বহুরূপীর ‘পুতুল খেলা’। ছবি: নিমাই ঘোষ, ‘ড্রামাটিক মোমেন্টস’, সিগাল বুক্স-এর সৌজন্যে।
শম্ভু মিত্র তাঁর কর্মজীবনে দার্ঢ্যের সঙ্গে, আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে নাট্য ও নাট্যশিল্পীদের যে সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন বা নাট্যশিল্পীদের জন্য যে সম্মানের দাবি জানিয়েছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মরা তা ক্রমাগত নষ্ট করেছেন; নিজেদের হাতে, অবহেলায় সেই সমাদৃত অবস্থার অবক্ষয় ঘটিয়েছেন, অবলুপ্তি ঘটিয়েছেন। নানা সময়ে নাট্যচর্চাকারীদের কাছে শুনেছি বা তাঁদের লেখায় পড়েছি, নাট্যশিল্পের যে অবনমন ঘটেছে বা রাষ্ট্রের চোখে এবং সামাজিক মর্যাদায় নাট্যশিল্পীদের যে অসম্মান ঘটেছে, তার জন্যে দায়ী হল সমাজব্যবস্থা, টেলিভিশন-সিনেমা, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রক্ষমতা, দক্ষিণপন্থীরা, এমনকী আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত! কিন্তু আমরা খাঁটি মধ্যবিত্তপনা বা ‘ভিক্টিম’ মানসিকতার কারণে নিজেদের দোষত্রুটির কথা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। যত মেধা আর ক্ষমতা অপসৃত হয়েছে, তত বেশি এক ভ্রান্ত আবেগে, অস্পষ্ট ভাবালুতায় নিজেদের আড়াল করেছি। ভাবিনি, সময়টা হাতের ফাঁক দিয়ে পিছলে গেছে। তাই এখন মনে হয়, মেকি আত্মশ্লাঘায় না ভুগে একটা কঠিন অথচ সরল সত্য মেনে নেওয়া জরুরি। শম্ভু মিত্র ও তাঁর সমসাময়িকরা যে শ্রদ্ধা ও মান্যতার আসনে থিয়েটারকে বসিয়েছিলেন, আমরা নিজেদের উদাসীনতায় সেটা হারিয়েছি। শম্ভু মিত্রের জন্মশতবর্ষে অন্তত এটা যদি আমরা মেনে নিতে পারি, তা হলে এখান থেকে কোথায় যাওয়া যেতে পারে, কী ভাবে, কোন রাস্তায় হাঁটা যেতে পারে, তার একটা আন্দাজ পেতে পারি।
ভারতীয় তথা বাংলা থিয়েটারের যে লগ্নে শম্ভুবাবু তাঁর শিল্পের চর্চা এবং অনুশীলন করেছেন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গে সাম্প্রতিকের সঙ্গে তার কোনও সাযুজ্য নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁর থিয়েটারের পরিকাঠামো নিয়ে যে ভাবনা ছিল, তা সময়ের এত বদল সত্ত্বেও কতটা প্রাসঙ্গিক। যেমন, তাঁর সময় বহুরূপী-তে একটা রীতি ছিল। কোথাও অভিনয়ের আমন্ত্রণ থাকলে আগের দিন দলের প্রতিনিধি গিয়ে দেখতেন মঞ্চায়নের সব ব্যবস্থা যথাযথ করা হয়েছে কি না। মঞ্চ, সাজঘর, আলো ও শব্দ-ব্যবস্থা, এমনকী দর্শক আসনের উপযুক্ত বন্দোবস্ত না হলে দল অভিনয় করতে যাবে না। নিজের শিল্পের প্রতি এতটা যত্নবান না হলে, এই সম্মান না দেখাতে পারলে মানুষই বা শিল্পের বা শিল্পীর কদর করবেন কেন? পরবর্তী কালে নাট্যদলগুলি যে ভাবে মাচায়, অস্থায়ী মঞ্চে বা অচল প্রেক্ষাগৃহে নিজেদের থিয়েটারের সঙ্গে আপস করেছেন, তা কহতব্য নয়। এমনকী রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রণে কোনও সমাবেশ বা সাংস্কৃতিক সার্কাসে চার-পাঁচটা অস্থায়ী মঞ্চ থেকে ছিটকে আসা গান, বক্তৃতা, ম্যাজিক শোয়ের শব্দের মধ্যে, সংলগ্ন মেলা থেকে মঞ্চের ওপর হামলে-পড়া কড়া আলোর মধ্যে যখন নাটক করতে রাজি হয়েছি, যত্ন করে গড়ে তোলা অভিনয়, মঞ্চভাবনা, শব্দ পরিকল্পনা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোর নকশার অপমৃত্যু দেখেছি, আপস করেছি নিজের শিল্পবোধের সঙ্গে, তখন কি এক বারও ভাবিনি, সমাজ, রাজনীতির মানুষেরা, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণের কর্তাব্যক্তিরা এর পর থিয়েটারকে কী চোখে দেখবেন? যে শিল্পীরা নিজেদের শিল্পকে তাচ্ছিল্য করেন, তাঁদের নিয়ে কোনও রাষ্ট্রের কেন মাথাব্যথা থাকবে?
হ্যাঁ, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ ছিল, বেঁচে থাকার চাপ ছিল, কিন্তু নিজের হৃদয়-স্বপ্ন-বিশ্বাস-শিল্পকে বিসর্জন দিয়ে? অ্যাকাডেমি মঞ্চে যে-ভাবে শনিবার, রবিবার বা ছুটির দিনে (ইদানীং শুক্রবারেও) সকাল-দুপুর-সন্ধে একাধিক নাট্যদল অভিনয় করে, ‘সিরিয়াস’ শিল্পচর্চার ন্যূনতম শর্ত সেখানে পালিত হয় না। দেড়-দুই ঘণ্টার প্রস্তুতির সময়ে কখনও কোনও মঞ্চায়ন সম্ভব? এ ভাবেই চলছে, চলে যাচ্ছে, চালাচ্ছি। কিন্তু ‘চলছে চলবে’ স্লোগানে আর যা-কিছু হোক, গভীর শিল্পচর্চা হয় না। ২০১৪ সালেও রাষ্ট্রের কাছে পূর্ণ সময়ের থিয়েটার-শিল্পীর বেতন ছ’হাজার টাকা, আর নির্দেশকের দশ হাজার। এটা ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক দলগুলোকে অনুদানের ‘রেট’। অর্থ মন্ত্রক বা জাতীয় নীতিনির্ধারকেরা পারফর্মিং আর্ট বা থিয়েটার শিল্পকে এই মাপেই বেঁধেছেন।
শম্ভুবাবুকে যদি সত্যি সম্মান জানাতে হয়, তা হলে জানতে হবে, কেন তিনি অভিমান করে নাট্যচর্চা বন্ধ করেছিলেন বছরের পর বছর। বুঝতে হবে তাঁর মৌলিক চাহিদাগুলোকে অনুশীলনের জন্যে একটা স্থায়ী মঞ্চ, নাট্যচর্চার জন্য উপযুক্ত (ন্যূনতম নয়) পরিবেশ ও পরিকাঠামো, নাট্যশিল্পের প্রতি সামাজিক মর্যাদা। কেন পশ্চিমবঙ্গে একটা আধুনিক, বিশ্বমানের থিয়েটার হল তৈরি করা গেল না? বেঙ্গালুরুর মতো একটা রঙ্গ শঙ্কর বা নিদেনপক্ষে মুম্বইয়ের মতো একটা পৃথ্বী থিয়েটার গড়ে উঠল না? রাজনৈতিক অবহেলা? রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা? নাট্যশিল্পের উদ্যোগের অভাব? প্রশ্নগুলো আবার ওঠা প্রয়োজন।
আমার শম্ভু মিত্রের তিনটি অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গ্যালিলেওর জীবন, চার অধ্যায় এবং দশচক্র। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে এক বারই দেখা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেটা ১৯৯০, আমি এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। তখন উনি থাকতেন গোলপার্কের কাছে একটি ফ্ল্যাটে। ফোন করে সময় নিয়েই গিয়েছিলাম। নিজেই দরজা খুলেছিলেন, লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে। নিজের হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন। ঘণ্টা তিনেক কথা বলেছিলেন। কিছু দিন আগেই ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ নাটকে আমার অভিনয় দেখেছেন। সেখান থেকে শুরু করে এক ভিন্ন মার্গের আলোচনা হয়েছিল। তিনি আমাকে পরীক্ষা করছিলেন কি না জানি না, তবে শোপেনহাওয়ার, চার্বাক, ইবসেন, ইস্কিলাস, বেদ-উপনিষদ ইত্যাদি নিয়ে নানা কঠিন প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গিয়েছিল কথোপকথন। আমিও তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ইতিমধ্যে কঠোপনিষদের যম-নচিকেতা সংলাপের সঙ্গে ভারজিলের ইনিড-এর সম্পর্ক বা দান্তের ডিভাইন কমেডির সঙ্গে গীতার দর্শন তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনার টিউটোরিয়ালে পোড়-খাওয়া। ওই সব তাত্ত্বিক বাগ্বিতণ্ডায় যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচারের ছাত্রছাত্রীদের বিপদে ফেলা মুশকিল। প্রবাদপ্রতিম মানুষটির সঙ্গে স্নাতকের সীমিত জ্ঞান নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাল দিলাম। সাম্প্রতিক থিয়েটারের হালহকিকত নিয়েও কথা হয়েছিল। বেশিটা শুনেইছিলেন। আসলে তখন আমেরিকায় থিয়েটার নিয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য নানা রকম বৃত্তির চেষ্টা করছি। বৃত্তির আবেদনের সঙ্গে দু’জন বরেণ্য মানুষের সুপারিশ চাই। সেই বায়না নিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি রাজি হননি। বলেছিলেন, বৃত্তির জন্য যে সুপারিশপত্র চাই, সে তো ইংরেজি ভাষায় হতে হবে, সাহেবরা তো আর বাংলা বুঝবে না। উনি ইংরাজি ভাষা জানেন না, তাই লিখতে পারবেন না। বুঝলাম উনি এড়িয়ে গেলেন। তরুণ মন হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল। জানি না, অজান্তেই ওঁকে রুষ্ট করেছিলাম কি না বা আঘাত দিয়েছিলাম কি না। কারণ, এক বার কথার মধ্যে বলেই ফেলেছিলাম যে, উত্পল দত্ত এখনও থিয়েটার করে চলেছেন, তাঁর কাছ থেকে তবুও আমরা কিছু শিখছি, কিন্তু আপনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারলাম না, আপনার কাজ দেখতে পারলাম না। এ কথাতেই নিশ্চয় আঘাত পেয়েছিলেন। বৃত্তি আর আমেরিকায় নাট্যশিক্ষা, দুটোই পরে হয়েছিল, উত্পল দত্ত ও বিভাস চক্রবর্তীর ইংরেজি ভাষার সুপারিশে।
শম্ভু মিত্রের সুপারিশ জোটেনি, কিন্তু সে দিনের সংলাপের স্মৃতি এবং অভিঘাত চিরকাল থাকবে। তবে এখন বুঝি, কাজ না করেই অনেক বড় শিক্ষা উনি দিয়ে গেছেন। ঠিক কোন সময়ে থামতে হয়, সেটা সব শিল্পী বুঝতে পারেন না। যেমন, উত্পল দত্তের শেষ দিককার প্রযোজনাগুলোর শিল্পগুণ সম্পর্কে আমার দ্বিধা আছে। উত্পলবাবুও তখন ক্লান্ত, নাটক করার জন্য নাটক করে যাচ্ছেন। যে ভাবে সত্যজিত্ রায়ের অবসাদ ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের ছাপ ওঁর শেষের দিকের চলচ্চিত্রে আছে। পিটার ব্রুক অভিমান করে লন্ডন ছেড়ে প্যারিস চলে গিয়েছিলেন থিয়েটার করতে। বলেছিলেন, যে মঞ্চে আমি থিয়েটার করলে লোকে ‘অসাধারণ’ বলেন এবং তার পরের দিন সেই মঞ্চেই একটা মধ্যমান বা নিম্নমানের থিয়েটার দেখে একই প্রশংসায় ভূষিত করেন, সেখানে আমি নাট্যচর্চা করব না। শম্ভুবাবুর তো কলকাতা ছেড়ে ঢাকা, লাহৌর বা টোকিয়ো যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই নিজের ভেতরে গুমরেছেন, যন্ত্রণা পেয়েছেন এবং চোখের সামনে দেখেছেন বাংলা থিয়েটারের পরিকাঠামোর অবক্ষয়।
সংখ্যার নিরিখে শিল্পের মান বিচার্য নয়। আজকে প্রচুর নাটকের দল কাজ করছে, মানে থিয়েটারের মানের উন্নতি হয়েছে এ রকম একটা উপসংহারে পৌঁছনো ঠিক হবে না। কেউ কেউ এই সময়টাকে থিয়েটারের স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তন বলে দাবি করছেন। সেটা সম্পূর্ণ একটা ‘মিথ’ এবং ভ্রান্ত। থিয়েটারের ভেতরে-ভেতরে বড় ঘুণ ধরেছে। শম্ভু মিত্রের দেখা থিয়েটারের ভবিষ্যত্ থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। তাই তাঁর জন্মশতবর্ষে আমাদের উচিত একটা স্থায়ী, আন্তর্জাতিক মানের থিয়েটারের মঞ্চ গড়ার শপথ নেওয়া। আর যত দিন না এই মঞ্চ তৈরি হয়ে উঠছে, তত দিন সব নাট্যশিল্পীদের, নিজেদের মতামত এবং বিশ্বাসের প্রভেদ ভুলে, সমবেতভাবে অ্যাকাডেমি মঞ্চটার অচলাবস্থা কাটিয়ে তাকে আবার তার স্বাধীন, স্বতন্ত্র ভূমিকায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। যে শিল্পীদের হাত ধরে এই মঞ্চ মান্যতা পেয়েছে, জনপ্রিয় হয়েছে, শম্ভু মিত্র তাঁদের অন্যতম।