দেশভাগের পর ও পারে জমিজমা, ছোট-বড় জমিদারি হারিয়ে এ পারে এসে বাবুরা ভূমিহীনের তরফে আন্দোলনে ঝাঁপ দিলেন। যেহেতু জমি থেকে আর তাঁদের আর কিছুই হারানোর রইল না, তাই লড়াইটা এ বার আপসহীন হলে ক্ষতি কী? এই সময় আবার ছিল ক্রমবর্ধমান সরকারি চাকরির জমানা। বাবুরা অনেকেই বি এ, বি এসসি, বি কম-এর জোরে চাকরির ভিড় বাসে অন্তত পাদানিতে জায়গাও পেয়েছিলেন। এর সুবাদে কলকাতার মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজে বামপন্থী সেল্ফ ফ্যাশনিং খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে শিক্ষিত, শহুরে বাঙালি চরিত্রের মজা, তার উত্কর্ষ, সৃষ্টিশীলতার অনেকটাই এই বামপন্থী আত্মনির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু মানতে হবে, ওই উত্কর্ষ ছিল মূলত আন্দোলনমুখী, কী করে আরও শিল্প, আরও পুঁজি আনা যায়, আরও বেশি চাকরি তৈরি করা যায়, ব্যবসাবাণিজ্যের পথ খোলা যায়, জোরটা তার উপর ছিল কমই। আমার পরিচিত কট্টর বামপন্থী এক ব্যাঙ্ককর্মীকে বলতে শুনেছি, ‘আমি যদি বেশ খাটি, তাতে শেষ পর্যন্ত টাটা-বিড়লারই লাভ।’ অতএব তাকে কখনওই সিটে পাওয়া যেত না।
তাই বলে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নন্দীগ্রাম-পর্বে কলকাতায় যাঁদের মিটিং-মিছিলের সামনের সারিতে দেখা যেত, তাঁদের এক জায়গায় রাখাটা ঠিক হবে না। এখনকার বুদ্ধিজীবীরা গোলকায়ন-পুষ্ট, নানা প্রজেক্ট, সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড, হিল্লি-দিল্লি, ফরেন ট্রিপ এবং এ রকম আরও দশটা ব্যাপারে আটকে আছেন। আগের জমানায় যাঁদের কফি হাউসে পায়জামা-পাঞ্জাবি, ঝোলা ব্যাগ ও হাতে চারমিনার-সহ দেখা যেত, এঁরা মোটেই তা নন। এখনকার কবি-শিল্পীরা মূলত পারফরমার। সরকারের ওপরতলার লোকদের সঙ্গে বোঝাপড়াও অন্য রকম। তখনকার বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিশীলতাও এঁদের নেই। ‘সুশীল সমাজ’ বা ‘বিদ্বজ্জন’ গোছের শব্দ ব্যবহারে এলিটিজম ছাড়াও যা প্রকট, তা হল কল্পনার দারিদ্র। ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’-এর অসৌজন্যে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিল এই সুশীল সমাজ। নতুন জমানায় যখন ভারী-ভারী বাক্যবাণী আসা শুরু হল, তাঁরা সম্ভবত তখন এতই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন যে টুঁ শব্দটি করার শক্তি রইল না। এরই মাঝে কেউ কেউ দানে-অনুদানে হেফাজতি হয়ে গেলেন, কতিপয় আটকে গেলেন সিবিআই-ইডির জালে, নেতৃস্থানীয়দের অমার্জিত কথাবার্তার মধ্যেই আবার কিছু কিছু তাত্ত্বিক খুঁজে পেলেন নতুন দিনের র্যাডিকাল রাজনীতির ইশারা।
সবচেয়ে মজার কথা, যে পরিবর্তনের স্লোগানে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের দলের লোকরাই আজ সবার আগে প্রতিবাদ করেন, যদি বলা যায় নতুন জমানায় পশ্চিমবঙ্গ পাল্টে গেছে। এখন স্পষ্ট, এ রাজ্যের পরিবর্তন হবে না, শুধু এখানকার লেখক-বুদ্ধিজীবীরা পরিবর্তিত হতে থাকবেন। সব মিলিয়ে আজ পশ্চিমবঙ্গে যা দেখছি, তা আসলে এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতা। এর শুরু বামফ্রন্ট আমলেই।
মার্ক্সবাদী দল?
সম্প্রতি কাগজে পড়লাম, মুকুল রায় বলেছেন, ভোটে জিততে হলে শুধু ভোটদাতাদের বিচারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না, চাই ‘প্যারালাল সিস্টেম’। এই জ্ঞান তিনি নাকি অর্জন করেছেন তাঁর স্কুলের এক শিক্ষকের থেকে। প্রাপ্ত জ্ঞানের স্বত্বাধিকার মুকুলবাবু হয়তো ভক্তি-শ্রদ্ধায় তাঁর স্যারকে দিয়েছেন, কিন্তু এর আসল কপিরাইট অবশ্যই বাম জমানায়। ‘প্যারালাল সিস্টেম’ কি নিছকই পেশিশক্তি? বাহুর জোর তো বটেই, কিন্তু এর সঙ্গে আছে অন্তত আরও তিনটি ব্যাপার। এক, সামাজিক পঁুজি। যেমন রাতবিরেতে অসুস্থ শিশুর জন্য অটো জোগাড় করার মতো আস্থাভাজন নানা কাজ। দুই, পৃষ্ঠপোষণ, অর্থাত্ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে সাহায্য পেতে পার্টির চ্যানেলে যেতে হবে। তিন, নজরদারি। সামাজিক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে খবর রাখা কে কোন দলের সঙ্গে আছেন এবং বেচাল করলে তার উপযুক্ত শাস্তি। গ্রামের মতো মৌখিক সমাজে নিজের পলিটিকাল আইডেনটিটি সাধারণ মানুষের পক্ষে লুকিয়ে রাখা শক্ত। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জনজোয়ারে ভেসে যাবার আগে, সিপিআইএম বহু দিন পর্যন্ত এই তিন তন্ত্রকেই অটুট রেখেছিল। এদের আরও বলিষ্ঠ করার জন্য তৃণমূলের নতুন সংযোজন: স্থানীয় ক্লাব। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প, বৃত্তি, পুরস্কার। যেমন কন্যাশ্রী। গ্রামে যে-সব পরিবার সারদায় টাকা খুইয়েছেন, তাঁদের কারও কারও বাড়িতে কন্যাশ্রীর কল্যাণে যদি কিছু টাকা অর্থ সাহায্য পৌঁছায়, কিছুটা সান্ত্বনা তো বটেই।
অনিল বিশ্বাসের বাচনভঙ্গিতে এক ধরনের নিস্পৃহতা ছিল, তাতে তিনি যা বলতেন, তা সংক্ষিপ্ত হলেও শুনতে বড় দীর্ঘ লাগত। অনেক সাক্ষাত্কারেই তিনি এ বক্তব্য রেখেছেন, ‘জনগণতান্ত্রিক’ বিপ্লব কবে আসবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। (দেওয়ালে লেখা রেলগাড়ির মতো লম্বা শব্দটা পড়তে ছেলেবেলায় খুব কষ্ট হত।) আপাতত তাঁর ওপর দায়িত্ব আছে, পার্টি যাতে প্রতি নির্বাচনে জিতে ফিরে আসে, তা নিশ্চিত করা। এখানেই পার্টির অনুগামীদের কাছে ‘প্যারালাল সিস্টেম’-এর নৈতিক বৈধতা।
আগামী বিপ্লবের জন্য অনিশ্চিত অপেক্ষার অন্য অর্থ, বর্তমানকে নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন থেকে ছাড়। বস্তুত, বাম আমলে রাজনৈতিকতার মূল মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াল, ফি বছর ভোটে জেতা। এর ফলে আঞ্চলিক স্তর থেকে উঁচুতলা পর্যন্ত, পার্টি নেতৃত্ব মধ্যমেধার কেজো লোকদের দিয়ে ভরে গেল। ফলে কোনও রকম পরীক্ষামনস্কতা প্রশ্রয় পেল না। চিন্তাভাবনা ছেড়ে দেওয়া হল কিছু সভাকবি, সভাতাত্ত্বিক, সভাশিল্পীদের হাতে। ‘হোক কলরব’-এর মতো ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক আন্দোলনকে আধা-সমর্থনের বেশি জানানো গেল না, অথচ তৃতীয় ফ্রন্টের দোহাই দিয়ে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে প্রকাশ কারাটের আজও উত্সাহের শেষ নেই।
পার্টির পুরনো মুখগুলোর প্রতি বাংলার মানুষ আস্থা হারিয়েছেন। অন্য দিকে, ৩৪ বছর ধরে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করে যাওয়ার ফলে ২৫ থেকে ৫৫— পার্টির এই বয়সি নেতৃত্ব সুবিধাবাদী মানুষে ভরে গেছে। এ জন্যই যত দিন চাকা ঘুরছে, তত দিনই ভাল। এক বার মুখ থুবড়ে পড়লে কোনও কমিউনিস্ট পার্টি আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। বহু হত্যা, বহু ধর্ষণ, ভোটে কারচুপি, শিল্পে মন্দা, সর্বোপরি সারদাকাণ্ড সত্ত্বেও তৃণমূল গত তিন বছরে ভোটের জমি হারায়নি এক রত্তি। এর একটি কারণ অবশ্যই গরিব মানুষের মন জয় করা নানা সরকারি নীতি। কিন্তু আরও একটি কারণ আছে, এবং তা হচ্ছে, গত দেড়-দুই দশক ধরে জমে ওঠা সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, যা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে আগ্নেয়গিরি হয়ে প্রকাশ পায়। এবং নিজেদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করার মধ্যে দিয়েই মানুষ ঠাহর করে, এবং এখনও করছে, কত গভীর ছিল সেই ক্ষোভ। এ মুহূর্তে এ কথা স্পষ্ট, গরিব মানুষ সিপিআইএম’কে নয়, তৃণমূলকেই নিজেদের দল বলে মনে করেন। একটি পপুলিস্ট দলের এই সাফল্য রাজনীতিকে অন্তঃসারশূন্য করে তুলতে বাধ্য।
বুদ্ধদেববাবু যখন তৃণমূলকে ‘অসভ্য দল’ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তা দর্পচূর্ণ এলিটের শূন্য আস্ফালনই বেশি মনে হয়। তিনি এত দিনে বুঝেছেন নিশ্চয়, তাঁর দলকে বর্জনের মধ্যে দিয়ে মানুষ কিন্তু ‘বাবু রাজনীতি’কেই বর্জন করেছেন। শিক্ষিত, আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের নেতৃত্বে জনসাধারণের সংসদীয় বামপন্থী দলের স্বপ্ন আজ এক রকম উবে গেছে। তৃণমূলকে ‘অসভ্য’ বলার থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক ভাষার কথা ভাবা। ভাষা আকাশ থেকে পড়ে না, আসে নতুন আদর্শের অনুশীলন বা প্র্যাকটিস থেকে। এ মুহূর্তে বাংলার যা সবচেয়ে বড় ঘাটতি, তা আদর্শের রাজনীতি। গ্রাম-শহরে আক্রমণ রুখতে পার্টি কি অহিংস প্রতিরোধের কথা ভাববে? হিংসা দিয়ে শাসক দলকে ন্যুব্জ করা যায় না, সিপিআইএম’কে বুঝতে হবে, তৃণমূল জমানায় রাজনীতির নতুন কোনও দুর্বৃত্তায়ন হয়নি, এখন যা হচ্ছে তার প্রায় সব কিছুরই কমবেশি সূচনা বাম আমলে। তাই পার্টিকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। অহিংস প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে শুধু আস্থা আনা নয়, নতুন আদর্শে দলকে সাজানো যাবে। বিমানবাবুরা ভোটের পাটিগণিতটা একটু বেশি করে ফেলেছেন।
আমি সিপিআইএম-এর এই পরিণতিতে খুব একটা অবাক নই। ‘বিপ্লবের অপেক্ষায় সংসদীয় কমিউনিস্ট দল’— এই আত্ম-সংজ্ঞায় আগামী দিনের বড় ছবি দিয়ে আজকের বুজরুকি ঢাকার চেষ্টা না থাকলেই অবাক হওয়ার কথা। বিপ্লব এক দিন ঠিকই আসবে, এই আস্থা নিশ্চয় সিপিআইএম-এর খুব সামান্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে অটুট আছে। কিন্তু মজাটা হচ্ছে, আসবে না জেনেও বিপ্লবের একটা ছকে দেওয়া লক্ষ্য (Telos) পার্টির ওপর এখনও নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক পুলিশি চালিয়ে যায়, মোটা দাগের শ্রেণি-সংগ্রামের গল্পের বাইরে যে-কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা দল বাঁকা চোখে দেখে। পুঁজিকে এরা না পারে ফেলতে, না পারে ধরতে। তার প্রকট উদাহরণ সিঙ্গুর।
পার্টিকে আজ প্রশ্ন করতে হবে, সে কি সত্যিই কমিউনিস্ট পার্টির তকমা পরে আধা লিবারেল, আধা কমিউনিস্ট হয়ে থাকবে, না কি নিজেকে এ দেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বামপন্থী লিবারেল দল হিসেবে পুনর্গঠন করবে? পুঁজি থাকবে, শ্রেণি-বৈষম্য থাকবে এবং আজকের দিনে সেই পুঁজিই পাওয়া যাবে, যা আজকের দিনের— এই সত্যিগুলোকে মেনে নিলে দলের নীতি, অ্যাজেন্ডা, স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এবং এরই সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের নৈতিকতা নিয়ে অনেক খোলামেলা চিন্তাভাবনা করা যায়।
লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ সংস্কৃতি-চর্চা ও সমাজতত্ত্বের শিক্ষক