অবশেষে পোল্যান্ড বলিয়া দিল, খ্যাতনামা পোলিশ পরিচালক রোমান পোলানস্কি-কে তাহারা মার্কিন সরকারের হস্তে সমর্পণ করিবে না। ১৯৭৭ সালে আমেরিকায় পোলানস্কি এক ১৩ বৎসরের কিশোরীর সহিত যৌনতা করিয়াছিলেন, যৌন নিগ্রহের অভিযোগে তাঁহার বিচার শুরু হইয়াছিল। আদালত রায় ঘোষণার পূর্বেই পোলানস্কি পলাইয়া যান। প্রথমে ইংল্যান্ডে, তাহার পর ফ্রান্সে। এতগুলি বৎসর ধরিয়া পলাইয়াই বেড়াইতেছেন, এক বার সুইটজারল্যান্ডে ঢুকিতে গিয়া গ্রেফতারও হইয়াছিলেন, কিন্তু তাহার পর রক্ষা পান। বহু বার বিশ্ব জুড়িয়া ইহা লইয়া আলোচনা হইয়াছে, বহু শিল্পী ও রাজনীতিক পোলানস্কিকে সমর্থন করিয়া বিবৃতি দিয়াছেন, আবার বহু বিদ্বজ্জন তাঁহার শাস্তি চাহিয়াছেন। নিগৃহীতা মহিলা পরবর্তী কালে, ঘটনার ২৭ বা ৩০ বৎসর পরে, বহু সাক্ষাৎকারে বলিয়াছেন, তিনি পরিচালককে ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন, পোলানস্কি যথেষ্ট শাস্তি পাইয়াছেন, এবং তিনি স্বভাবত ধর্ষক নহেন, তাই সমাজের পক্ষেও বিপজ্জনক নহেন।
নিগৃহীত হইয়া কেহ নিগ্রহকারীকে ক্ষমা করিলেই অপরাধটি লঘু হইয়া যায় কি? কোনও দেশের বিচারব্যবস্থা বলিতে পারে, নিহতের পরিবার ক্ষমা করিলে খুনিকে ফাঁসি হইতে মুক্তি দেওয়া যায়। অন্য দেশ বলিবে, ব্যক্তির আবেগের উপর রাষ্ট্রের ন্যায়ের ধারণা নির্ভর করিবে কেন? ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা নির্মিত হইবে তত্ত্বের স্তরে, বাস্তবে তাহার প্রয়োগ হইবে ঠিকই, এবং তখন ঘটনাবলিকে মনোযোগ-সহ বিশ্লেষণ করিতেও হইবে, কিন্তু আইন মূলত তাহার আদর্শধৃত পথেই চলিবে। এই মামলা যখন প্রথম উঠিয়াছিল, কিশোরী বলিয়াছিলেন পোলানস্কি তাঁহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা করেন। পোলানস্কি বলেন, মেয়েটি ইচ্ছুক ছিলেন। অনেক পরে, মহিলা বলেন, পোলানস্কি তাঁহার সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনতা করিলেও, ইতর আচরণ করেন নাই, শারীরিক জোর খাটান নাই। এবং ঘটনাটিকে বাড়াইয়া দেখানো হইয়াছে। এই কথাও আইনগত ভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হইতে পারে। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্কার সম্মতি সত্ত্বেও যৌনতাকে ধর্ষণ হিসাবেই দেখা উচিত বলিয়া প্রায় সর্বত্র মনে করা হয়। ধর্ষকের এই তকমা সত্ত্বেও পোলানস্কি সমগ্র বিশ্বে শিল্পী হিসাবে সমাদৃত এবং বহু মানুষ মনে করেন, তাঁহাকে এই অভিযোগের কারণে বড়ই ভুগিতে হইল।
শিল্পজগতে কাহারও প্রবল অবদান থাকিলে আইন তাহার প্রতি অতিরিক্ত ক্ষমাশীল হইবে কেন? কারণ তিনি অন্য ভাবে সমাজের নিকট ক্ষতিপূরণ দিতেছেন? বা, শাস্তি দিলে তাঁহার মহৎ প্রতিভা নষ্ট হইয়া যাইবে? যে যুক্তিতে, ১৯৪৯-এ যখন দশটি অপরাধের জন্য জঁা জেনে-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় (তাহার মধ্যে চুরি, জাল নথি ব্যবহার, যৌন অপরাধও ছিল), সার্ত্র, কক্তো, পিকাসো ও বহু খ্যাত মনীষী ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির নিকট পত্র লিখিয়া তাহা রদ করাইয়াছিলেন। ১৯৬৮ সালে সার্ত্রকে যখন গ্রেফতার করিবার কথা হয় আইন অমান্যের অভিযোগে, ফরাসি রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তুমি তো ভলতেয়ারকে গ্রেফতার করিতে পারো না!’ প্রশ্ন ইহাই, ভলতেয়ারকে কেন গ্রেফতার করা যাইবে না? ভলতেয়ার যদি আইনের চক্ষে হরিপদ কেরানির সমান হন, গ্রেফতার করা যাইবে। আর, যদি মানিয়া লওয়া হয়, কিছু মানুষ অন্য মানুষের তুলনায় বহু গুণ প্রতিভাশালী, সুতরাং তাঁহারা স্বাধীন থাকিলে তাঁহাদের নিকট যে সৃষ্টিরাশি প্রত্যাশিত, তাহা মানবসমাজের পক্ষে বহু গুণ জরুরি— একটি অপরাধের সমুচিত শাস্তিবিধান অপেক্ষা— তবে আইন-নির্দেশিত সাম্যের পার্শ্বেই এক গরীয়ান অসাম্যের ধ্বজা উড়াইতে হয়। সম্ভবত, আইনে যত জন বিশ্বাস করেন, কিছু ক্ষেত্রে অাইনের শিথিলতার সার্থকতাতেও প্রায় তত জনই বিশ্বাস করেন। পোল্যান্ডের সরকারও হয়তো সেই পক্ষই অবলম্বন করিল।
যৎকিঞ্চিৎ
‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ জানাল, খবরের কাগজে মোড়া খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, কাগজের কালি থেকে খাবারে হানিকর বস্তু চলে আসতে পারে। খবরকাগজ যে ঠোঙা অবস্থাতেও এমন ক্ষতিকর কে জানত! এমনিতেই জিনিসটি সমাজে সারা ক্ষণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, কত লোকের কাগজ পড়ে ডিপ্রেশন গজায়, টেনশন বাড়ে, পেট খারাপ হয়, কে তার হিসেব রাখে! মুশকিল: এটিকে ডিজিটাল করলেই যে এর কালোপনা চলে যাবে, গ্যারান্টি নেই!