রাজ্যের লজ্জা

শিশুপাচার চক্রে রাজ্যের ভূমিকা কী? পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটির গুরুত্ব অসীম, কারণ শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম নহে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলিতেছে, এই রাজ্য দেশে নারী ও শিশু পাচারের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

শিশুপাচার চক্রে রাজ্যের ভূমিকা কী? পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটির গুরুত্ব অসীম, কারণ শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম নহে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলিতেছে, এই রাজ্য দেশে নারী ও শিশু পাচারের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য। শিশুপাচার ও প্রশাসনের মধ্যে সংযোগসূত্র কোথায়, পর পর দুই জেলার দুই শিশু সুরক্ষা আধিকারিকের গ্রেফতারে প্রশ্নচিহ্নটি ক্রমশ অতিকায় হইয়া উঠিতেছিল। জাতীয় শিশু সুরক্ষা আয়োগের তদন্তপ্রক্রিয়ায় জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত করিয়াছে। জেলার কর্তারা বালিতে মুখ গুঁজিয়া বাঁচিতে চেষ্টা করিতেছেন। আয়োগের কর্তারা আদালতে গিয়া তথ্য তলব করিবেন বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তাহার যে প্রয়োজন হইতেছে, রাজ্য সরকার যে স্বয়ং প্রয়োজনীয় তথ্য তুলিয়া দেয় নাই, ইহার অপেক্ষা বিস্ময়কর আর কি হইতে পারে? যুদ্ধ তো পাচারকারীদের সহিত, জাতীয় আয়োগের সহিত নহে। আয়োগকে সাহায্য না করিলে দুইটি সন্দেহ দেখা দেয়। এক, রাজ্য সরকার দোষীদের আড়াল করিবার চেষ্টায় তদন্ত বিলম্বিত করিতেছে। জাতীয় আয়োগ ইতিমধ্যেই এই অভিযোগ করিয়াছে। ইহা সংশয় জাগায় যে, রাজ্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তরফে কেবল অবহেলা ঘটে নাই, পাচারে তাঁহাদের সক্রিয় ভূমিকা রহিয়াছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হইল, রাজ্য সরকার জাতীয় আয়োগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়াছে। সিআই়ডি তদন্ত করিতেছে, তাহাই যথেষ্ট, অপর কারও তদন্তের প্রয়োজন নাই, এমন মনোভাব লইয়াছে। ইহা বিস্ময়কর। তদন্তাধীন বিষয়টি যেমন তেমন অপরাধ নহে। রাজ্যের হোমগুলিতে যত অনায়াসে শিশুদের মৃত্যু হইয়াছে, তাহাদের পাচার করা হইয়াছে, তাহা দেখিয়া রাজ্যবাসী শিহরিয়া উঠিয়াছে। কোনও সভ্য দেশে সরকার-পোষিত, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হোমে নীরবে শিশুমৃত্যু ঘটিয়া যায়, শিশু পাচার ও শিশু বিক্রয়ের জাল কাজ করে, ইহা কল্পনাতীত। এমন অপরাধের সকল স্তরে অনুসন্ধান প্রয়োজন। কর্তৃত্বের অভিমান দেখাইবার চেষ্টায় রাজ্যের লাভ নাই।

Advertisement

ইতিমধ্যেই যে তথ্যগুলি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়াছে। শিশু সুরক্ষা কমিটি প্রায় সকল জেলায় গঠিত হইলেও কেন জলপাইগুড়িতে গঠিত হয় নাই, কেন একটি ‘অ্যাড হক’ কমিটি গঠন করিয়া কাজ চালানো হইতেছিল, ইহার কোনও উত্তরই গ্রহণযোগ্য নহে। যাহারা শিশু সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত সরকারি অফিসার, তাহারা শিশু পাচারে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হইলে প্রশ্ন ওঠে, তাহা হইলে নারী ও শিশু উন্নয়ন দফতর কী করিতেছিল? সর্বোপরি, পাঁচ বৎসর পূর্বে এ রাজ্যেও শিশু সুরক্ষা আয়োগ গঠিত হইয়াছে। তাহার কার্যকালের মধ্যেই পিংলার বাজি কারখানার বিস্ফোরণে শিশুদের মৃত্যু হইতে রাজ্য-জুড়িয়া শিশুপাচার চক্র, সবই ঘটিল। নাবালিকা পাচারে দ্বিতীয় স্থানটি অধিকার করিল পশ্চিমবঙ্গ। কী করিতেছিল আয়োগ?

রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ বাদুড়িয়া ও জলপাইগুড়ির শিশুপাচার চক্রের জন্য দায়ী কি না, তাহা তদন্তের বিষয়। কিন্তু একটি কথা স্পষ্ট। শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন, মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন প্রভৃতি স্বতন্ত্র আয়োগ গঠিত হইয়াছিল সরকারের উপর নজরদারির জন্য। সরকারকে সতর্ক এবং দায়বদ্ধ করিবার জন্য। কিন্তু রাজ্য সরকার অনুগত লোক বসাইয়া, যথেষ্ট কর্মী ও অর্থ না দিয়া, কমিশনের উপর কমিশন বসাইয়া এই কমিশনগুলিকে অর্থহীন করিয়া দিয়াছে। তাহাতে সরকারের মুখ হয়তো বাঁচিতেছে, মারা পড়িতেছে মানবাধিকার, নাগরিক-অধিকার। যাহার চরম অভিব্যক্তি অনাথ শিশুদের পাচার ও মৃত্যু।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement