প্রবন্ধ ২

শ্রমিকরা সাবেকি ইউনিয়ন থেকে মুক্তি চান

শ্রমিক সংগঠন এবং আন্দোলনের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ইমানুয়েল নেস। সম্প্রতি ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ আয়োজিত পঞ্চম ক্রিটিকাল স্টাডিজ সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শিবাজীপ্রতিম বসু।আপনি যুক্তি দিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি বা হসপিটালিটি-র কাজগুলিতে কম মজুরিতে বহিরাগত বা ‘অতিথি’ কর্মী নিয়োগের যে ব্যবস্থা চলেছে, তাতে কর্পোরেট সংস্থাগুলিরই লাভ, যে সব দেশ থেকে এই কর্মীরা আসেন এবং যে দেশে তাঁরা নিযুক্ত হন, উভয় দেশেরই কর্মিকুলের ক্ষতি। এর মধ্যে কি চোরা শ্রমিক-জাতীয়তাবাদের সুর কি শোনা যাচ্ছে না?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০০
Share:

আর কি কখনও কবে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। নিউ ইয়র্ক, সেপ্টেম্বর ২০১১।

আপনি যুক্তি দিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি বা হসপিটালিটি-র কাজগুলিতে কম মজুরিতে বহিরাগত বা ‘অতিথি’ কর্মী নিয়োগের যে ব্যবস্থা চলেছে, তাতে কর্পোরেট সংস্থাগুলিরই লাভ, যে সব দেশ থেকে এই কর্মীরা আসেন এবং যে দেশে তাঁরা নিযুক্ত হন, উভয় দেশেরই কর্মিকুলের ক্ষতি। এর মধ্যে কি চোরা শ্রমিক-জাতীয়তাবাদের সুর কি শোনা যাচ্ছে না?

Advertisement

এ ক্ষেত্রে আমি ভারত বা চিনের পেশাদার অতিথি-কর্মীদের সঙ্গে বাকিদের তফাত করতে চাই। এই সব পেশাদার কাজের শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সাধারণত এঁরা মাইক্রোসফ্ট, গুগল জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের উচ্চ পেশার কাজ ছাড়াও কিন্তু দলে দলে অন্য অনেকে আসছেন প্রধানত কায়িক শ্রমের (যেমন কৃষি-শ্রমিকের বা শহরে সাফাইয়ের কাজ) সঙ্গে যুক্ত অনিশ্চিত ক্ষেত্রে কাজ করতে। কাজ পাওয়ার জন্য বহু ডলার গচ্চা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর প্রবল অসাম্য, অন্যায্যতার,অনেক সময় অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েও এঁদের দেশে ফিরে যাওয়ার সংগতি নেই। মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকার নানা দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা বা পশ্চিম আফ্রিকার নানা দেশ থেকে সুখী জীবনের স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় এসে এঁরা রূঢ় বাস্তবের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে ঘণ্টায় তিন ডলার পারিশ্রমিকে (যা যুক্তরাষ্ট্রীয় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম) কাজ করছেন, মজুরি না পেয়ে প্রতিবাদ করলে জুটছে মারধর বা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি। যা চলছে, তাকে অনেকেই ‘আইনসিদ্ধ দাসপ্রথা’ বলেছেন। উলটো দিকে, তথ্যপ্রযুক্তিতে অতিথিদের মজুরি অনেক বেশি মনে হলেও, তা একই কাজে যুক্ত মার্কিন নাগরিকদের মজুরির চেয়ে অনেক কম, প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

জাতীয়তাবাদী মনোভাবের দ্বারা চালিত হয়ে নয়, হতভাগ্য অতিথি-শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে, আশাহত অনেকের মুখেই দেশে ফিরে যাওয়ার আর্তি শুনে আমি উপলব্ধি করি, এই অসম্মানের জীবন কাটানোর চেয়ে দেশে থেকে যাওয়া অনেক ভাল, যদি না আমরা এই ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারি। আর উচ্চ বেতনের কর্মীদের (বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির পেশাদার, নান ধরনের ইঞ্জিনিয়ার, বা ডাক্তারদের) ‘অতিথি’ হিসেবে ইউএসএ আসার মধ্যে কি ‘মেধা-নিষ্কাশন’-এর কাহিনি নেই? বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ বা মুম্বইয়ে বহু বার এসে মনে হয়েছে, এই মানবসম্পদ দেশে থাকলে এ দেশ আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। এখানে শ্রমিক-জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন নেই।

Advertisement

আপনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ‘নতুন’ সর্বহারাদের প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রমিকদের বহির্গমনের প্রসঙ্গ। এই সবই কি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নয়? না কি, ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলতে আপনি লেনিনের ফিনান্স পুঁজি ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদই বোঝাতে চান?

আজকের শিল্প-শ্রমিকদের বেশির ভাগই উত্তর গোলার্ধের নন, দক্ষিণ গোলার্ধের চিন, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের এবং এঁদের অনেকেই দেশের ভিতরে বা বাইরে ‘অন্য’ দেশের জন্য বা গোটা বিশ্ব বাজারের জন্য, নানা নতুন ধরনের আইন বা চুক্তির অধীনে উত্‌পাদন করছে। তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নই এই ‘নতুন’ সর্বহারাদের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানের প্রেক্ষিতে আমি ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলতে বুঝি, বড় বড় বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থে প্রলুব্ধ করে বা জোর খাটিয়ে নানা দেশের দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন শ্রম তুলে এনে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা। লেনিনের তত্ত্বে এর কিছুটা ইঙ্গিত ছিল, তবে এখন তার মাত্রা আর চরিত্র, দুইয়েরই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।

মাইকেল হার্ড ও আন্তোনিয়ো নেগ্রি প্রদত্ত এম্পায়ার-এর ব্যাখ্যাই কি তবে গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বলা হচ্ছে নতুন বিশ্বায়িত বহুজাতিক নির্ভর সাম্রাজ্যের নির্দিষ্ট কোনও কেন্দ্র নেই।

নতুন পঁুজিবাদ ও শ্রমের চরিত্র ব্যাখ্যায় হার্ড ও নেগ্রি-র বইয়ের অবশ্যই গুরুত্ব আছে, তা আমাদের পঁুজি ও শ্রমের সাম্প্রতিক চলন বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু এই তত্ত্বের ক্ষেত্রে আমার দুটো আপত্তি। এক, সম্পূর্ণ আলোচনাটি প্রায় শ্রেণি (ক্লাস) প্রসঙ্গ বিবর্জিত। দুই, ‘সাম্রাজ্য’কে এতটাই কেন্দ্রহীন দেখানো হয়েছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় তা নিরালম্ব বায়ুভূত।

১৯৮৯ থেকে আপনি নিউইয়র্ক অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিক সংগঠনের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন, এখন প্রথাগত ইউনিয়নের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে শ্রমিক আন্দোলনের অটোনমির কথা, প্রয়োজনে কারখানা দখল করে ‘ফ্যাক্টরি কাউন্সিল’ মারফত শ্রমিকদেরই উত্‌পাদন চালানোর পক্ষে বলছেন। এক সময় আন্তোনিয়ো গ্রামশি ফ্যাক্টরি কাউন্সিলের কথা বলেছেন। আপনার শহরেরই অর্থনীতির অধ্যাপক রিচার্ড উল্‌ফও এমনই দাবি করেন।

রিচার্ড উল্‌ফ আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু ও সহমর্মী। তিনি জোরালো ভাবে শ্রমিকদের সমবায়ের কথা বলেছেন। কিন্তু অনেক সময়েই আমার তা বড় বেশি বিমূর্ত ধারণা মনে হয়। আমি সরাসরি শ্রমিকদের দ্বারা উত্‌পাদন ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের পক্ষপাতী। ব্রাজিল সহ বেশ কিছু জায়গায় এমন ধরনের সফল পরীক্ষা চলছে। এই ব্যবস্থাও সংকটের পড়তে পারে, প্রয়োজনে কর্মী সংকোচন বা ছাঁটাই করতে হতে পারে। কিন্তু তখন শ্রমিকরাই সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলে উত্‌পন্ন দায়িত্ব নেবে। অন্য দিকে, দেখেছি সাবেকি সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়নের কর্তৃত্বের পর্যায়ক্রম, সবটাই ‘বাইরে’ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, নির্দিষ্ট কারখানার ভেতরের সমস্যা বা দাবি নিয়ে শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাধীন ভাবে আলাপ-আলোচনা বা দর-কষাকষি চালাতে পারেন না। তা ছাড়া, ইউনিয়নের ভূমিকা অনেক সময়েই হয়ে ওঠে লেবার ম্যানেজারের মতো, যে মালিকের হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে। এরই ফলে, কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশেও ‘স্বাধীন’ শ্রমিক আন্দোলনের চিন্তা দানা বাঁধছে।

বছর তিনেক আগে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনও তো আমেরিকা-সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহর কাঁপিয়েছে, আজ তার এমন ছিন্নভিন্ন হাল কেন?

প্রথম কথা, ‘অকুপাই’ শ্রেণিভিত্তিক নয়, নানা বর্গের মানুষের হতাশা থেকে উদ্ভূত বহুমাত্রিক আন্দোলন, যার নির্দিষ্ট দিশা ছিল না; দুই, তার মধ্যে নানা ধরনের উদ্দেশ্যহীন নৈরাজ্যবাদী জড়ো হয়েছিলেন; তিন, আফ্রিকান-আমেরিকানরা (যাঁরা সবচেয়ে নিম্নবর্গীয়) তাঁরা এতে যোগ দেননি; চার, পুলিশ অত্যন্ত কঠোর ভাবে, বহু জায়গায় বল প্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করেছে। তবে এমন আন্দোলন, যা বহু জ্বলন্ত সমস্যাকে সামনে এনেছে, তা কিছুটা স্তব্ধ হলেও উবে যাবে না, কোনও দিন হয়তো...

ভারতে শ্রমিক আন্দোলন প্রধানত রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত ট্রেড ইউনিয়নের দখলে। এখানে ‘স্বাধীন’ শ্রমিক আন্দোলনের সম্ভাবনা আছে?

ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস ও গুরুত্ব আমিও জানি। কিন্তু ভারতেও শ্রমিকরা সাবেকি ট্রেড ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে চাইছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তার কিছু উদাহরণ আছে। সম্প্রতি গুড়গাঁওয়ে মারুতি-সুজুকির শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলা যায়। বিদেশি সহমর্মী হিসেবে, যে আন্দোলনে আমিও সাময়িক ভাবে গ্রেফতার হয়েছিলাম। এখন, চেন্নাইয়ে (একটি বহুজাতিক সংস্থার) শ্রমিকরা এমন আন্দোলন চাইছেন। এই সম্মেলনের পরেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যাব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement