সম্পাদকীয় ২

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন

ভুল কথা দুই প্রকার। এক, যাহা অসত্য, ভ্রান্ত। আর দুই, যাহা— ঠিক হউক বা ভুল— ভুল লোকে বলে। গণতন্ত্রে দ্বিতীয়টি অধিক মারাত্মক। সাম্প্রতিক সমাবর্তনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর বক্তব্য লইয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। আচার্য তথা রাজ্যপালের হাত হইতে শংসাপত্র গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিয়া গীতশ্রী সরকার ঠিক করিয়াছেন কি না, সে বিষয়ে প্রকাশ্যে মতামত জানাইবার এক্তিয়ার পঞ্চায়েত মন্ত্রীর নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

ভুল কথা দুই প্রকার। এক, যাহা অসত্য, ভ্রান্ত। আর দুই, যাহা— ঠিক হউক বা ভুল— ভুল লোকে বলে। গণতন্ত্রে দ্বিতীয়টি অধিক মারাত্মক। সাম্প্রতিক সমাবর্তনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর বক্তব্য লইয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। আচার্য তথা রাজ্যপালের হাত হইতে শংসাপত্র গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিয়া গীতশ্রী সরকার ঠিক করিয়াছেন কি না, সে বিষয়ে প্রকাশ্যে মতামত জানাইবার এক্তিয়ার পঞ্চায়েত মন্ত্রীর নাই। কোনও মন্ত্রী, তথা সরকারি আধিকারিক নিজের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করিয়া কথা বলিতে পারেন না। বলিলে তাহা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আঘাত করা হয়। যে কোনও বিষয়ে তাঁহার ব্যক্তিগত মতামত থাকিতেই পারে। কিন্তু তাহা নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলেই বলিতে হইবে। জনসমক্ষে তাহা বলিলে তাহা কেবল সৌজন্যের অপলাপ হয় তাহাই নয়, গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিধিভঙ্গও হইয়া থাকে। ফলে সুব্রতবাবুর মন্তব্য ঠিক কি না, যুক্তিযুক্ত কিংবা সমর্থনযোগ্য কি না, সেই প্রশ্নগুলি অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়ে। তাই সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে প্রমুখ মন্ত্রী যাদবপুরের সাম্প্রতিক সংকট লইয়া যে সকল মন্তব্য করিতেছেন, তাহার পক্ষে-বিপক্ষে বহুবিধ মন্তব্য শোনা যাইতেছে। বিশেষত দলের অবস্থান হইতে ভিন্ন অবস্থান লইবার ফলে কী রাজনৈতিক বার্তা আসিতেছে, ছাত্র আন্দোলন বিষয়েই বা দলের ও দলীয় মন্ত্রীদের অবস্থান কী, তাহা লইয়া বিস্তর চর্চা হইয়াছে। কিন্তু দুই মন্ত্রীর মন্তব্যের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি হইল, তাহা অনুচিত। কারণ বক্তার ঔচিত্যবোধের অভাব হইতে সেই মন্তব্য করা হইয়াছে। তাই বক্তব্যের সারমর্ম লইয়া আলোচনা এ ক্ষেত্রে নিরর্থক হইয়া পড়ে।

Advertisement

এ প্রসঙ্গে যদি কোনও প্রশ্ন করিতেই হয়, তবে তাহা ইহাই যে, গণতন্ত্রে ছয় দশক পার করিয়াও কেন এই দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলি রপ্ত হইল না? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাহার অন্দরে যাহা কিছু প্রশাসনিক সংকট, তাহা লইয়া কথা বলিবার অধিকার রহিয়াছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই। এমনকী শিক্ষামন্ত্রীও তাহা লইয়া প্রকাশ্যে মন্তব্য করিতে পারেন না। মন্ত্রীদের কাজ নীতি নির্ধারণ। কোনও বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত কি না, উচ্চশিক্ষাকে বৃত্তিমুখী করিবার অধিক ঝোঁক ক্ষতিকর হইতেছে কি না, এই বিষয়গুলি লইয়া তাঁহারা বিতর্ক করিতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত লইতেছেন তাহা ঠিক কি না, কর্তৃপক্ষের সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা যাহারা করিতেছেন তাঁহারা সমর্থনযোগ্য কি না, এই কথাগুলি বলিবার অধিকার শিক্ষামন্ত্রী কিংবা মুখ্যমন্ত্রীরও নাই। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারও নাই। এগুলি একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামার্স মহিলাদের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষমতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়া তীব্র বিতর্কে জড়াইয়াছিলেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাহা লইয়া কোনও মন্তব্য করেন নাই। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজেও নানা প্রশ্নে ছাত্র আন্দোলন হইয়াছে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীরা তাহার সমর্থন বা নিন্দা করেন নাই। কেবল আমাদের মন্ত্রীদের জানা দরকার, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই তাঁহাদের কাজ। আর তাহা করিতে গেলে অন্যের অধিকারকে সম্মান করিতে হইবে, নিজের এক্তিয়ারের বাহিরে গিয়া কথা বা কাজ, কোনওটিই করা চলিবে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement