আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য পর্নো-ছবিতে অভিনয় করছেন। জানাজানি হতেই হইহই, খিস্তি। ‘লরেন’ নামে পরিচয় দিয়ে মেয়েটি ৪ মার্চ সাক্ষাৎকার দিলেন: তিনি লুকিয়ে থাকবেন না, কারণ যারা তাঁকে মহোল্লাসে নগ্ন দেখছে, তারাই তো নগ্নতার সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে বেশ্যা বলে গাল পাড়ছে। দুই, তাঁর পর্নোতে অভিনয় করতে দারুণ লাগে, যৌন সুখ ও টাকা-প্রাপ্তির এই মেলবন্ধন দুরন্ত। তিন, তিনি সেই মেয়েদের প্রতিনিধি, যাঁদের যৌন চাহিদার দাপুটে প্রকাশ এই হতভাগা পিতৃতন্ত্রের চাপে রুদ্ধ হয়ে আছে। এখন কেউ বলছে জয় ফেমিনিস্ট, কেউ বলছে নিপাত যা নিমফো, ডিউক-ও প্যাঁচে পড়েছে, কারণ তিনি বলেছেন, পড়াশোনার ফি এত বেশি না হলে (প্রায় ষাট হাজার ডলার) তিনি মোটেই পর্নো করতেন না।
পড়াশোনার খরচ কেন আদৌ এতটা হবে, এই প্রশ্নটা সবচেয়ে মিনমিন করে উঠছে। গনগনে তক্কো: লরেন কি দুর্দান্ত দুশ্চরিত্রা, না নস্যাৎবিবি নারীবাদী, যিনি নিজের মতো করে জীবনটাকে চেলে নিয়েছেন বলে পুংতন্ত্র অস্বস্তিতে গাঁকগাঁক করছে। যারা মেয়েটির দিকে পাঁক ছুড়ছে, তাদের কথা থাক। অন্য দিকটা (‘অই মহা-মসিহা আসে’) বেশি আকর্ষক। নারীবাদের মধ্যে, সব বাদের মতোই, একটা পাতি স্তর আছে। সেখানে, ব্যাপার খতিয়ে দেখার চেয়ে গাঁতিয়ে জয়-স্লোগান শুরু অধিক জরুরি। মেয়েরা ভাল, ছেলেরা শয়তান— এটুকু জানলেই সেখানে নারীবাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। (যেমন সমাজতন্ত্রের গেধো ক্যাডারপিন্ডি সার বুঝেছে: গরিবরা ভাল, বড়লোকরা খারাপ, তাই মার্ক্স বলেছিলেন, বড়লোকদের থেকে টাকা কেড়ে, গরিবদের দাও। এতে অবশ্য মার্ক্স আর রঘু ডাকাতের কোনও তফাত থাকে না!) সেই পাতি-নারীবাদীরা, নারীর শরীর দর্শানোর প্রশ্নে, দু’দিকেই নাচে ‘জিত্তেছি জিতেছি!’ মানে, পর্নোতে মেয়েদের সত্তাহীন বস্তু হিসেবে, শুধুমাত্র কিছু অঙ্গের সমাহার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, মানুষ হিসেবে দেখানো হয় না, এবং বোঝানো হয় এই ভোগের সামগ্রীগুলোকে উপুড় চিত করে যেমন খুশি অসম্মান চলবে কারণ এরা পুরুষের আরাম-যন্ত্র বই কিছু না— এই মর্মে যখন তীব্র পর্নো-বিরোধী ক্যাম্পেন সাজানো হয়, তখন এই নারীবাদীরা চিক্কুর তোলে: পর্নো-পোষক পেট্রিয়ার্কিকে পুড়িয়ে দাও। আবার, যখন কোনও মেয়ে এই পর্নোতেই নিজেকে বস্তু হিসেবে দেখায় ও যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে দেয়, এবং বলে ‘নিজের শরীর ও যৌন পছন্দের স্বাধীনতার চাবুক ভণ্ড সমাজের মুখে ছোবলাচ্ছি’, তখন এই নারীবাদীরা ‘ব্রাভো, পেট্রিয়ার্কিকে কী দারুণ ইউজ করল! ওরই মাঠে খেলে, ওকেই দুশো গোল দিল!’ চিল্লিয়ে উচ্চণ্ড দাপায়। যদি পর্নো বাই ডেফিনিশন নারী-বিরোধী হয়, তাতে অংশ নিয়ে আমি নারীবাদ ঝলকাতে পারি কি? লরেন পর্নো-চিত্রনাট্য নতুন করে লেখেননি, এই শিল্পের প্রচলিত দেখা/দেখানোর চোখটাকে বদলাবারও চেষ্টা করেননি (হ্যাঁ, সে চেষ্টা গত ৩৫ বছর ধরে হচ্ছে, ‘ফেমিনিস্ট পর্নোগ্রাফি’ আন্দোলন— যেখানে পুরুষ চরিত্রের তুলনায় নারী চরিত্রের যৌন আনন্দ/ক্ষমতাকে সমান বা বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, ছবি তৈরির প্রক্রিয়াতেও নারীর সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে নজর দেওয়া হয়, পর্নোর সমস্ত স্টিরিয়োটাইপ ভাঙার নিরন্তর চেষ্টা চলে— তাকে অনেকে বলে লিঙ্গ-সাম্য ও সামাজিক ন্যায়ের বড় পদক্ষেপ, আবার অনেকে, বহু ফেমিনিস্টও, ‘যত্ত রাবিশ!’)। বরং লরেন পর্নোতে টোটাল পুরুষ-সই ভাবেই অংশ নিয়েছেন, ‘লিক মাই লিপস’ ছবি করেছেন, তার পর বলছেন, পুরুষবাজিকে ঘিপিক কষিয়েছি!
ধ্রুপদী নারীবাদের ‘পর্নো মানেই নারীর প্রতি ভায়োলেন্স’ টপকে লিবারাল নারীবাদ বলে, বাকস্বাধীনতাকে সমর্থন করলে, পর্নোকেও করতেই হবে (এতে যত পর্নো-সমর্থন, তার চেয়ে বেশি সেন্সরশিপ-বিরোধিতা)। আর প্রো-সেক্স ফেমিনিজম বলে, কোনও নারী যদি তাঁর শরীর পর্নোতে দর্শিয়ে ও রকমারি যৌনতা করতে পেয়ে খুশি থাকেন, আর কোনও মেয়ে যদি পর্নো দেখে তারিয়ে আনন্দ চাখেন, বেশ তো! (তা অনুযায়ী, লরেনের কাজ নারীবাদী)। এবং এ সব তত্ত্বগিঁট হাটিয়ে সাধারণ বুদ্ধিতে তাকাতাকি করলেই বোঝা যায়, পর্নো কোটি মানুষের আত্মার আরাম; অতল একাকিত্ব ও অসহ্য খিদের অতুলন ত্রাণ; সবচেয়ে বড়: তাবৎ সভ্যতা-নিগড়ের এমন আমূল বাতিলতা আর কোত্থাও নেই, তাই তা আদুড় মানুষের অন্তরতম সত্যকে (ডাকনাম: ফ্যান্টাসি) নিঃশর্ত কোল দেয়। যে কোনও শিল্প আবিষ্কারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা পর্নোর দিকে কান্নিক খায়, তার কারণ পেট্রিয়ার্কি নয়। কারণ: যৌনতা তার তর্জনী-ডগায় গ্লোবকে পাঁইপাঁই ঘোরাচ্ছে। পৃথিবী যদি মাতৃতান্ত্রিক হত, তা হলে পর্নোগ্রাফি থাকত না— এই কথা যাঁরা ভাবেন, তাঁরা আসলে ভাবেন নারীর যৌন লোভ ও উড়ান কম: যে ধারণা পিতৃতন্ত্রের নোংরা গোড়ালি ধুয়েই তৈরি।
আর, পর্নো পুরুষ-চরিত্রকেও সত্তাহীন শরীরবস্তু হিসেবেই প্রোজেক্ট করে, এখন তো ইন্টারনেটের দৌলতে পুংদেহের ওপর নিঃশর্ত আধিপত্য বিস্তারের, তাকে চাবকে থেঁতলে প্রকাশ্যে অপদস্থ করে নারীর সুুখ পাওয়ারও গাদা ক্লিপিং দেখা যায়, তাই শুধু নারীকে অপমান করার দায় পর্নোর ঘাড়ে ফেলা যায় না। এবং, বিলকুল শরীর-রহিত ও হৃদয়/মস্তিষ্কসর্বস্ব চরিত্র নিয়ে শিল্প করে যদি ফাটিয়ে দেওয়া যায় ও তাকে অশ্লীল, অপমানজনক না ভাবা হয়, শরীর-সর্বস্ব শিল্পের বেলায় উলটো নিয়ম কেন? যদি বলি, ‘নারীর মধ্যে খুঁজি শুধু সেন্স অব হিউমার’, তা হলে কি ‘এইয়ো! নারীকে তার স্তন বাদ দিয়ে দেখা হল কেন!’ বলে ‘খণ্ডদর্শন’-এর বিরুদ্ধে জিগির তোলা হবে?
লরেনের ধককে স্যালুট জানাতেই হয়। তবে লরেন যখন বলেন, ‘পিতৃতন্ত্রের প্রতি আমার থ্রেট-টা সাংঘাতিক; কোনও নারী যে বুদ্ধিমতী ও শিক্ষিত হয়েও এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতে পারে, এটা তাদের বোধবুদ্ধির বাইরে’— একটু ‘উঁহু’ ছিটিয়ে বলা দরকার, পিতৃতন্ত্র কিন্তু খুব বোদা বস্তু নয়। কাউকে কোনও কাজের দিকে প্রণোদিত করতে হলে, ‘করো’ নির্দেশেও তা করা যায়, অনেক সময় ‘কক্ষনও কোরো না’ নিষেধেও সেটা তুঙ্গ-লোভনীয় করে তোলা যায়। রাজপুত্তুরকে যেমন ‘যা-ই করিস, দক্ষিণের দরজা খুলিস নে’ জপে অ্যাক্কেরে ওই দরজার ঢালেই রূপথ্রিলার গড়িয়ে দেওয়া হত। লরেন আরও বলছেন, ‘যে সমাজে নারীর যৌন পছন্দকে সম্মান দেওয়া হয় না, সেখানে আমার মতো বাইসেক্সুয়াল নারীকে এই ইন্ডাস্ট্রি প্রশ্নহীন ভাবে গ্রহণ করেছে। আমার যৌনতার অধিকার আমার। এর স্বাধীনতা ও ক্ষমতার স্বাদ অসামান্য।’ তাইলে বাপু বললে কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচা কম হলে তুমি আদৌ পর্নোয় নামতেই না? এত যদি পুলক, মুক্তি, তেজ, তা হলে পড়াশোনা বিনিপয়সায় হলেও তুমি পর্নো করে নিজের মর্যাদা ও সুখ লুটে নিতে না কেন? আর যৌন মুক্তি শুধু পর্নোয় নেমেই হতে পারে: গৎ বড্ড ঠুলি-বাচক। আসলে, সাফাইয়ের ওজন বাড়াতে লরেনের নারীবাদ-মরিচ ছড়ানোর জরুরত ছিল না। স্রেফ বলতে হত, আমার শরীর আমি বেচছি, তাতে কার বাবার কী? আমার পেশা বাছার পূর্ণ অধিকার আমার আছে। যা ভাল্লেগেছে, করেছি। কারও ক্ষতি তো করিনি। এক্সট্রা তাৎপর্যপূর্ণ স্পর্ধার ট্র্যাপে পড়ে আবার বেচারাকে রাত জেগে লিফলেট না গিলতে হয়!