প্রবন্ধ ২

‘লাভ জেহাদ’ তত্ত্ব ভন্ডুল বলেই রাগ?

‘পিকে’ নিয়ে সঙ্ঘ-পরিবার এত খেপলেন কেন? এ ছবি তো কোন ধর্মান্তর বৈধ এবং ন্যায়, আর কোনটা অবৈধ আর অন্যায়, এ রকম কোনও তর্কে ঢোকেনি।তাঁর ব্যারিটোনে তিনি এ যাবত্‌ কখনও ভগবানের নাম নেননি! মন্দিরের ধারে-কাছে যাননি! সেই ছোটবেলায় পরিবারের শত্রুরা যখন তাঁর কচি হাতে উল্কির মতো দেগে দিয়েছিল ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’, তখন থেকে তিনি ‘রেবেল’! ভরা যৌবনে ‘অ্যাংরি’ হলেন। এবং সমাজবিরোধী। ভগবানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ল।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

তাঁর ব্যারিটোনে তিনি এ যাবত্‌ কখনও ভগবানের নাম নেননি! মন্দিরের ধারে-কাছে যাননি! সেই ছোটবেলায় পরিবারের শত্রুরা যখন তাঁর কচি হাতে উল্কির মতো দেগে দিয়েছিল ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’, তখন থেকে তিনি ‘রেবেল’! ভরা যৌবনে ‘অ্যাংরি’ হলেন। এবং সমাজবিরোধী। ভগবানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ল। কিন্তু তাঁর মা ভীষণ ভালবাসা ও নির্ভরতার মা তিনি যখন হাসপাতালে ভয়ানক অসুস্থ, তখন বড় ছেলের নাস্তিকতার দুর্গ আর টিকল না। জীবনে প্রথম বার মন্দিরে এসে, ‘ভগওয়ান’-এর কাছে তাঁর আত্মসমর্পণের ওই মুহূর্ত, সেলিম-জাভেদের দুরন্ত ডায়লগবাজি আর অমিতাভ বচ্চনের আন্ডারঅ্যাক্টিং-এর দৌলতে এখনও বলিউডের জনপ্রিয়তম দৃশ্যগুলোর একটা। ‘দিওয়ার’-এর পরেও অমিতাভ বচ্চন বেশ ক’টা ছবিতে মন্দিরে গেছেন। ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র অ্যান্টনি গনজালভেস হিসেবে চার্চে গেছেন। ‘কুলি’র ইকবাল খান হয়ে মসজিদে নমাজ পড়েছেন।

Advertisement

আশির দশক অবধি বলিউড সিনেমার নায়কদের পরদায় বেশ ধম্মকম্ম করতে দেখা যেত। বলিউড বেশ সর্ব-ধর্ম-সমভাব গোছের সরকারি ‘সেকুলার’ অবস্থান বজায় রেখে চলত। একই মায়ের তিন ছেলে অমর, আকবর আর অ্যান্টনি হাসপাতালে পাশাপাশি বেডে শুয়ে রক্ত দিয়ে মাকে যখন বাঁচিয়ে তুলছে, তখন তো আর তিনি রক্তমাংসের রোগী নন, নির্ভেজাল ভারতমাতা! চিকিত্‌সাবিজ্ঞানের বেকার নিয়মকানুন তাঁর জন্যে খাটে না!

নব্বইয়ের দশক থেকেই দেখা গেল, বলিউডি ছবির নায়কেরা চট করে মন্দির মসজিদ বা গির্জায় দৌড়চ্ছে না, কিন্তু পাকিস্তান ও তাদের ‘রফতানি করা’ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার গল্প হলেই কোথায় যেন একটু হিন্দু ‘ওভারটোন’ এসে যাচ্ছে। ন্যারেটিভে দু’এক জন খাঁটি দেশভক্ত, ভালমানুষ-গোছের মুসলিম থাকলেও, গড়পড়তা ‘ওরা’ কেমন যেন! দেশের সঙ্গে গদ্দারি ‘ওদের’ কাছে জলভাত! ওরা পাকিস্তানের এজেন্ট হয়! বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ মারে। আগেকার বলিউড ধর্মপ্রাণ-দেশপ্রেমিক মুসলিমদের এক রকম স্টিরিয়োটাইপ তৈরি করত। এখনকার বলিউড দাড়ি-সাদা স্কালক্যাপ-সন্ত্রাসবাদী কানেকশনসুদ্ধু মুসলিম ভারতীয়দের আর একটা স্টিরিয়োটাইপ খাড়া করছে। কাগজটাগজগুলোতে এ সব নিয়ে মাঝেমধ্যে লেখালিখি হলেও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-ট্রতিবাদ তেমন দেখা যায়নি! এমনকী ‘বম্বে’ বা ‘গদর: এক প্রেমকথা’য় মুসলিম-কন্যার সঙ্গে অন্য ধর্মের যুবকের প্রেম ও বিয়ে নিয়ে নানা আপত্তি তুলে যে সব মুসলিম সংগঠন বিক্ষোভ দেখিয়েছিল, তারাও কখনও প্রশ্ন তোলেনি, বলিউড-ছবিতে সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলিম কেন?

Advertisement

কিন্তু ‘পিকে’ যেই সরল মনে গব্বর সিং-এর ডায়লগ একটু টুইস্ট করে বলছে, ‘যো ডর গয়া, উও মন্দির গয়া’, অমনি হরেক কিসিমের হিন্দু সেনারা রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! আমদাবাদ থেকে শিলচর, দিল্লি থেকে ভোপাল, বরেলি থেকে রাঁচি কাঁপিয়ে প্রশ্ন উঠেছে: কেন হিন্দুদের মন্দির নিয়েই টানাটানি করা হয়? কেন ‘মসজিদ গয়া’ বা ‘চার্চ গয়া’ বলার হিম্মত হয় না? হিন্দুরা ‘সহিষ্ণু’ বলেই কি তাদের দেবদেবীদের নিয়ে ইয়ার্কি মারা যায়? দেবতাদের ছবি দেওয়া হ্যান্ডবিলে ‘লা পাত্তা’, ‘মিসিং’, ‘নিখোঁজ’ লিখে দেওয়ালে সাঁটা যায়? হিন্দু সাধুসন্ত, বাবাজি-মহান্তজিদের ভণ্ড-ধান্দাবাজ-অসাধু-প্রতারক বলে গাল পাড়া যায়? ফলত হিন্দু ভাবাবেগে ভয়ানক ‘ঠেস’ পৌঁছনো ও তাদের ধর্মভাবনাকে আহত-অপমানিত-কলঙ্কিত করার দায়ে ‘পিকে’র নির্মাতা-অভিনেতাদের বিরুদ্ধে কয়েকটা মামলা-মকদ্দমা রুজু করা হয়েছে! বাবা রামদেব তাঁর আশ্রমে বসেই ছবিটা ‘নিষিদ্ধ’ করার জন্য জোর হুংকার ছেড়েছেন, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে হিন্দুত্ব ব্রিগেড স্রেফ নির্ভেজাল গুন্ডাগিরি করে ছবিটা হল থেকে তুলে দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে! শাসক দল হিসেবে বিজেপি সরাসরি ব্যাপারটায় না ঢুকলেও বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্য স্বামী বলেছেন, ভারতে দাঙ্গা বাধাতে আইএসআই-এর টাকাতেই নাকি ছবিটা তৈরি হয়েছে!

আবার এর পালটা হিসেবে মুলায়ম সিংহ-অখিলেশ যাদবদের উত্তরপ্রদেশ ও নীতীশকুমার-লালুপ্রসাদদের বিহার সরকার তাঁদের রাজ্যে ‘পিকে’কে করমুক্ত ঘোষণা করে দেন, ছবি নিয়ে মেরুকরণের পালা সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু কথা হল, এ ছবির মধ্যে কি এতটাই জোরদার রাজনৈতিক উপাদান আছে, যেটা দেশ জুড়ে এত বড় একটা রাজনৈতিক বিতর্ক বাধাতে পারে? ছবিটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে, ‘পিকে’ খুব সাদামাটা সাধারণ একটা ছবি। হয়তো রাজকুমার হিরানি ফ্র্যাঞ্চাইজির দুর্বলতম ছবি। সমস্যা বলুন, সমাধান বলুন, সবই যেন বড্ড বেশি সিধে-সরল। আর বজরঙ্গিদের মুশকিলটা বোধহয় এখানেই। ‘পিকে’তে পরিচালক রাজকুমার হিরানি সত্তর-আশির দশকের হিন্দি সিনেমার সেই সারল্য ফিরিয়ে এনেছেন। মদ খাওয়ার অপকারিতা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অবধি সব ব্যাপারে ওই সব ছবিতে যেমন সরল স্টেটমেন্ট রাখা হত, ‘পিকে’তেও সেটাই করা হয়েছে। ‘দিওয়ার’-এ নাস্তিক অমিতাভ বচ্চন মন্দিরের চৌকাঠে এসে ঘোষণা করেন: ‘ভগওয়ান, ম্যায় আ গয়া হুঁ’, ভিনগ্রহ থেকে সোজা ভারতবর্ষে ল্যান্ড করা এলিয়েন পিকে-ও যেন সেটার উত্তর দেওয়ার মতো করেই বলে ফেলে: ‘যো ডর গয়া, উও মন্দির গয়া’!

এই এলিয়েনেরও আসলে আগেকার বলিউডের মতোই কোনও ধর্মের প্রতিই পক্ষপাত নেই, বা সব ধর্মের প্রতিই সরল বিশ্বাস আছে। তাই ছবিতে পিকে মন্দিরের ক্যাশবাক্স থেকে প্রণামী বার করে, হিন্দু ঠাকুরের পুজোর ডালি নিয়ে গির্জায় ঢুকে নারকোল ফাটায়, ‘পবিত্র’ ওয়াইনের বোতল নিয়ে মসজিদে ‘নিবেদন’ করতে ছোটে। এবং সব জায়গায় একই রকম তাড়া খায়। কিন্তু এমন নিক্তি-মাপা নিরপেক্ষতার লাইনে চলেও ‘পিকে’ শুধু হিন্দুত্ববাদীদেরই চোখের বালি, পথের কাঁটা হল কেন? ‘পিকে’র আগেও তো ‘ওহ্ মাই গড!’-এ ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে বেশ কড়া তর্ক উঠেছে! আর ভেক-ধরা ‘গডম্যান’ বজ্জাত ‘বাবা’রা তো বেশ কয়েক বার বলিউডের পর্দায় এসেছেন! সব্বাইকে ছেড়ে দিয়ে ‘পিকে’ ব্যাটাকেই ধরা কেন? সঙ্ঘ-পরিবার এত খেপলেন কেন? ‘পিকে’ তো কোন ধর্মান্তর বৈধ এবং ন্যায়, আর কোনটা অবৈধ আর অন্যায়, এ রকম কোনও তর্কে ঢোকেনি।

সে শুধু ধর্ম নিয়ে কতগুলো সহজ, মৌলিক, বুনিয়াদি প্রশ্ন তুলেছে। সেগুলোও নতুন কথা নয়, ঈশ্বর ইট-পাথরের মন্দির-মসজিদেই বাসা বেঁধে আটকে থাকেন কি থাকেন না, দালাল-ঠিকেদারদের ছাড়া তাঁর কাছে পৌঁছনো যায় কি যায় না সেই কবীরের আমল থেকেই ভারতের মানুষ এ সব প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করে আসছে। পিকে বরং ঘ্যানঘ্যান করে জ্ঞান দিয়ে দিয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। বজরঙ্গি বা হিন্দু সেনারা টিকিট কেটে হলে ঢুকে আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই সব ছেলেভুলোনো বাণী শুনেছে, তার পর তাদের রাগ হয়েছে, তার পর তারা পোস্টার ছিঁড়েছে, লবি-স্টিল-এর শো-উইন্ডো ভেঙেছে, হোর্ডিং-ফ্লেক্সে আগুন দিয়েছে, দর্শকদের তাড়া করেছে? ইয়ে বাত জরা হজম নহি হুয়া। তা হলে ক্ষোভটা কীসের? মুসলিম আমির খানকে দিয়ে হিন্দু দেবদেবী আর ভণ্ড বাবাজি সম্পর্কে মন্তব্য করানো হয়েছে, তাই? কিছুটা কারণ হতে পারে, কিন্তু পুরোটা নয়। অন্য একটা সন্দেহ হয়।

ছবির শুরুতে একটা উপমহাদেশীয় প্রেমকাহিনির আভাস আছে। বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানি যুবক সরফরাজের সঙ্গে তপস্বীজির সাক্ষাত্‌ শিষ্যের কন্যা জগজ্জননী ওরফে জগ্গু-র প্রেম হয়। জগ্গুর দিল্লির বাড়িতে ব্যাপারটা জানাজানি হতেই বিরাট আপত্তি ওঠে। তপস্বীজিকে দিয়ে স্কাইপে জগ্গুর ওপর চাপ তৈরি করা হয়। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, পাকিস্তানি মুসলিম যুবক সরলা হিন্দু ভারতকন্যার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেই। ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা সে রকমই দাঁড়িয়ে যায়। জগ্গু একাই বিরহিণী-হৃদয়ে দেশে ফেরে। কিন্তু শেষে ওই এলিয়েন পিকে’ই প্রমাণ করে দেয়, তপস্বীজি মিথ্যে বলেছিলেন, ওটা আসলে একটা ভুল-বোঝাবুঝি ছিল। ফলে, রাজকুমার হিরানির সব সিনেমার মতোই, ক্লাইম্যাক্সে সহজ ইচ্ছাপূরণ ঘটে যায়। সব ‘রং নাম্বার’ রাইট হয়ে যায়। জগ্গু-সরফরাজের মিলন হয়। অল ইজ ওয়েল। হিন্দু ধর্মগুরুর নাকের ডগা দিয়ে উপমহাদেশীয় হিন্দু-মুসলিম রোমান্সের এই সাফল্যেই কি হিন্দুত্ব-ব্রিগেডের চোখ টাটাল? হিন্দু ভারতীয় মেয়ে পাকিস্তানের বধূ হচ্ছে, ‘লাভ জেহাদ’ তত্ত্বের এর চেয়ে বড় পরাজয় আর হয় না। হনুমান বাহিনীর আচমকা উপদ্রবের কারণ কি এটাই? পরদার ইচ্ছে-ধর্মকে বাস্তবের শক্তি-কর্ম দিয়ে ঠেকানোর প্রয়াস? আমাদের মতো ঘরপোড়া গরুদের কাছে গন্ধটা কিন্তু বেশ সন্দেহজনকই ঠেকল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement