দুর্মর। নেপালি লাইন, জেলা জলপাইগুড়ি। ছবি: স্বাগত নন্দী
গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে টিনের বাড়ি। টিন ফুটো হয়ে গেছে, মেরামতি নেই বহু কাল। নেই, কারণ বাগান বন্ধ। যে বাগানে তাঁরা— জলপাইগুড়ি জেলার নেপালি লাইনের বাসিন্দারা, নেপালি, ঝাড়খণ্ডি আদিবাসী ও বিহারি প্রবাসীরা কয়েক পুরুষ জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, প্রতিপালিত হয়েছেন, সে বাগান বেশ কয়েক বছর ধরে পাকাপাকি বন্ধ। বাগান খোলা অবস্থাতেই যেখানে মজুরদের ন্যূনতম পাওনাগুলো দেওয়া হয় না— নেপালি লাইনের অদূরেই কিছু চালু বাগানে সেই অবস্থা আমরা দেখে এসেছি— সেখানে বন্ধ বাগানে রেশন, কেরোসিন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্কুল, এ সব কোথা থেকে থাকবে?
চালু বাগানে মজুরি ৯৫ টাকা। সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির থেকেও কম। অথচ এটা সরকার, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে ঠিক করা। বাগান কর্তৃক দেওয়া পরিষেবাগুলো একে একে তুলে নেওয়া হচ্ছে। সরকার ও ইউনিয়ন বিনা প্রতিবাদে মালিকের সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে এসেছে। চালু বাগানগুলোতেই ভয়াবহ অনাহার, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য। আর, বন্ধ বাগানের অবস্থাটা চোখের সামনে দেখতে দেখতে মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি। পথের পাশে বাড়ির দাওয়ায় দাওয়ায় অনাহারশীর্ণ, জরাজীর্ণ কিছু মানবদেহ। হাড়জিরজিরে শিশুরা কাঁচা মাদার ফল পুড়িয়ে পেট ভরাবার চেষ্টা করছে, পাড়ার পর পাড়া যেন প্রেতপুরী।
কাজ বলতে নদী থেকে পাথর কুড়নো। সারা দিন খেটে পেট ভরানোর মতো রোজগারও হয় না। আবার নদীতে জল এলে সেটুকু কাজও বন্ধ। ‘একশো দিনের কাজ?’ ‘হয়েছিল, এক বছর আগে তেরো দিন, তবে মজুরি পেতে লেগেছিল ছ’মাস!’ আর কাজ বলতে, বহু দূর জঙ্গল থেকে লকড়ি এনে বাজারে বিক্রি করা। তারও বিপদ অনেক— হাতি আছে, তার চেয়েও বিপজ্জনক, ফরেস্ট গার্ড আছে। অনিশ্চয় জীবিকার জীবনে কিছু সাহায্য পেতে পুরুষরা, কমবয়সি ছেলেরা দলে দলে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশ বিভুঁইয়ে। অদূরে ভুটান, সেখানে কিছু কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু সে আর কতটুকু? তাই রোজগারের খোঁজে নেপালি লাইন পৌঁছে যায় লুধিয়ানা, চেন্নাই, তিরুঅনন্তপুরম, মুম্বই।
না গিয়ে উপায়? বন্ধ চা-বাগানগুলোর জন্য সেই ২০০৮-০৯ সালে চালু হওয়া দু’টাকা কিলো দরে চাল প্রকল্প এখনও চলছে বটে, কিন্তু সে তো শুধু চা-বাগানের প্রাক্তন মজুর-বাড়িগুলোর জন্য, এবং তা-ও মাসে পনেরো-কুড়ি কিলোর বেশি না! তবু এই সামান্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতাটাও কম না, ‘কোনও ক্রমে বেঁচে তো আছি। এটুকু না হলে তো না খেয়ে মরেই যেতাম, যেমন মরে গেছে অনেক লোক।’ যে বাড়িগুলোয় সুবিধে নেই, তারা তা হলে কী করবে? গত পাঁচ-সাত বছরে নাকি এ গ্রামেই শুধু না খেয়ে মারা গেছেন কুড়ি-পঁচিশ জন মানুষ। সরকার বলে, তাঁরা অসুখে মারা গেছেন; লোকে বলে না খেয়ে। অসুখই হোক বা না-খাওয়া, মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়। অসহায় মানুষ সম্পর্কে রাষ্ট্র ও সমাজের নির্বিকার মনোভাব কতটা হিংস্র হতে পারে, তা এই বাগানগুলো দেখলে বোঝা যায়।
অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী। এক দিকে নিরবচ্ছিন্ন অনাহার, তার উপর ম্যালেরিয়া এবং দৈনন্দিন ত্রাস— ডায়রিয়া। হবে না-ই বা কেন? জল আসে ভুটান থেকে— পাহাড়ের জল। সে জলে খালি চোখেই দেখা যায় ভাসমান বস্তুখণ্ড— ‘জল নয়, মল’। স্বাস্থ্যকর্মীর ভাষায়: ‘কত ওষুধ খাওয়াবেন? আজ সারল তো কাল আবার শুরু। জলের সমস্যা দূর না করে ডায়রিয়া সারানো যাবে না।’ অথচ কিছু বছর আগেও বাগান থেকেই জলের ব্যবস্থা ছিল, রোগের প্রকোপও কম ছিল। বাগান উঠে গেছে, লোকেদের ভরসা রাষ্ট্র। তার কল্যাণহস্ত যদি সামান্য প্রসারিত হত, তা হলে এই ক্ষইয়ে-ক্ষইয়ে, ঘষটে-ঘষটে মৃত্যুর মুখে এগোনো লোকগুলোও দেশের পূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠতে পারত, সামান্যতম সুবিধাগুলোর সদ্ব্যবহারে।
রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ শুনতে পেলাম, সম্মিলিত শিশুকণ্ঠে কিছু ইংরাজি বাক্যের উচ্চারণ: ‘স্ট্যান্ড আপ, কাম হিয়ার, গো ব্যাক...।’ প্রাইভেট স্কুল ভেবে এগিয়ে গেলাম। জানি, এত দারিদ্রের মধ্যেও এই অঞ্চলে প্রাইভেট স্কুল গজিয়ে উঠেছ, যার একটা প্রধান কারণ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা। মজার ব্যাপার, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সাদ্রিভাষী বা নেপালিভাষী, সেখানে শিক্ষক বাংলাভাষী। আবার উল্টোটাও আছে। নেপালি বা বাংলা মাধ্যমে পড়ে শিশুদের লাভ হবে না ভেবে মা-বাবারা ইংরেজিতে পড়াতে চান। সেই চাওয়ারই প্রত্যুত্তরে, গাছপালার আড়ালে ভাঙাচোরা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী তাঁর শিশুদের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছেন। সামান্য উন্নতি যে কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে, এই অঙ্গনওয়াড়িটা তার নমুনা। বছর আটেক আগে আমাদের সহকর্মীরা এই অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি মুখে দিয়ে বমি করে ফেলেছেন, চাল ছিল পচা, ডাল পোকাধরা, সব্জিপাতি-তেল-মশলা ছিলই না। অনাহারের তাড়নায় সেটাই খেতে বাধ্য হত শিশু ও মায়েরা। অঙ্গনওয়াড়ি খাতে কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ কিছুটা বাড়ায় এখন খাবারের মান তুলনায় ভাল। এই উন্নতি মা-বাবা, শিশু ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সবাইকে অনুপ্রাণিত করে আরও ভাল করার। এখনও রান্নার জায়গা নেই, বসে খাওয়ার জায়গা নেই, বর্ষায় কারও বাড়িতে রান্না করতে হয়, তবু এই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র প্রেতপুরীর মাঝে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়ে রেখেছে।
এই সামান্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য যদি মানুষের মধ্যে এত আশা জাগাতে পারে, তা হলে একশো দিনের কাজটা যদি ভাল ভাবে দেওয়া যেত, বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ঠিক মতো চালানো যেত, পরিস্রুত জল দেওয়া যেত, তা হলে রুগ্ণ জীর্ণ আধমরা মানুষগুলো এক প্রাণোজ্জ্বল মানবগোষ্ঠীর অংশী হতে পারত। সেই অংশীদারি যে তারা চায়, তার প্রমাণ, পাথর ভেঙে, লকড়ি কেটে, পঞ্জাব-তামিলনাড়ু-কেরলে দেশান্তরী হয়ে এবং অর্ধভুক্ত থেকেও তারা আগামী প্রজন্মকে ‘মানুষ’ করতে চায়। ফেরার পথে দেখি, স্কুল ইউনিফর্ম পরা এক দল ছেলেমেয়ে। কী ব্যাপার? হাইস্কুল পনেরো কিলোমিটার দূর বীরপাড়ায়, সরকারি যানবাহন নেই, প্রাইভেট জিপ চলে, ভাড়া দৈনিক চল্লিশ টাকা, আজ সেটা আসেনি।
কাছাকাছি একটা স্কুল করতে, মানুষকে কাজ দিতে বা পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে জিডিপি-র বৃদ্ধি কতটা কমে যায় জানি না, কিন্তু বিকশিত হতে উন্মুখ যে মানুষগুলো, তাদের প্রতি এই অবহেলা মারাত্মক অপরাধ।
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত