নাট্যস্বজন লক্ষণমাত্র, ব্যাধির লক্ষণ। ব্যাধির নাম: স্বজনতন্ত্র। নাট্যস্বজন-আদি বিবিধ অর্বাচীন বিস্ফোটক স্ফীত হইবে এবং কালক্রমে ফাটিয়া যাইবে, কিন্তু ব্যাধিটি প্রাচীন ও দুর্মর। বঙ্গসমাজের বিবিধ প্রাচীন অসুখের মতোই ইহাও বামপন্থীদের অবদান। সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, ইত্যাদি সংস্কৃতির বিবিধ পরিসরে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার গায়ে ‘প্রগতিশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ গোছের তকমা সাঁটিবার দুরাচার তাঁহাদেরই সৃষ্টি। কমিউনিস্ট পার্টির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আসিলে এই দুরাচার কী ভাবে মুক্ত সংস্কৃতির বধ্যভূমি রচনা করিতে পারে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস তাহা দেখাইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরাও সংস্কৃতির ভুবনে আনুগত্যের বলয় নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন। ইহা নিছক দলতন্ত্র নহে, ইহা বামপন্থী চিন্তার মজ্জাগত, সেই চিন্তায় যথার্থ ‘মুক্ত সংস্কৃতি’র কোনও স্থান নাই। এই চিন্তার গভীরে নিহিত আছে বিষবৃক্ষের বীজ।
বিষবৃক্ষ লালন করিলে অমৃতফলের প্রত্যাশা করা বাতুলতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে রাজ্যপাটের সহিত বিষবৃক্ষও উত্তরাধিকার পাইয়াছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাধিনায়িকা যদি সত্যই পরিবর্তন চাহিতেন, তবে রাজদণ্ড হাতে পাইয়া সর্বাগ্রে সেটিকে কুঠার হিসাবে ব্যবহার করিতেন। তিনি চাহিলে সেই কুঠার বিষবৃক্ষটিকে নির্মূল করিতে পারিত। প্রশাসন, পরিকাঠামো, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো আবশ্যিক কর্তব্য ভিন্ন অন্য কোনও বিষয়ে রাষ্ট্র বা শাসক দল কোনও হস্তক্ষেপ করিবে না— এই নীতি তিনি প্রয়োগ করিতে পারিতেন। একেবারে সূচনায় তেমন একটি ক্ষীণ আশা জাগিয়াছিল, কিন্তু সে মধুচন্দ্রিমা অতি দ্রুত দিগন্তে বিলীন হয়, সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে শাসকরা বিপুল বিক্রমে ঢুকিয়া পড়েন, পশ্চিমবঙ্গবাসী বুঝিতে পারেন, পতাকার পরিবর্তন হইয়াছে, তন্ত্র অ-পরিবর্তিত। স্বজনতন্ত্র।
রাজনীতিকরা ক্ষমতা হাতে পাইলে কেন ‘স্বজন’ নির্মাণ ও পোষণ করিতে চাহেন, তাহা লইয়া কোনও প্রশ্ন নাই। কিন্তু যাঁহারা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল, যাঁহাদের নিজস্ব মনন ও দক্ষতা আছে, তাঁহারা কেন ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের ‘স্বজন’ হইতে ব্যস্ত হইয়া পড়েন, নাগরিকের মনে সেই প্রশ্ন উঠিবেই। উত্তরে তাঁহারা বলিতে পারেন, সরকারি সহযোগিতা তো দলীয় সহযোগিতা নহে, তাহা স্বীকারে নৈতিক বাধা কোথায়? এই যুক্তি বাস্তবের ধোপে টেকে না। প্রথমত, শাসকরা নিজেরাই যখন সরকারি ক্ষমতাকে আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে ব্যবহার করেন, তখন তাহা গ্রহণ মানেই আনুগত্য স্বীকার। দ্বিতীয়ত, সরকারি তথা দলীয় আনুগত্যই নাট্যস্বজন-এর মতো গোষ্ঠীর, আক্ষরিক অর্থেই, সহজাত ধর্ম। ‘সিপিএমত্বের জবাবে তৃণমূলত্ব’ প্রদর্শনের পরুষ অহঙ্কার ঘোষণার মাধ্যমেই এই গোষ্ঠীর জন্ম। তাহার পরে এই গোষ্ঠী ক্রমাগত ‘আমাদের দল’ হইলে নানা সুযোগসুবিধা করিয়া দিয়াছে, নচেৎ রকমারি সমস্যা সৃষ্টি করিয়াছে। আজ অহংবোধের লড়াইয়ের কারণেই হোক বা অন্য কোনও গূঢ়তর স্বার্থের প্রভাবেই হোক, মুষলপর্ব ঘনীভূত। কিন্তু নির্মম সত্য ইহাই যে, এই গোষ্ঠী বা এই ধরনের গোষ্ঠী চরিত্রেই অনৈতিক, অন্যায়। যদি অন্তত এই একটি বিষবৃক্ষ আপনার বিষে আপনিই নির্মূল হয়, তবে বলিতে হইবে, ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে একটি ভাল ঘটনা ঘটিল।