কালিম্পঙের কুলি বস্তি থেকে মিউনিখের রিখার্ড স্ট্রাউস মিউজিক কনজার্ভেটরি পৌঁছতে কুশমিতা বিশ্বকর্মার সময় লেগেছিল ১৩ বছরের বেশি। নয়তো ওর বাবা-মায়ের মতো কুশমিতাও হয়তো বড় হয়ে ২৫ টাকা রোজের কুলি হত চা-বাগানে। তার বদলে এখন নুয়ের্নব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে মিউজিকে মাস্টার্স করছে। জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরের অর্কেস্ট্রায় শিক্ষানবিশ হিসেবে বেহালা বাজাচ্ছে। প্রতিভা এবং প্রতিশ্রুতি, দুটোই কুশমিতার মধ্যে দেখছেন ওর মেন্টররা।
কুশমিতার এবং ওর মতোই আরও কয়েক জনের অবিশ্বাস্য এই যাত্রা হয়তো সম্ভব হত না, যদি না ফাদার এডওয়ার্ড ম্যগোয়ার নামে এক ধর্মযাজক পাহাড়ের গরিব কুলিমজুর ঘরের বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখাতে মেতে উঠতেন। যদি-না তাঁর তৈরি করা এমন একটা স্কুল থাকত, যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদের বেহালা বাজাতেও শেখানো হয়। কুশমিতা মায়ের কাছে গল্প শুনেছে, ফাদার ম্যগোয়ার তাঁর গাঁধী আশ্রম স্কুলের জন্য ছাত্রছাত্রীর খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন চা-বাগানের কুলি-কামিনদের বস্তিতে। এক দিন তিনি এসে কুশমিতার বাবা-মাকে বলেন পর দিন থেকে ওকে স্কুলে পাঠাতে। ফ্রি স্কুল। পয়সা লাগবে না।
কথাটা শুনে কুশমিতার বাবা-মা দু’বার ভাবেননি। ওঁদের নিজেদের অক্ষরপরিচয় হয়নি। চা-বাগানে কুলিগিরি করে কোনও মতে দিন গুজরান। তিন মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবতেও পারতেন না। কিন্তু কুশমিতা তখনও খুবই ছোট, প্রথম দিন স্কুলে এসে হাঁ-হাঁ করে কাঁদছিল। কান্না থামাতে ফাদার প্রথম দিনেই ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন একটা বেহালা। সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া, টুংটাং করতে করতেই কান্না থেমে গিয়েছিল। কিছু দিন পর থেকে কুশমিতা স্কুলে পৌঁছেই দৌড়ে চলে যেত অ্যাসেম্বলি ঘরের যে আলমারিটায় বেহালা রাখা, সেখানে। আস্তে আস্তে বেহালায় সুর তুলতেও শিখে যাচ্ছিল ও।
কী সুর, কী গান? চলতি হিন্দি সিনেমার গান, নেপালি গান। কুশমিতার মায়ের খুব প্রিয় নেপালি শিল্পী গোপাল নারায়ণের গান। তখন ওদের পরিবারে একটাই বিনোদন—রোজ সন্ধেবেলা রেডিয়ো শোনা। একটা ভাঙাচোরা রেডিও ছিল বাড়িতে, যেটা প্রায়ই খারাপ হত আর ওর বাবা বসে বসে সেটা সারাতেন! এমন হত, আগের সন্ধেয় যে-গান রেডিয়োতে শুনল, পর দিন সেই সুরটা বেহালায় তোলার চেষ্টা করত কুশমিতা। খুব চেষ্টা করতে হত না। কারণ, সুরটা নাকি ওর ভিতরেই থাকত। কে শেখাতেন ওকে? গাঁধী আশ্রম স্কুলের মিউজিক টিচার রুদ্রমণি বিশ্বকর্মা।
জীবনের প্রথম মাস্টারমশাই রুদ্রমণি বিশ্বকর্মাকে কুশমিতা মনে করে ‘মোৎসার্ট অব দ্য হিমালয়াজ’! কারিগরির দেবতার নাম ধার নিলেও, এই বিশ্বকর্মারা আসলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। রুদ্রমণিও সেই অন্ত্যজ সমাজ থেকেই উঠে আসা। সেটা ১৯৮০ সাল, ফাদার ম্যগোয়ার পড়াচ্ছেন দার্জিলিঙে সেন্ট রবার্টস স্কুলে। স্কুলের তখন কোনও হস্টেল ছিল না। ফলে ছুটির পর গোটা স্কুলবাড়িটা ফাঁকা, শুনশান। ফাদারের মনে হল, ওই ফাঁকা সময় এবং জায়গাটা কাজে লাগাবেন তিনি। দার্জিলিঙের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বখে যাওয়া ছেলেদের জোগাড় করতে শুরু করলেন তিনি। একটু শরীরচর্চা, একটু ইংরেজি পড়ানো, এর মধ্যেই তখন সীমাবদ্ধ ছিল সেই বিকেলের স্কুল।
এই সময় একটা মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা ঘটল। ফাদারের এক জার্মান বন্ধু ইয়োগেন কান, যিনি তখন ক্যালকাটা সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার কন্ডাকটর, তিনি এসেছেন দার্জিলিঙে। এক দিন ফাদারের বিকেলের স্কুলের ছাত্রদের বেহালা বাজিয়ে শোনালেন কান। ফাদার অবাক হয়ে দেখলেন, বাচ্চারা দুরন্তপনা ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেহালা শুনছে! বাজনা শেষ হতে ছেলেরা সবাই ভিড় করে এল। অনেকেই বেহালাটা ছুঁয়ে দেখতে চায়। আর দেরি করেননি ফাদার। কিনে এনেছিলেন আটখানা সেকেন্ড হ্যান্ড বেহালা। বিকেলে শরীরচর্চার পর শুরু হয়ে গেল বেহালার ক্লাস। সেই ছাত্রদেরই এক জন রুদ্রমণি বিশ্বকর্মা। ভবিষ্যতে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজের মিউজিক গ্র্যাজুয়েট, গাঁধী আশ্রম স্কুলের বেহালার মাস্টারমশাই।
কালিম্পঙের ছয় মাইলে গাঁধী আশ্রমে স্কুলের পত্তনটাও খুব অন্য রকম ঘটনা। দার্জিলিং ডায়োসেস-এর চালু করা সেন্ট রবার্টস স্কুলের পরিচালনভার মাঝে ছিল ‘সোসাইটি অব জিসাস’ সংস্থার হাতে। ১৯৯০ সালে তা আবার ডায়োসেসের হাতে ফিরে আসে। কিন্তু অন্য জেসুইট ফাদাররা দেখছিলেন, ফাদার ম্যগোয়ারের যত বন্ধুত্ব গরিব বাচ্চাদের সঙ্গে। তাই তাঁকে বলা হল নিজের মনের মতো করে একটা স্কুল তৈরি করতে। ১৯৯৪ সালে তৈরি হল সেই স্কুল। কোনও খ্রিস্টান সন্তের নামে নয়। ভারতে ৪০ বছর কাটিয়ে ফেলা ফাদারের প্রথম মনে হয়েছিল হরিজনদের বন্ধু মহাত্মা গাঁধীর কথা। গাঁধী আশ্রম স্কুলেও প্রথম দিন থেকেই নিয়ম, খুব গরিব ঘরের বাচ্চা ছাড়া কাউকে ভর্তি করা হবে না।
রুদ্রর কাছে কুশমিতা প্রথম যে ভায়োলিন কনচের্তোটা পুরো রপ্ত করেছিল, সেটা আন্তোনিও ভিভালডি-র ‘ফোর সিজনস’। ফাদার শুনেছিলেন কুশমিতার সেই বাজনা। সে দিন থেকে তিনি কুশমিতার সব থেকে বড় ‘ফ্যান’! কথাটা বলতে গিয়ে এখনও হেসে ফেলে কুশমিতা। সব কৃতিত্ব তার রুদ্র স্যরের। কিন্তু ফাদার তার পর থেকে ওকে মাথায় করে রাখতেন। ওকে নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। কুশমিতা নিজে মনে করে, ও জীবনে যতটুকু করতে পেরেছে, তার জন্য ওই দু’জনের কাছে ও ঋণী। ফাদার ম্যগোয়ার আর রুদ্রমণি বিশ্বকর্মা। পরে এসেছিল আরও এক জন। মার্গারেট ক্লাইন।
ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির সঙ্গে গাঁধী আশ্রম স্কুলের নিয়মিত সংযোগ রয়েছে। বছরভর বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের আসা-যাওয়া চলে। সে ভাবেই এসেছিল মার্গারেট। প্রথম দিনই কুশমিতার সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে যায়। মার্গারেট নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে, দেশে ফেরার সময় কুশমিতাকে ও সঙ্গে নিয়ে যাবে। সানন্দে মত দেন ফাদার। সেটা ২০০৪, কুশমিতার বয়স সবে ১৩। প্রথম দিন স্কুলে আসার মতোই ফের কাঁদতে কাঁদতে মার্গারেটের সঙ্গে জার্মানির প্লেন ধরে কুশমিতা। মন-খারাপের চোটে ভুলেই যায়, সাধের বেহালাটা সঙ্গে নেওয়া হয়নি! সেই পুরনো বেহালাটা ফাদার পরে মিউনিখের কাছে এডলিং গ্রামে মার্গারেটদের বাড়ি, কুশমিতার ‘সেকেন্ড হোম’-এর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ফাদার ভাবতেন, পাহাড়ের বাচ্চাদের সহজাত ক্ষমতা থাকে তাড়াতাড়ি পশ্চিমি সুর বাজাতে শেখার। বেহালা বা চেলোর মতো তারযন্ত্র ওরা দ্রুত আয়ত্তে আনতে পারে। সেটা সম্ভবত পাহাড়ে খ্রিস্টান সংস্কৃতির প্রসার এবং কয়্যার মিউজিকের প্রভাব, আর অন্য দিকে বহু বছর ধরে সাহেবসুবোদের ‘সামার রিসর্ট’ থাকার সুবাদে চেম্বার অর্কেস্ট্রার চল, কলোনিয়াল কেতার হোটেলে লবি মিউজিক। এর পাশাপাশি কমবয়সিদের মধ্যে এক ধরনের দো-আঁশলা অ্যাংলো সংস্কৃতি চর্চার প্রবণতা।
তবে চমৎকার বললেন কমল গুরুঙ্গ, ফাদার ম্যগোয়ারের আর এক ছাত্র, এখন গাঁধী আশ্রম স্কুলের মিউজিক টিচার। রুদ্রমণি গত বছর গাঁধী আশ্রম ছেড়ে কালিম্পঙেরই অন্য এক স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছেন। এখন বাচ্চাদের বেহালা শেখান কমল। তিনি বললেন, “আসলে পাহাড়ে গরিব মানুষের জীবন খুব কষ্টের। চড়াই-উতরাই বেয়ে ওঠা-নামা, সেই কোথা থেকে জল ভরে আনা, কাঠকুটো কুড়িয়ে নিয়ে আসা...গান আমাদের সেই কষ্ট কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দেয়। আমরা পথ চলতে চলতে গুনগুন করি, কাজ করতে করতে গান গাই। আর এখানকার প্রকৃতি এত সুন্দর, এত সবুজ, এত পাখি, চোখ মেললেই হিমালয়—সুর ছাড়া মাথায় আর কিছু আসে না। দিনভর সুরের সঙ্গেই আমরা থাকি।”
ফাদার নেই, কিন্তু গাঁধী আশ্রম স্কুল এখনও চলছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। নার্সারি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া যায়, তার পর যেতে হয় বড় স্কুলে। কিন্তু ভিতটাই এত পোক্ত করে গড়ে দেয় গাঁধী আশ্রম যে, অনেকেই নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার কথা লুকিয়ে বাচ্চাদের ভর্তি করতে চায় এখানে, হাসতে হাসতে বলছিলেন ফাদার পল, এখন যিনি স্কুলের দায়িত্বে। তবে কালিম্পঙের এই ছয় মাইল থেকে স্কুলকে সরিয়ে নিতে হবে নিরাপদ জায়গায়। যে এলাকাগুলো ‘সিঙ্কিং জোন’, হঠাৎ খসে পড়তে পারে, তেমনই একটা নড়বড়ে জায়গায় গাঁধী আশ্রম স্কুল। বছর তিনেক আগে সিকিমের জোরালো ভূমিকম্পে বিরাট ফাটল ধরেছে স্কুলবাড়িতে। কাজেই নতুন জায়গায় নতুন স্কুল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
সোমবার। শীতের সকালে ঘুম ছেড়ে স্কুলে আসতে হয়েছে বলে একটা বাচ্চারও মুখ গোমড়া নয়। পাহাড়ি ঢালের সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল ওরা। যেন দিব্যি একটা উচ্ছল পাহাড়ি ঝর্না। বা এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি। অতিথিদের দেখে নির্ভুল সহবতে সমস্বর ‘গুড মর্নিং’। জার্মানির ব্রেমেন শহর থেকে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এসেছে লিজা, স্কুলের পরীক্ষা শেষ করেই। ও গাঁধী আশ্রমের বাচ্চাদের পিয়ানো শেখায়। আমেরিকা থেকে এসেছে ২৬ বছরের যুবক নোয়া, নিচু ক্লাসের বাচ্চাদের বেহালায় হাত মকশো করায়। কচিকাঁচাগুলোর মহা ফুর্তি ওদের দেখে।
কে জানে, ওই ছেলেমেয়েদের মধ্যেই হয়তো আছে আরও কুশমিতা। ভাঙা ঘরে, শীতের রাতে, কম্বলের ওম গায়ে জড়িয়ে, কাঠের আগুনে সেঁকা গরম রুটির গন্ধে বুঁদ হয়ে যারা রোজ সন্ধেয় রেডিয়ো শোনে আর ভাবে, পর দিন সকালে স্কুলে গিয়েই বেহালায় তুলে ফেলতে হবে সুরটা।