমুক্ত ভারত মানেই পোলিয়ো প্রোগ্রামের পরিসমাপ্তি, এমনটাও কিন্তু নয়। বলা যেতে পারে, এটা একটা মধ্যবর্তী পর্যায়, যখন আমরা ‘জীবনের জন্য দু’ফোঁটা’কে সাফল্যের সোপান হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছি। ফলে আগামী ২০১৫-র শেষে ভারত সমেত ১২০টা দেশ ‘ওরাল পোলিয়ো ভ্যাকসিন’ বন্ধ করে ‘ইঞ্জেকটেবল পোলিয়ো ভ্যাকসিন’ চালু করতে পারবে, এমনটাই আশা। সমস্তটা নিয়মমাফিক চললে হয়তো ২০১৮ সালে পৌঁছে গোটা বিশ্বই পোলিয়োমুক্ত হয়ে উঠতে পারবে।
এ সমস্তই আসলে ‘টার্গেট’, যাকে সামনে রেখে আমরা টেবিলের দু’প্রান্তে বসা মানুষরা, মানে রোগী ও ডাক্তার, জনগণ ও স্বাস্থ্যকর্মী, ভোটার ও ভোটপ্রার্থীরা স্বপ্ন দেখে চলেছি নিরন্তর। কখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ হলে নারী-পুরুষের অনুপাত সমান হবে, রোধ করা যাবে বাল্যবিবাহ, আর কোনও শিশু অপুষ্টিতে মারা যাবে না, মাইলের পর মাইল রাস্তা পেরোতে পেরোতে আর কোনও প্রসূতি সন্তান প্রসব করবে না লাল মাটির ধুলোয়, এমন একটা সমাজের প্রত্যাশায় ভোর-ভোর উঠে গোলাপি দেওয়ালে টাঙিয়ে ফেলব শুধু ওষুধ কোম্পানির নতুন ক্যালেন্ডার। নতুন বছরটা এখনও নতুন। আশায় বাঁচি আমরা।