কাব্য শুনিয়া পুলকিত রাজা কবিকে বলিলেন, কোন পুরস্কার দিবেন তাহা তিনি বুঝিতে অপারগ ‘যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে সব দিতে পারি আনি।’ কবি জবাব দিলেন: ‘কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে ওই ফুলমালাখানি।’ অতঃপর রাজার কণ্ঠমালা শিরে ধারণ করিয়া কবির ঘরে ফেরা, গৃহিণীকে সেই মাল্য দান, তিনি তাহা গলায় পরিয়া পরম পরিতৃপ্ত, এবং রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ উপসংহার: ‘বাঁধা প’ল এক মাল্য-বাঁধনে লক্ষ্মী-সরস্বতী।’ সে রাজাও নাই, সে কবিও নাই। এ ঘোর কলিতে রাষ্ট্রীয় সম্মান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীক এবং প্রকরণ। কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে সেই সমীকরণের বাহিরে রাখিতে চাহে, যদি রাজদণ্ডের গরিমা সরাইয়া রাখিয়া রাজসিংহাসন হইতে নামিয়া আসিয়া শুণ্ডীরাজের সারল্যে গুপী-বাঘাকে বক্ষে জড়াইয়া ধরিয়া সমাদর করে, তথাপি ক্ষমতার ছায়া থাকিয়াই যাইবে। রবীন্দ্রনাথের কবি আজ রাজদরবারে সম্মান চাহিতে যাইতেন না, যাইতে চাহিলেও কবিপত্নী তাঁহাকে নিরস্ত করিতেন, বলিতেন, ‘রানির চেয়ার মুছিয়া যে সম্মান সংগ্রহ করিতে হয়, ধিক তাহাকে।’ ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটিকে রাষ্ট্রের চেয়ার মুছিতে হয় নাই, তিনি রাজশক্তির নিকট সম্মান চাহেনও নাই, ফরাসি প্রেসিডেন্ট তাঁহাকে সে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ‘লেজ্যঁ দ্যনর’-এ সম্মানিত করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি জানাইয়া দিয়াছেন: এই সম্মান তিনি স্বীকার করিতে অপারগ, কারণ তিনি মনে করেন, (বিদ্যাচর্চার জন্য) সম্মান দেওয়া রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। লক্ষণীয়, পিকেটি ইহার অধিক কোনও যুক্তি দেন নাই, রাষ্ট্রের ক্ষমতার কথা বলেন নাই, রাষ্ট্রের অন্যায়ের কথা তোলেন নাই, এমনকী এই যুক্তিও উচ্চারণ করেন নাই যে, তাঁহার গত বত্সর প্রকাশিত ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী বিদ্বত্সমাজে যে আলোড়ন তুলিয়াছে, উহাই তাঁহার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। তাঁহার আপত্তি সম্পূর্ণ মৌলিক: তিনি রাষ্ট্রের সম্মান দানের অধিকারই অস্বীকার করিয়াছেন।
ষোলো আনা ঠিক করিয়াছেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসাবে নাগরিকদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট কাজ করিবার জন্য প্রস্তুত। নিরাপত্তা, প্রশাসন, উন্নয়নের পরিবেশ ও পরিকাঠামো সরবরাহ, মোটের উপর এই কাজগুলিই তাহার যথার্থ দায়িত্ব। এই নির্দিষ্ট ও অত্যন্ত সীমিত পরিসরের বাহিরে কোনও বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকা কাম্য নহে। কিন্তু ক্ষমতা বিষমতম বস্তু। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত দূরস্থান, পশ্চিম দুনিয়াতেও, বিশেষত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রশক্তি তাহার স্বাভাবিক এক্তিয়ার ভাঙিয়া নিজেকে কেবলই প্রসারিত করিতে তত্পর হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের প্রকৃত বৈপ্লবিক ধারণাটি তাঁহার এই বাক্যেই নিহিত ছিল যে রাষ্ট্রের সীমানা গুটাইয়া লও। রাষ্ট্রের এই অনধিকার চর্চা সম্ভবত অনৈতিকতার শিখরে উপনীত হয়, যখন সরকার শিক্ষা বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৃতির মূল্যায়ন করিতে বসে এবং কৃতীদের শিরোপা দিতে প্রবৃত্ত হয়। তাহার কারণ, এই ক্ষেত্রগুলি মন ও মস্তিষ্কের স্বাধীন স্ফূর্তির ভুবন, মননশীল ও সৃষ্টিশীল নাগরিকরা সেখানে আপন চিন্তা ও সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ, যাঁহারা সেই চিন্তা ও সৃষ্টির মর্ম বুঝিতে সক্ষম তাঁহাদের স্বীকৃতিই এই ভুবনে একমাত্র প্রাসঙ্গিক। সেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সার্টিফিকেটের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, যেমন প্রয়োজন নাই ভারতরত্নে ভূষিত হইবারও। টমাস পিকেটি যথার্থ বিদ্বজ্জনোচিত মর্যাদাবোধের প্রেরণাতেই এই গোড়ার কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। রাষ্ট্রের সম্মান প্রদানের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়া তিনি আপন সম্মান প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। ফ্রান্সের মতো দেশে তাঁহার এই সিদ্ধান্তের কিছু সুপ্রভাব পড়িলেও পড়িতে পারে, বঙ্গসংস্কৃতিতে তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, এই ভূখণ্ডে বছরে তিরিশ বার ভরসাফূর্তি ও পারিতোষিক বিতরণ চলিতেছে, চলিবে।
য ত্ কি ঞ্চি ত্
একটি সুইমিং পুলের উদ্বোধনে কাউন্সিলরকে পিছন থেকে টোকা মেরে জলে ফেলে দেওয়া হল। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ঘটনাটি নেহাতই মজার। এই ধরনের মজা এক বার চালু হয়ে গেলে, চমত্কার। ডগ শো-র উদ্বোধনে ডেকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, ফুটবল মাঠের উদ্বোধনে ধড়াস ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া: সাধারণ মানুষের হাতে রাজনৈতিক নেতাদের র্যাগিং বাঙালি জীবনে ধর্ষকামী খুশির হাওয়া আনবে। তবে, হেলিকপ্টার সার্ভিস উদ্বোধনে কেউ যেতে চাইবেন কি না, সন্দেহ।