কঠোর আইনের দাবিতে। দিল্লিতে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সামনে। অগস্ট ২০১৩।
অপরাধের তারতম্যে নাবালককে সাবালক বলা যায়, না কি নাবালকের সংজ্ঞাটাই কিছুটা বদলানো দরকার এই নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক চলছে গত কয়েক বছর ধরে। বলে নেওয়া ভাল, বর্তমান আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত নারী ও পুরুষকে নাবালক গণ্য করা হয়। এই প্রেক্ষিতে গত ৬ অগস্ট লোকসভায় নাবালকদের বিচারের প্রকরণ, জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (জেজেএ) ২০০০-এ বেশ কয়েকটি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। তার একটা সংশোধনী, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সি কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ খুন-ধর্ষণ-পাচার-অ্যাসিড ছোড়ার মতো কোনও গর্হিত ও হিংস্র অপরাধে অভিযুক্ত হলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড স্থির করবে তাকে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো সাধারণ আদালতে পাঠানো হবে না, ওই বোর্ড তার বিচার করবে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে গণধর্ষণের কুখ্যাত ঘটনায় সবচেয়ে হিংস্র আঘাত হেনেছিল যে, বিচার চলার সময় প্রকাশ পেল সে নাবালক, তাই অন্যেরা প্রাণদণ্ড পেলেও সে একটি হোমে গেল। ৩৬ মাস সংশোধনের অধীনে থাকতে হবে, তার মধ্যে বিচার চলাকালীন সময়টুকু ছাড় পাবে। তখন থেকেই দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভাবনা সরব হতে থাকল যে, জেজেএ-র অপব্যবহার হচ্ছে, গর্হিত কাজ করেও অপরাধী ‘নাবালক’ বলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধনের দাবি উঠল। এর পর মুম্বইয়ের পরিত্যক্ত শক্তি মিল্স-এ চিত্রসাংবাদিক ও পরে টেলিফোন অপারেটরের গণধর্ষণ সামনে আসার পর দেখা গেল, সেখানেও সবচেয়ে হিংস্র নিগ্রহকারী নাবালক।
সমাজের দাবি
এর পর প্রাপ্তবয়স্কের অপরাধ-এ অভিযুক্তের কেন অপ্রাপ্তবয়স্কের উপযোগী সাজা হবে, তা নিয়ে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মতামত দিতে থাকলেন। তাই এই সংশোধন সত্যি যুক্তিসঙ্গত, না কি তা ‘ধর্ষণে ফাঁসি চাই’ বা ‘৪৯৮এ ধারা মেয়েরা অপব্যবহার করে, অতএব বাতিল হোক’ ধাঁচের বাজারি দাবির কাছে রাজনীতিবিদদের নতিস্বীকার তা নিয়ে প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন অব্যাহত।
যাঁরা এই সংশোধনীর বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বক্তব্য ভারত সরকার ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু অধিকার সনদে (সিআরসি) স্বাক্ষর করেছে, যার মূল কথাটাই হল: আঠারোর নীচে সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। সুতরাং তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই ধরতে হবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিচারপ্রক্রিয়ার তাদের শামিল করা যাবে না। কিন্তু সেই সনদের ৪০.১ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক দেশের আইন ভাঙলে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে যে কোনও অন্য ব্যক্তির মতোই, রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যে অভিযুক্ত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সে সব আইনি ও প্রশাসনিক সুরক্ষা পাবে। সিআরসি এমনকী বেজিং রুল বা রিয়াধ গাইডলাইন, যা নাবালকদের অধিকারকে সুরক্ষিত করছে, তাতেও কোথাও বলা হয়নি যে, গর্হিত অপরাধে কোনও নাবালককে সাধারণ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো যাবে না। বরং যেটা বলা হয়েছে তা হল, সব দেশ একটা বয়সসীমা স্থির করবে, যার নীচে কোনও নাবালক শাস্তিযোগ্য অপরাধ করতে পারে না। সেই বয়সটা দশ হতে পারে, চোদ্দো হতে পারে। তা-ই যদি হয়, তবে ষোলো হলে আপত্তি উঠবে কেন?
নাবালক ও গর্হিত অপরাধ
এই নিয়ে বিতর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী বললেন, এখানে ধর্ষণের ৬০ শতাংশ করে অপ্রাপ্তবয়স্করা। তারা জানে জেজেএ-তে তারা ছাড় পেয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনের সভানেত্রী মমতা শর্মা বললেন, ৪৫ শতাংশ ধর্ষণ করে নাবালকরা। এঁরা এই তথ্য কোথায় পেলেন জানা নেই। কারণ এনসিআরবি-র ২০০১-১২ সালের তথ্য বলছে, সমস্ত অপরাধের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্করা করেছে এ রকম ঘটনা দুই শতাংশের নীচে থাকে। আর ২০১৩ সালে মোট ধর্ষণের ঘটনার ছ’শতাংশ ঘটিয়েছিল অপ্রাপ্তবয়স্করা। তবে ২০০১ সালে ৩৯৯ থেকে ২০১১তে ১১৪৯, ২০১২তে ১৩১৬ এবং ২০১৩ সালে ২০৭৪ ধর্ষণের ঘটনায় অপ্রাপ্তবয়স্কদের যুক্ত থাকা ও এই হারে বৃদ্ধি অবশ্যই চিন্তাজনক। তবে এই পরিসংখ্যান সম্বন্ধে একটা কথা খেয়াল রাখা ভাল। কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে কোনও সমবয়সি মেয়েকে নিয়ে পালালে, সেটা সম্মতির ভিত্তিতে হলেও মেয়েটির অভিভাবক ছেলেটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রুজু করিয়ে থাকতে পারেন, এই সম্ভাবনা পুরো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আবার, এটাও ঠিক যে, আমেরিকায় আশির দশক থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের অপরাধের সংখ্যা মোট অপরাধের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে বলে তারা নব্বইয়ের দশক থেকে ‘শক্ত হাতে দমন করো’ নীতি নিয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও সাধারণ আদালতেই বিচার হচ্ছে। তথ্য বলছে, আমাদের দেশে এখনও সে রকম চিন্তার কারণ ঘটেনি। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সনদে সই করেনি, কাজেই ভারতের মতো তাকে নিজের দেশে চেপে ধরার অবকাশ কম। কিন্তু সনদে স্বাক্ষরকারী ও যথেষ্ট উদার ইংল্যান্ডে দশ থেকে আঠারো বছর বয়সিদের জন্য ইউথ কোর্ট থাকলেও অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে তা ক্রাউন কোর্ট বা দায়রায় (যে অপরাধের সাজা সাত বছর বা তার বেশি) সোপর্দ করা হয়। এমনকী ‘সাধারণ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক’ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলে আদালত তাকে দীর্ঘ কারাবাসের নির্দেশও দিতে পারে, যদিও তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে এ দেশে আপত্তি কেন?
আমাদের দেশে জেজেএ আসার আগে ছেলেদের বয়স ষোলো আর মেয়েদের আঠারো হলে তাদের অভিযুক্ত বলে সাধারণ আদালতে বিচারের প্রক্রিয়ায় পাঠানো হত। ২০০০ সালের পর থেকে তা বদলাল, আবার এই সংশোধনীর পরে বোর্ড বললে তারা সাধারণ আদালতে যাবে। মার্কিনি অভিজ্ঞতা বলছে, সাধারণ আদালতে বিচার হলে তাদের আবার অপরাধের সম্ভাবনা বাড়ে। ভারতে সে ধরনের সমীক্ষা প্রায় নেই। তবে তিহাড় জেলের অভিজ্ঞতা বলছে, যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সাজা খেটেছে, তাদের বড়জোর পনেরো শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সাজা খাটতে ফিরে এসেছে। কিন্তু কারাগারে গেলে অপ্রাপ্তবয়স্করা পাক্কা অপরাধী হিসেবে বেরিয়ে আসবে, সংশোধনাগারে তাদের সংশোধনের, তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মনটাকে শিক্ষা, কাউন্সেলিং ইত্যাদি দিয়ে নানা ভাবে প্রভাবিত করার যে অবকাশ থাকে, সেটা আর পাওয়া যাবে না, এটা শিশু অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। তাঁরা বলছেন, সরকার মেয়েদের বা সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ঘাড়ে বন্দুকটা রাখল, যাতে ভোটদাতাদের সন্তুষ্ট করা যায়। এই ভাবে মেয়েদের অধিকার আর অপ্রাপ্তবয়স্কদের অধিকার মুখোমুখি লড়িয়ে দেওয়া হল। তাই জনতার প্রবল দাবি সত্ত্বেও তাঁরা আরও আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন। তবে যে দেশে ৮১৫টি সংশোধনাগারে বড়জোর ৩৫,০০০ অপ্রাপ্তবয়স্ককে রাখার ব্যবস্থা আছে, সেখানে যদি সতেরো লক্ষ বন্দি থাকে, সে দেশ অপ্রাপ্তবয়স্কদের সংশোধনে কত কম গুরুত্ব দেয়, বোঝাই যায়।
আর একটা কথা। জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড স্থির করবে কাকে সাধারণ আদালতে পাঠানো যাবে, কাকে সংশোধনাগারে। এক একটা বোর্ড তো এক এক রকম ভাবে ভাবতে পারে, ফলে ধরা যাক একই অপরাধে কেউ এক জেলার বোর্ডের সামনে পড়েছে বলে সাধারণ আদালতে গিয়ে দশ বছরের কারাবাস করল আর কেউ আর এক জেলার বোর্ডে পড়েছে বলে তিন বছর সংশোধনাগারে থেকে বেরিয়ে এল। বোর্ডের সদস্যদের মানসিকতা কী হবে, তার তো কোনও গাইডলাইন নেই, অপ্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক পরিপক্বতা বা অপরাধপ্রবণতা মাপার কোনও মাপকাঠিও নেই। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মন চারিদিকের ঘটনা আর তার প্রচারে হয়তো একটু বেশি দ্রুত পরিণতি পাচ্ছে। তাই তারা হিংস্র গর্হিত অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়লে তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক, কিন্তু তাদের বিচার হোক সাধারণ আদালতেই।