শিরোনামে হয়তো এখন যাদবপুর নেই, কিন্তু ক্ষান্ত হয়নি কলরব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘যৌন-নিগ্রহ’-র অভিযোগ এবং পরবর্তী ঘটনাক্রমে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর। প্রশ্নের মুখে উপাচার্যের ভূমিকা। রাজ্য প্রশাসন ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর ব্যবস্থা হিসেবে এ পর্যন্ত যা যা উদ্যোগ নিয়েছে, তা আরও ‘ড্যামেজিং’ হিসেবেই প্রতিভাত অনেকের কাছে।
ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ-প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের, কলকাতা মহানগরের, এই রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে দেশে-দেশান্তরে। ‘যৌন-নিগ্রহ’-র অভিযোগের প্রেক্ষিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, এ সম্পর্কে আদালতের রায়/নির্দেশিকা এবং আইনি বিধানের প্রয়োগ নিয়ে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে চেষ্টা করছিলাম যৌন-হেনস্থা/নিগ্রহের বিষয়টি। দেখতে চেষ্টা করছিলাম, ১৯৯৭ সালে ‘বিশাখা নির্দেশিকা’ এবং ২০১৩-র ‘কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন-হেনস্থা (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন’-এর মূল প্রতিপাদ্যগুলি।
বিশাখা বনাম রাজস্থান রাজ্য সরকারের মোকদ্দমার ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মা, বিচারপতি বি এন কৃপাল প্রমুখদের নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা/নিগ্রহ প্রতিরোধে যে রায় দিয়েছিল, তাতে ‘কর্মক্ষেত্র’র সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ ছিল প্রথাগত কার্যালয়-পরিসরের মধ্যেই। ২০১৩ সালের গৃহীত আইনে সেই পরিসর অনেকটাই ব্যাপ্তি পেয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিত্সালয়/হাসপাতাল, ক্রীড়া সংস্থা অনেক কিছুই এসেছে এর পরিধিতে। নির্দিষ্ট করা হয়েছে যৌন-হেনস্থা/নিগ্রহের প্রকৃতি।
নির্দেশিকায় রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক অভিযোগ কমিটি গঠনের কথা। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির শীর্ষে থাকবেন সংস্থারই উচ্চ পদাধিকারী এক জন মহিলা। সংস্থাতে কর্মরত এমন দু’জনকে নিতে হবে, যাঁরা নারীস্বার্থে কাজের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বা সমাজকর্মী রূপে কাজে অভিজ্ঞ বা আইন সম্পর্কে পারদর্শী/ওয়াকিবহাল। এ ছাড়াও এক জনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে এই কমিটিতে, যিনি ওই সংস্থায় কর্মরত নন, নারী অধিকার/স্বার্থ সংক্রান্ত কোনও অসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কিংবা যৌন-হেনস্থা/নিগ্রহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজে অভিজ্ঞ। এই কমিটির মোট সদস্য-সংখ্যার অর্ধেক নারীসমাজের প্রতিনিধি হতে হবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির গঠনে প্রথম এবং শেষের শর্ত দু’টি পূরণ হয়েছে। কিন্তু, অন্যান্য সদস্যদের যে যে বিষয়ে পারদর্শিতা, অভিজ্ঞতা/ সক্রিয়তার কথা বলা হয়েছে আইনে, তা বাস্তবে কতটা রয়েছে, তা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের একাংশ সংশয় প্রকাশ করেছে। সংস্থার বাইরের যে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি রয়েছেন, তাঁর নারী অধিকার-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংযোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির যে দু’জন সদস্য ‘নিগৃহীতা’ ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের ‘সংবেদনশীলতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠেছে উপাচার্যের আচরণ নিয়ে, ভূমিকা নিয়ে। এই সংশয়, এই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও অস্পষ্ট। পক্ষে-বিপক্ষে উঠে আসছে বহুস্বর।
বিশাখা নির্দেশিকা (১৯৯৭) ও ২০১৩-র যৌন-হেনস্থা সংক্রান্ত সংক্রান্ত আইন পড়তে গিয়ে বুঝলাম এই নির্দেশিকা ও আইনের উদ্দেশ্য কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থার প্রতিবিধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সামগ্রিক ভাবে সমাজে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠাও এর অন্যতম অভিমুখ। আরও বুঝলাম, যৌন-হেনস্থা যৌন-নিগ্রহ সংক্রান্ত আইন বিষয়ে জানি না অনেক কিছুই। আমরা নিজেরাই বা কতটা সচেতন, কতটা সংবেদনশীল থাকি এ সম্পর্কে? অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আপাতনিরীহ কথোপকথন, শরীরী ভাষা হয়ে ওঠে নাকি যৌন-ইঙ্গিতবহ? বৈষম্যমূলক আচরণ কোনগুলি, কোন আচরণ শালীনতার সীমা অতিক্রম করে, কোন আচরণে-ব্যবহারে অন্যের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের পরিধি আক্রান্ত হয় এ সব নিয়ে কতটুকু জানি? কতটুকুই বা সচেতন থাকি? এ সম্পর্কে সংবেদনশীল করে তোলার, সচেতন করে তোলার পর্যাপ্ত প্রয়াসই বা কতটুকু চোখে পড়ে?
অথচ, উল্লেখিত বিশাখা নির্দেশিকা এবং ২০১৩-র আইনে ‘প্রতিরোধ’ শব্দটি গুরুত্বের সঙ্গেই স্থান পেয়েছে। কথা বলছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই ‘মানবীচর্চা কেন্দ্র’-র সঙ্গে যুক্ত এক গবেষকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘‘বাম জমানায় যে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠিত হয়েছিল, তাঁরা সাকুল্যে দু’টি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন-নিগ্রহ/হেনস্থা’ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার। পরিবর্তিত জমানায় গঠিত কমিটির তরফে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই, তা সরকারি-বেসরকারি-অসরকারি যা-ই হোক না কেন, ছবিটা প্রায় একই রকম। বহু প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটির অস্তিত্বই নেই!’’
মনোসমাজকর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটি মানসিক চিকিত্সালয়ে স্কিত্জোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত এক মহিলা যখন নিগ্রহের শিকার হন, তখন কর্তৃপক্ষ ‘বিশাখা নির্দেশিকা’ মেনে আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি তৈরিতে আপত্তি জানান। আপত্তির পক্ষে তাঁদের যুক্তি ছিল, ‘হাসপাতাল তো কর্মক্ষেত্র নয়’! প্রসঙ্গত, তখনও ২০১৩-র আইনটি সংসদে পাশ হয়নি, বিল আকারে ছিল।
আসলে, আমরা বোধ হয় এ সম্পর্কিত নির্দেশিকা বা আইনের আক্ষরিক ভাষ্যের ওপর অতিরিক্ত জোর দিচ্ছি, এই সব নির্দেশিকা ও আইনের সেই মর্মার্থের ওপর নয় যা সত্যিকারের নারী-পুরুষ বৈষম্যমুক্ত, লিঙ্গসাম্য-ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্নকে সামনে রেখে ভাবা।
বহু আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও বারংবার উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন, নিজের সংবেদনশীলতাকে সজীব রাখার স্বার্থেই নারী-পুরুষের যৌনভেদ শারীরিক বাস্তবতা, কিন্তু লিঙ্গের নির্মাণ মূলত সামাজিক। এই সামাজিক নির্মাণই আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্যের ভিত্তি তৈরি করেছে। আমাদের বহুমাত্রিক সমাজে অনেক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। সব ধরনের বৈষম্য আমাদের সবাইকে স্পর্শ করে না। কিন্তু, লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য আমাদের প্রায় বেশির ভাগ পরিবারে কম-বেশি বিরাজমান। এই বৈষম্যের শিকার আমাদের পরিবারেরই কাছের মানুষ যাঁরা জন্মগত পরিচয়ে নারী। লিঙ্গ বৈষম্যের এই ধারা বংশপরম্পরায় আমাদের সমাজে-সংস্কৃতিতে, আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই বৈষম্য সম্পর্কে আমাদের মধ্যে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার অভাব নির্মম বাস্তব।
যৌন-নিগ্রহ/হেনস্থা প্রতিরোধে যে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, তা এ যাবত্ হতে থাকা কলরবে সবচেয়ে কম গুরুত্ব পেয়েছে। তা সত্ত্বেও, যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন সেই সম্ভাবনার দরজা আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে, যার হাত ধরে লিঙ্গ-সাম্যের দাবিকে সামনে তুলে আনা যায়। যাদবপুরের ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে, মাঝরাতে আলো নিভিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে কলরব চলতে থাকুক। পাশাপাশি দাবি উঠুক, প্রতিটি সংস্থায়/প্রতিষ্ঠানে/সংগঠনে গড়ে উঠুক যৌনহেনস্থা-নিপীড়ন-নির্যাতন প্রতিরোধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষকে সচেতন, সংবেদনশীল করে তোলার উদ্যোগও শুরু হোক এখনই। লিঙ্গসাম্য-ভিত্তিক সংবেদনশীল সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ চলুক নিরন্তর। এর মধ্যে দিয়েই যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন রেখে যাক তার স্থায়ী অবদান।
সুখের কথা, কলকাতা শহরেই ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে সাম্প্রতিক কালে দু’টি প্রয়াস চোখে পড়েছে ‘অর্ধেক আকাশ’ আর ‘চিত্রাঙ্গদা’। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ ভাবে সংগঠিত উদ্যোগ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আগে দেখিনি আমরা। তাঁদের সব ভাবনার সঙ্গে সবাই একমত না-ই হতে পারি কিন্তু, এই বিষয় নিয়ে ভাবনার যে পরিসর তাঁরা গড়ে তুলেছেন, তা অন্যদের কাছেও দৃষ্টান্ত হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমাজকর্মী