এ বারের ভোটটা খুব পেকে উঠেছে। ভোটে কী হবে সেই অনিশ্চয়তার কারণে নয়। বড় ভোটে একটু অনিশ্চয়তা তো স্বাভাবিক। পেকে উঠছে কৌশলের জটিলতার কারণে। কৌশলগুলো কি রাজনীতিগত, না নির্বাচনগত? বিজেপি শুরুই করেছিল কাউকে শ্বাস ফেলতে না দেওয়ার মতো একটা ঘূর্ণি তুলে। বিজেপি তো বেশ অনেক দিনের পার্টি— যদি জনসঙ্ঘের সঙ্গে তার নাড়ির যোগটাকে ধরা যায়। ধরা না গেলেও অনেক দিনেরই। এতটাই অনেক দিনের যে, ভারতের কয়েকটি অঞ্চলের কিছু বিশেষ জনসমষ্টির কাছে বিজেপি রাজনৈতিক ভাবে গ্রাহ্য একমাত্র পার্টি। পার্টি মানে একমাত্র রাজনীতি। তেমনই আবার, কিছু বিশেষ জনসমষ্টির কাছে ও কিছু বিশেষ অঞ্চলে বিজেপির কোনও পাত্তাই নেই। এই অঞ্চলগুলিকে ম্যাপে ছকেও দেওয়া যায়।
বিজেপি এ বারের ভোট শুরুই করেছিল ছকা ম্যাপটিকে ভেঙে দিয়ে। প্রথমেই তারা তাদের পার্টির পুরনো সংগঠনটাকে ভেঙে দিল। আডবাণীর প্রায়ই পদত্যাগ ও প্রায়ই প্রত্যাহার, বিজেপির মুখ বলে পরিচিত নেতাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে দৃশ্যত একেবারে কোণঠাসা দশা। কোথায় কাকে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বা কোথায় কাকে দলের প্রার্থী করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিজেপি নেতাদের প্রকাশ্য অজ্ঞানতা, বিজেপির নেতারা কে কোথায় দাঁড়াবেন, সে সব ঠিক করতে বিজেপির মুখ বলে যাঁরা পরিচিত, সেই আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, মুরলী মনোহর, যশোবন্ত সিংহ একেবারে ছত্রখান। এক ও একমাত্র নেতা নরেন্দ্র মোদী। এক ও একমাত্র প্রচারক নরেন্দ্র মোদী। এক ও একমাত্র বিষয় গুজরাত মডেল।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দখল নেওয়ার ভিত হয়ে দাঁড়াল নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি দখল।
এই প্রক্রিয়ায় একটা বেশ বড় গিঁট তৈরি হয়ে গেল নির্বাচন প্রস্তুতির পরের ধাপে। ভোটাররা বিজেপি’কে খুঁজে পাচ্ছেন না। যে নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বিজেপি বলছেন, তাঁকে বিজেপির ভোটাররা গত ৩৭ বছরের বিজেপি বলে চেনেনই না। তাঁরা, বিজেপির ভোটাররাই, নরেন্দ্র মোদীকে যেটুকু চেনেন, তা গুজরাতের ২০০২ সালের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই চেনেন। সারা ভারতে গোধরা-দাঙ্গার যাঁরা সমর্থক, তেমন গোঁড়া ও রগচটা হিন্দুরা নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাতের গোঁড়া জবরদস্ত হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই চেনেন। গুজরাতের উন্নয়নের মডেল নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ভারতজয়ে বেরিয়ে তাঁর পার্টির জায়গায় নিজেকে বসালেন। প্রচারের দ্বিতীয় ধাপে তাঁর পার্টির সমর্থকরাই তাঁকে গুজরাতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজের পার্টিটাকে একটু বেশি মেরে ফেলেছেন। তাঁর অতি-কর্তৃত্বে অতি-নিহত সেই পার্টিটা, অতিদ্রুত অতিশয় ভূত হয়ে নরেন্দ্র মোদীকে খেতে বসবে না তো?
খুব বড় বড় নদীর যতটা স্রোত, তার চাইতে অনেক বেশি জায়গা ছাড়া রাখতে হয়, নইলে আচমকা বান বা ভাঙন সামলানো যায় না। ভারতের মতো বড় দেশে— আকারে ও জনসংখ্যায়— রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে এমন ছাড়জায়গা রাখতে হয়। নরেন্দ্র মোদী বিজেপির সেই ছাড়জায়গা বন্ধ করে দিলেন। ফলে বাজপেয়ী, পুরনো জনসঙ্ঘ, এই সব ধরে ধরে যে সব রাজ্য-ক্ষমতার শাসক পার্টি ভোটের পরের জোটের কথা ভেবে বিজেপির দিকে খিড়কি দরজা আধখোলা রেখেছিলেন, তাঁরা দেখলেন বিজেপি নেই, আছেন নরেন্দ্র মোদী, তখন তাঁরা সাত তাড়াতাড়ি বিজেপির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। খিড়কি দরজাও।
নীতীশ না-হয় আগেই দরজা সেঁটেছেন। ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁরা প্রচারের দ্বিতীয় স্তরে মোদীর প্রকাশ্য বিপক্ষতায় নেমে গেছেন। এই রাজ্যগুলিকে বাদ দিয়ে শুধু কর্নাটক, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থান দিয়ে লোকসভার প্রধান দল হওয়া সম্ভব?
নরেন্দ্র মোদী আর একটা অতিকৌশল খাটালেন। তাঁর নিজের ও বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষের জনধারণা কাটাতে তিনি বেছে বেছে কিছু মুসলিম-এলিট জোগাড় করলেন। তাঁদের কেউ কেউ কোথাও কোথাও প্রার্থীও হলেন। কেউ কেউ প্রধানত নরেন্দ্র মোদী যে উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়েছেন, তাতে মুসলমানদের উপকার হবে— এমন জনমত তৈরির চেষ্টায় একটু-আধটু মুখ খুললেন।
এক দিকে গুজরাতের উন্নয়ন মডেল, আর এক দিকে হিন্দুদের সর্বতীর্থসার বারাণসীতে দাঁড়ানো, মুসলিম এলিটদের দিয়ে তাঁর ও বিজেপির মুসলিমপ্রীতির পক্ষে বিবৃতি, আর অমিত শাহকে উত্তরপ্রদেশে এনে বসিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে দগদগে করে তোলা— এই কর্মসূচির ধারাপাত অনুসরণ করলেন নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি। আসলে, নরেন্দ্র মোদী মুসলিমদের চেনেন না, মুসলিম এলিটরাও আধুনিক মুসলিমদের চেনেন না। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও গোধরা-দাঙ্গা মুসলিমদের এটুকু আত্মরক্ষাপ্রবণ সচেতনতা দিয়েছে: স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে তাঁদের বাঁচতে হবে পরীক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজনের, সংগঠনের ও পার্টিগুলির— মানে রাজনীতির— সঙ্গে থেকে এবং প্রমাণিত সাম্প্রদায়িক, ধর্মদ্বেষী মানুষজনের ও পার্টিগুলির— মানে রাজনীতির— বিরোধিতা করে। লোকসভার ১২৬টি আসন মুসলিম ভোটনির্ভর। ইতিমধ্যেই বিহারে ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ভোট নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির বিরুদ্ধে সংগঠিত চেহারা নিয়ে ভোটের বুথে লাইন দিয়ে ফেলেছে। বারাণসীতে মোদী-বিরোধী ভোটের বিভাজন ঠেকাতে আনসারি ঘোষণা করেছেন যে তিনি দাঁড়াবেন না।
২০০০ সাল থেকে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বিজেপির দাপট কমতে থাকে। তরুণ মুসলিমদের নানা রকমের আধুনিক সংগঠনের প্রতিপত্তি এই সময়ই বাড়তে থাকে। মুসলিমরা সরকারি চাকরিতে ভাগ চাইতে শুরু করেন। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে এই মুসলিম ভোটই উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে ২১টি আসনে জিতিয়েছে।
ভোটকেই প্রাথমিক লক্ষ্য ধরে নিয়ে রাজনৈতিক কুশলতার অব্যবহিত বিন্যাস তৎপর হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের প্রধানের সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক দলের আকাঙ্ক্ষী প্রধানের সেই তৎপরতায় অদ্ভুত কিছু মিল ও অমিল চোখে না-পড়ে পারে না।
নরেন্দ্র মোদীকে আগে বিজেপি দখল করতে হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সর্বাগ্রে তাঁর তৃণমূলকে রক্ষা করতে হল।
নরেন্দ্র মোদী বিজেপির ওপর তাঁর দখল কায়েম করতে পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত নেতাদের কোণঠাসা করে কিছু নতুন নেতা ও এলিট-নেতাকে জায়গা করে দিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলকে রক্ষা করতে পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারের কাজে না লাগিয়ে এলিট-আগন্তুকদের একেবারে সামনের সারিতে এনে দিলেন— মিঠুন, দেব প্রমুখ।
কোচবিহারে, তুফানগঞ্জে তৃণমূলের জন্য দেবের রোড-শোতে ভিড়ের চাপে মানুষজন অসুস্থ ও জখম হচ্ছেন। দার্জিলিং কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থীর সঙ্গে মিঠুন নাচছেন ও নাচের শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনের হাত ধরে উপরে তুলছেন। মোদী ঝড় তুলবেন ভেবেছিলেন। তুললেন মমতা। কিন্তু কেন্দ্রে নয়, সীমান্তে। নির্বাচনের কেন্দ্রীয় মঞ্চে মমতা একমাত্র মিঠুনকে তাঁর সঙ্গে মঞ্চে থাকার অধিকার দিয়েছেন।
এই মিল ও অমিল রাজনীতি হিসেবেই লক্ষণীয়, না কি নির্বাচন কৌশল হিসেবে?