‘জিমি’স হল’ ছবির একটি দৃশ্য
ছবিটা আসলে সেই ক্ষমতার গল্পই বলে।— বললেন আদুর গোপালকৃষ্ণন। কলা অ্যাকাডেমির ঠিক বাইরে বিশাল চত্বরটায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। ব্রিটিশ পরিচালক কেন্ লোচ-এর নতুন ছবি ‘জিমি’স হল’ দেখে বেরিয়েছি সদ্য। গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ, গোয়ার পানাজিতে চলছে ‘ইফি’, কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোত্সব। আদুর হাঁটতে-হাঁটতে বলতে থাকেন, ‘কী চমত্কার পিরিয়ডটাকে রিক্রিয়েট করেছেন কেন্! কিন্তু করেছেন সাম্প্রতিকের সঙ্গে তার যোগসূত্রটা চেনানোর জন্যেই। পটভূমিটাই শুধু গত শতকের, ক্ষমতার এই বৃত্তান্ত তো আজও ঘটে চলছে।’
জিমি হলেন জেমস গ্র্যালটন (১৮৮৬-১৯৪৫), আর তাঁর হলটা বেশ বড় একটা ক্লাবঘরই বলা যেতে পারে। সেখানে স্থানীয় মানুষজন আসত বাঁচার রসদ খুঁজতে নিজের মতো করে। এটি ছিল আয়ারল্যান্ডের লেট্রিম অঞ্চলে। তিরিশের দশকের শুরু, তত দিনে ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিয়েছে আইরিশরা। কিন্তু নতুন প্রশাসন ভাল চোখে দেখে না বামপন্থী গ্র্যালটনকে। এর আগে ১৯২১-এই ওই কমিউনিটি হল-এ নানা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনার বন্দোবস্ত করেছিলেন জেমস। স্কুলছাত্রদেরও ক্লাস নেওয়া হত সামাজিক বিষয়ে। সাধারণ নাগরিক, কৃষক থেকে শুরু করে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের মিটিং পর্যন্ত চলত হলটায়। ১৯২২-এ গৃহযুদ্ধের জেরে দেশ ছেড়ে জেমস চলে যান আমেরিকায়। ১৯৩২-এ ফের ফিরে আসেন আয়ারল্যান্ডে। এবং কমিউনিটি হলটাকে নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে চালু করে দেন।
ওই অঞ্চলের আইরিশরা সেটা নিজেদের মতো ব্যবহার শুরু করে, তাদের প্রতিদিনের একঘেয়েমি থেকে যেন মুক্তি এনে দেয় হলটা। রুটিন কাজের বাইরে নাচে-গানে মেতে ওঠে জিমি-র হল। নাচ আর গান শেখার ক্লাসও শুরু হয় সেখানে। আরও নানা ক্লাসই চলতে থাকে, কবিতা থেকে বক্সিং অবধি, এমনকী খেটে-খাওয়া গরিব মানুষের অধিকার নিয়েও। কিন্তু কখনওই জেমস নিজের বিশ্বাস জোর করে চাপানোর চেষ্টা করতেন না, বরং বেশি উত্সাহী হয়ে উঠতেন নাচ আর গানের উত্সবে, বাচ্চা-বুড়ো থেকে সব বয়সিরাই যোগ দিত তাতে।
আর এ-সবই চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চ ও শাসককুলের। তাঁরা ভাবলেন, ভয়ংকর বিপদ ঘনিয়ে তুলছে ওই জিমি-র হল, সেখানে যা ঘটছে, তা আয়ারল্যান্ডের সমাজ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক ধরনের অন্তর্ঘাত। বিশেষত ওই নাচগান। কারণ, তা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রীতি মেনে হচ্ছে না। কী হচ্ছে তা হলে? জ্যাজ! চার্চের কাছে তা ভয়ানক আপত্তিকর। তত্কালীন ধর্মযাজক ফতোয়াই দিলেন: ‘এ ধরনের আনন্দ পাওয়ার জন্যে কেন এত উল্লাস? আমাদের এক জনকে বেছে নিতে হবে— ক্রাইস্ট না গ্র্যালটন?’ পাশাপাশি শাসককুলও তাল মিলিয়ে অভিযোগ আনলেন, গরিব মানুষকে খেপিয়ে তুলছেন জেমস, যা প্রশাসনের পক্ষে বিপজ্জনক।
ক্ষমতা-র চরিত্রই এই, সে তার সমস্ত শস্ত্র দিয়ে গলা টিপে ধরে ব্যক্তির, শ্বাস নেওয়ার মতো কোনও ফাঁক রাখে না। এখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা, ধর্মীয় সঙ্ঘের প্রতিনিধিরা জেমস গ্র্যালটনের অস্তিত্বকে ‘অসামাজিক’ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের ডি ভ্যালেরা-র নেতৃত্বাধীন সরকার পুরোদস্তুর চার্চের সমর্থন পেয়ে তার হিংসাত্মক রাজশক্তি প্রয়োগ করে, পুলিশ-প্রশাসন-আইন-আদালত দিয়ে জেমস-এর স্বাধীন বসবাসকে রুদ্ধ করে, সন্ত্রস্ত করে। Undesirable alien আখ্যা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার ক’রে চিরকালের মতো নির্বাসিত ক’রে দেয় আমেরিকায়, ১৯৩৩-এ। জীবদ্দশায় আর কোনওদিন আয়ারল্যান্ডে ফিরতে পারেননি জেমস।
জেমস-এর এই নির্বাসনের আগে দীর্ঘায়ত একটি দৃশ্য রেখেছিলেন কেন্ তাঁর ছবিতে, তাতে জ্যাজ সঙ্গীতের তালে পা ফেলে বহুক্ষণ ধরে নাচছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। কমবয়সিদের তরতাজা নবীনতাকে যেন স্বাগত জানাচ্ছিলেন পরিচালক। নিজের সারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন কেন্, যখনই কোনও সঙ্গীত উদ্দীপিত করে সর্বসাধারণকে, অপ্রচলিত স্বর তৈরি করে, রক্ষণশীলেরা ভয় পেয়ে যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে রুদ্ধ করার চেষ্টা করে সে সঙ্গীত, সে উদ্দীপনা, সে বিরুদ্ধ স্বর।
ক্ষমতার এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগ চিনিয়ে দেওয়ার জন্যেই গ্র্যালটন-এর জীবন ছবিতে তুলে আনেন কেন্ লোচ। পুরনো কালের গল্প বলেন, পুরনো মানুষের গল্প, পুরনো ব্যবস্থার গল্প। আমেরিকায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন জেমস। আক্রান্ত, অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকেই উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম মনে হয়েছিল তাঁর। ক্ষমতার বিরুদ্ধে তো তাঁর লড়াই, এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি যতক্ষণ ক্ষমতার বিরুদ্ধে, ততক্ষণ তার ভূমিকা লড়াকু এবং অবশ্যই মানবিক। কিন্তু ক্ষমতা পেলে?
চিনের পরিচালক ঝ্যাং ইমু-র ছবি ‘কামিং হোম’। কলা অ্যাকাডেমিতে দুপুর তিনটের শো। ষাটের দশকের মধ্যভাগে ‘গ্রেট প্রলেটারিয়ান কালচারাল রেভোলিউশন’ কী ভাবে ছারখার করে দিয়েছিল চিনা জনসাধারণের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবন, তা নিয়েই ঝ্যাং-এর এই নতুন ছবি।
বিপ্লবোত্তর চিনে ক্ষমতায় আসীন কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে লাগাতার সন্ত্রাস শুরু হয়েছিল ‘এলিট বুর্জোয়া’দের ওপর, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ও ‘শোধনবাদী’দের ওপর। এই চিহ্নিতকরণের আদৌ কোনও ভিত্তি ছিল কি না, আজও তা জানা যায়নি। তবে, যারা সে সময় পার্টির ‘জো হুকুম’ আনুগত্যে সাড়া দিতে পারেনি, তাদেরই বিরুদ্ধবাদী চিহ্নিত ক’রে গায়ে দেগে দেওয়া হয়েছিল ‘দক্ষিণপন্থী’। ঝ্যাং-এর ছবি যে দম্পতিকে নিয়ে, তাদের মধ্যে তেমন পুরুষ ওই লু, তাকেই রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে চালান করা হয় লেবার ক্যাম্পে, আর তার স্ত্রী ফেং তাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। বহুকাল বাদে প্রতীক্ষার অবসান হয় বটে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবও বন্ধ হয়, পার্টির নীতিরও রদবদল হয়, কিন্তু তত দিনে ফেং আর লু’কে নিজের স্বামী হিসেবে চিনতে পারে না, কারণ তার স্মৃতিলোপের অসুখ শুরু হয়ে গিয়েছে।
ছবি শেষ হয় এক তুষারাবৃত রাতে, রেলস্টেশনে স্বামীর জন্য চিরপ্রতীক্ষারত স্মৃতিলুপ্ত ফেং তার পাশেই দাঁড়ানো লু’কে চিনতেও পারে না। সেই শীতল রাতে দু’জনের ওই দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্বের মধ্যে জেগে থাকে যেন কেবল কমিউনিস্ট পার্টি, মানব মুক্তির সংকল্পে যে পার্টির জন্ম, আর ক্ষমতাসীন হলেই যে পার্টির হাতে বারবার লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার।
ছবি শেষ হতেই কলা অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়ে জেটিতে এসে দাঁড়াই। দিন শেষ হচ্ছে আরব সাগরের সূর্যাস্তে। ‘ইফি’ও প্রায় শেষ। আদুর ফিরে গিয়েছেন কেরলে, তাঁর কথাটাই মনে পড়ে: ‘ছবিটা আসলে সেই ক্ষমতার গল্পই বলে।’ সন্ধের সঙ্গে অনেকটা বিষাদ নেমে আসে।