দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
বিশ শতকের আধাআধি থেকে পৃথিবী কম অশান্তি, বিপর্যয় দেখেনি। তবু তার আগেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল, তার তুলনা আজও মেলা ভার। সভ্যতার মর্মান্তিকতম ঘটনাগুলি শো-কেস করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবেতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধই এর উত্স। ভার্সাই চুক্তিতে যে ভাবে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গারি’র উপর বিপুল আর্থিক শাস্তি ধার্য করা হল, তাদের সম্পূর্ণ অস্ত্রহীন (ডিসআর্মামেন্ট) করা হল, তার থেকেই নাত্সি জাতীয়তাবাদের উত্থান। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালিও হাঁটল ফ্যাসিবাদের পথে। হিটলারের জার্মানি জিঙ্গো-জাতীয়তার সুর চড়াতে চড়াতে নতুন করে অস্ত্রসজ্জা (রিআর্মামেন্ট) শুরু করল। ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে তাদের পোড়াতে লাগল। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির পোল্যান্ড অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
বলশেভিক বিপ্লব
রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল বিস্ফোরক। সেন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোর খাদ্য সরবরাহের প্রধান ভর ছিল রেলওয়ে। যুদ্ধে সেটি ধ্বংস হল। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উত্তাল হয়ে উঠল। ১৯১৭ পয়লা জানুয়ারির সকালে দেখা গেল তীব্র শীতে মহানগরের সমস্ত মানুষ রুটির দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। জারতন্ত্রের নিপাত হল, অক্টোবরের মধ্যে ক্ষমতা গেল বলশেভিকদের হাতে। রাশিয়া তথা বিশ্বে জেগে উঠল এক সর্বৈব নতুন অভিজ্ঞতা: কমিউনিস্ট রাষ্ট্রতন্ত্র। বলশেভিক আন্দোলন আগে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছিল ঠিকই, তবে সুবর্ণময় সুযোগটি কিন্তু হাতে এল বিশ্বযুদ্ধের ফাঁক গলেই।
মহামন্দা
চার বছর যুদ্ধের পর দেখা গেল ইউরোপের অর্থনীতির অত্যন্ত করুণ হাল। বিশেষত জার্মানি ও ব্রিটেনের। ব্রিটেন চিরকাল সমুদ্রবাণিজ্যনির্ভর। এ দিকে যুদ্ধে চল্লিশ শতাংশ ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস হয়েছে। অন্যান্য দেশ যুদ্ধের পর নিজেদের বাঁচানোর জন্য শুল্ক এত বাড়িয়েছে যে বাণিজ্য আর লাভজনকও নয়। জার্মানিরও অবস্থা তথৈবচ। বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ তার ঘাড়ে। উদ্ধারকারী বলতে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের পুরো অর্থনীতি দ্রুত মার্কিন ঋণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। আর, তাই আমেরিকার স্টক মার্কেট ভেঙে পড়ায় গোটা দুনিয়ার অর্থ-ব্যবস্থাই পড়ল বেদম বেকায়দায়। বিশ্বব্যাপী মন্দা এই প্রথম। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত চলল এই মন্দা। এখনও ইতিহাসে দীর্ঘতম।
অসহযোগ আন্দোলন
ব্রিটেনের কাছে ভারত সে দিন রত্ন-উপনিবেশ। ভারত কেবল দলে দলে সেনা রফতানি করল না, অর্থের বিরাট সাশ্রয়ও করে দিল। ব্রিটিশ রাজ অনেক অতিরিক্ত কর বসাল ভারতে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে লাগল হু হু করে। অসন্তুষ্ট মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করতে এগিয়ে এলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। শুরু হল তাঁর অসহযোগ আন্দোলন। বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে খলিফার যে অবমাননা হল, তাতে গর্জে উঠল মুসলিমরা, ছড়িয়ে পড়ল খিলাফত আন্দোলন। গাঁধীরই পরিকল্পনামতে দুই আন্দোলনকে মিশিয়ে দেওয়া হল, ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন দিয়ে সূচনা হল গাঁধীর নতুন ধারার জাতীয়তাবাদ।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ
যুদ্ধ মানেই চুক্তি। আর বিশ্বযুদ্ধ নিশ্চয়ই শেষ হল একটা ‘বিশ্বচুক্তি’ দিয়ে। এই বিশ্বচুক্তির ফল: লিগ অব নেশনস! ভার্সাই-এর চুক্তিসভায় লিগ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এটাই হল প্রথম আন্তর্জাতিক শক্তি-সমবায়। পরবর্তী কালের রাষ্ট্রপুঞ্জ এরই উত্তরাধিকারী। লিগ চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিল, কালান্তক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকাতে পারেনি, সবই ঠিক। কিন্তু আসল কথা হল, অনেক দেশ হাত মিলিয়ে একটা ‘গ্লোবাল অর্ডার’ বা আন্তর্জাতিক বিশ্ব তৈরি হল এই প্রথম। মজার ব্যাপার, এই সময়ই তৈরি হল প্রথম ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার। এবং পরের একশো বছরে গোটা দুনিয়া জুড়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর প্রতিপত্তি বেড়েই চলল।
মেয়েদের ভোটাধিকার
মার্কিন কংগ্রেসে প্রথম বার মেয়েদের ভোটাধিকার বিল পাশ হল ১৯১৭ সালের জুন মাসে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, বিশ্বযুদ্ধে মেয়েদের বিশেষ ‘অবদান’ মনে রেখেই এই বিল। দেশের দরকার লক্ষ লক্ষ সৈনিক-পুরুষ, আর তাই খেতখামারে কারখানায় ব্যাঙ্ক-অফিসে ঢুকতেই হল মেয়েদের। অর্থনীতিতে এত বিরাট সংখ্যায় মহিলাদের যোগদানের সঙ্গে তাদের ভোটাধিকার আন্দোলনের সম্পর্ক গভীর। তবে দীর্ঘ ভোটাধিকার আন্দোলন এই ধারণাও ছড়িয়ে দেয় যে, ভোটের অধিকার রাষ্ট্রের কৃপা নয়, প্রতিটি নাগরিকের ‘বার্থ-রাইট’।
প্যালেস্তাইন সংকট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরবরা যুদ্ধ করলে ব্রিটেন প্যালেস্তাইনে আরব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে । আবার, বালফুর ডিক্লারেশন (১৯১৭)-এ বলা হয়েছিল, প্যালেস্তাইনে একটি আপাদমস্তক ইহুদি দেশ স্থাপিত হবে। যুদ্ধ শেষ হলে লুঠ-বোঝাপড়ায় আরব ভূমির বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। দশকের পর দশক প্যালেস্তাইনের যে বিষাক্ত ক্ষত এখন প্রত্যহ রক্তপাত ঘটিয়ে চলেছে, তার কার্যকারণ লুকিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই।