দাগি সাংসদ বা বিধায়ককে মন্ত্রী করা উচিত কি না, এই মর্মে জনস্বার্থ মামলাটির রায়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছে, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদেরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তাঁরা যে মন্ত্রী নিয়োগের সময় আপত্তিকর সিদ্ধান্ত নেবেন না, সেই আস্থা সুপ্রিম কোর্টের আছে। স্পষ্টতই এই উক্তিতে একটা নৈতিক অনুজ্ঞা নিহিত আছে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের কী কর্তব্য, কী নয়, সে বিষয়ে অনুজ্ঞা। এই রায়ের সূত্রে দু’একটা প্রশ্ন ওঠে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। সেই দলের সংসদীয় নেতারই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। তিনিই রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সম্ভাব্য মন্ত্রিপরিষদের গঠন সম্পর্কে জানাবেন। রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে নিয়োগ করবেন। সুপ্রিম কোর্ট হয়তো আনুষ্ঠানিক ভাবে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে নৈতিক বার্তা দিতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কথা হচ্ছে, তাঁরা তো দলীয় নেতা। কার্যক্ষেত্রে তাঁরা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে চলতে পারেন না। হয়তো চানও না। তাই তাঁদের প্রতি নৈতিক অনুশাসন কতটা কার্যকর বা প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।
এ দেশে সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা ক্রমশই দলতন্ত্রের কবলে গেছে। জনসাধারণ ‘পাবলিক’ হয়ে গেছেন। তাঁরা যা খান, তা-ই নাকি রাজনীতি। অ্যারিস্টটল এই জন্যই হয়তো ‘ডেমোক্র্যাসি’ আর ‘পলিটি’র মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, ডেমোক্র্যাসিকে অধঃপতিত আর পলিটিকে উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থার নমুনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মুশকিল হল, যুক্তিনির্ভর সাংবিধানিক রাজনীতির যে অবয়বকে ‘পলিটি’ বলা যেতে পারে তা নির্বাচন-সর্বস্ব দলীয় রাজনীতির কাছে আজ আর আশা করা যাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট তার রায় দানে বি আর অম্বেডকরের বক্তব্য তুলে ধরেছে, কিন্তু বাস্তব এটাই যে, অম্বেডকরের রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে এখন আর কেউই প্রায় রাজনীতিতে যোগ দেন না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম তো নিয়মেরই প্রমাণ।
কে নেতা হবেন, কে মন্ত্রী হবেন তা অবশ্যই দলীয় ব্যাপার। কিন্তু তাঁদের যোগ্যতার প্রশ্নটি যদি দল উপেক্ষা করে, তবে জনসাধারণের অধিকার আছে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ দাবি করার। বিশেষত, এই সূত্রে যখন একটি পূর্ববর্তী রায়ে জনপ্রতিনিধিত্বের যোগ্যতার বিষয়টি আদালতই স্থির করে দিয়েছিল। ‘ডেমোক্র্যাসি’ ঠিক ভাবে না চললে ‘পলিটি’-র প্রশ্ন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই যদি গুরুতর অভিযোগ থাকে? প্রমাণ না-থাকলেও, চার্জশিট পেশ না-হলেও, জনভাষ্যের একটা গুরুত্ব থাকে। সাধারণ মানুষ যদি তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন যে, যাঁর হাতে দেশের শাসনভার তাঁর অতীত সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন আছে এবং যতক্ষণ তার নিরসন হচ্ছে যথেষ্ট স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না, তখন কী হবে? একটি নির্বাচনে জয়লাভ করতে গেলে যে উপাদানগুলিকে সদা সচল রাখা প্রয়োজন, যেমন অর্থ ও বাহুবল, তা সাধারণ মানুষের নাগালে নেই। কিন্তু ভোট দিয়ে কাউকে একটা নির্বাচন করে শাসনভার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদেরই। অথচ এর পর তাঁদের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের ‘শুভবুদ্ধি’র উপর নির্ভর করতেই হয়। প্রশ্ন হল, সর্বোচ্চ আদালতের কাছেও সেই ‘শুভবুদ্ধি’ই কি তবে শেষ কথা?
যাঁদের ‘শুভবুদ্ধি’র উপর ভরসা, তাঁরা যদি তা থেকে রহিত হন, তখন কী হবে? বাহুবলীদের উপর ভরসা রেখে বা অর্থবানদের পকেট কেটে নির্বাচনে জয়লাভ করে তাঁদের স্বার্থ উপেক্ষা করা চলে কি? সরকার উল্টে যাবে না? গণতান্ত্রিক জনমত যতই প্রশ্ন তুলুক, বিতর্কে লিপ্ত হোক, আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর স্বপ্ন লালন করুক, ভোটে জিতে সরকার গঠন অন্য বিষয়। ‘সরকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হোক’ বলা সহজ। কী ভাবে হবে, তার পথনির্দেশ করবে কে? সরকার নিজেই?
সংবিধান সংশোধন করার অধিকার আইনসভার। সে ক্ষেত্রে আদালত শুধুমাত্র মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রাখার কথা বলতে পারে। সাংবিধানিক প্রধান প্রতীক মাত্র। মূল বা প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের হাতে। তাঁদের শুভবুদ্ধির উপর নির্ভর করে থাকা আর একটি দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ সহযোগে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থাকা একই কথা নয় কি? বিশেষত যে দেশে এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন!
বৃহত্তর যে প্রশ্নটি সাংবিধানিক বলয়ের বাইরে অবস্থান করে অথচ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক তা হল, রাজনীতি আর অপরাধ জগৎ কী ভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়? এ কথা ঠিক যে শাসকের বিরোধিতা করার জন্য মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করে অপরাধী সাজানো হয়। এমন নিদর্শন আমাদের চার পাশে ঢের আছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলই নয়, সামাজিক স্তরেও নানা গোষ্ঠীপতির অত্যাচারের ধরনগুলি একই রকম। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যদি প্রতিরোধ আসে তখন তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। জীবনসংখ্যানের এই গাথাগুলি বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তার সঙ্গে রাজনীতির ক্ষমতা কাঠামোর ওতপ্রোত সম্পর্ক। প্রশাসন কখনও নীরব, কখনও বা বিপরীত ভাবে সক্রিয়। হাত-কাটা, কান-কাটাদের সঙ্গে রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুদের তীব্র মোহব্বত। ভোটের দিন বুথের দখল নিতে বা জনগণকে করকে দিতে এদের জুড়ি নেই। এই প্রক্রিয়াটির ফলে রাজনীতিক নিজেও কখনও কখনও জড়িয়ে পড়েন অপরাধের চক্রে। অন্যান্য হাতছানি তো রয়েইছে।
প্রশ্ন হল, আমাদের দলীয় রাজনীতির কি সেই যোগ্যতা আছে যে ভোটনিরপেক্ষ ভাবে আত্ম-সংশোধনের একটি প্রক্রিয়া জারি থাকবে? নানা নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে একাধিক বার সচেষ্ট হওয়া গেছে। কিন্তু অম্বেডকরের মতো মানুষদের কি রাজনীতিতে যথেষ্ট বেশি সংখ্যায় আনা হচ্ছে? না কি যাঁরা আসছেন তাঁদের অতীত সম্পর্কে কিছু বলার না-থাকলেও রাজনীতিতে যোগদানের অব্যবহিত পরেই কেউ কেউ অর্থ ও বাহুবলের মোহে অপরাধ জগতের ভাষায় কথা বলছেন এবং সেই মোতাবেক কাজও সারছেন। ক্ষমতা এখন আর উচ্চ সমাজকর্মের জন্য ব্যবহৃত না-ও হতে পারে। নিছক অর্থ উপার্জন আর দাপট বৃদ্ধিই হয়তো রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতিতে জনস্বার্থের প্রতিফলন কী ভাবে হবে? বরঞ্চ ভারতীয় অতীত অনুযায়ী সামাজিক আন্দোলনই পারে নতুন চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির জন্ম দিতে। সমাজকর্ম দিয়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। মধ্যযুগের ভারতে ভক্তি আন্দোলন তা সম্ভব করেছিল। এই বাংলায়ও। যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে ‘রেপ করিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন এক সাংসদ, তার অদূরে এক বঙ্গসন্তান ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে বিপুল তর্ক তুলেছিলেন সেই মধ্যযুগে। আত্ম-পর ভেদ ছিল না তাঁর। সবার জন্য পঙক্তি-ভোজন ও একত্র সমাবেশ তাঁরই অবদান। অগণন্ত্রের সেই যুগে নিমাই পণ্ডিত ছিলেন আলোকবর্তিকা।
গণতন্ত্রের আধুনিক যুগে অপরাধ ও রাজনীতির যুগলবন্দি জমে উঠেছে। এই দুটিকে সামাজিক আন্দোলনের ‘ধারাবাহিকতা’ই বিচ্ছিন্ন করতে পারে। চাই সচেতন জনমত আর কতিপয় দলবিহীন মন।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক