সন্ধান। ‘জয় কিষান অভিযান’-এ যোগেন্দ্র যাদব। গুড়গাঁও। ২১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
ক্ষমতায় আসার পর প্রথম আন্দোলনটি এ বার শুরু করেছে ‘আপ’। জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স-এর বিরুদ্ধে তাদের নতুন ‘লবণ আন্দোলন’-এর প্রধান নেতা যোগেন্দ্র যাদব। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে, এই ‘জয় কিষাণ’ অভিযানের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছাড়াও একটা বৃহত্তর লক্ষ্য আছে। সব রঙের সব রাজনীতিকই যে আসলে শেষ পর্যন্ত একই কথা বলেন, একই পথে চলেন, ক্ষমতায় এসে একই কায়দায় ক্ষমতায় আসার আগেকার প্রতিশ্রুতিগুলি ভঙ্গ করেন, সেই ধারাটির প্রতিবাদ করাই তাঁদের আন্দোলনের লক্ষ্য। উদাহরণ অবশ্যই মোদী সরকার। আন্দোলনকারীদের সামনে বক্তৃতায় যোগেন্দ্র যাদব সেই কথাটিই তুলে ধরলেন: দুই বছর আগে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে ১ লক্ষ কোটি টাকার নয়ছয়, ব্যাপক সরকারি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল বিজেপি। অথচ ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু সেই একই পথে হাঁটছে। কংগ্রেসের কৃষকবিরোধী নীতির বিরোধিতা করে ক্ষমতায় এসে বিজেপি-ও একই নীতি অনুসরণ করছে। যোগেন্দ্র যাদবদের ‘লবণ’কে প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণটিই এই আস্থা-ভঙ্গ। লবণ হল বিশ্বস্ততার প্রতীক। নেতাদের দোরে দোরে ঘুরে তাঁদের হাতে লবণ তুলে দিয়ে আন্দোলনকারীরা মনে করাতে চান— কেউ কথা রাখেনি, কিন্তু তবু, ‘কথা রাখা’র আশাতেই রয়েছেন দেশের মানুষ।
দিল্লির শাসক দল হয়েও আন্দোলনের পথ কেন, এমন একটা প্রশ্ন উঠবে নিশ্চয়ই। তার উত্তর দিতে গেলে ‘আন্দোলন’ শব্দটি আর এক বার ভেবে দেখা ভাল। আন্দোলন কি কেবলই শাসক দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন? অর্থাত্ এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারে আসীন দলটির আন্দোলন? আন্দোলনের কিন্তু একটা অন্য মানেও হতে পারে: ধাক্কা দিয়ে একটা দোলন কিংবা চলন শুরু করা, অন্য কোনও অভিমুখে দুলিয়ে দেওয়া।
আপ-এর ক্ষেত্রে অন্তত এই ধাক্কা বা দোলনের প্রকল্পটাকে নেহাত কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দিল্লি নির্বাচনের আগে অঞ্চলে অঞ্চলে আপ কর্মীরা মাটি আঁকড়ে থেকে বুঝিয়েছেন কেন আমার আপনার সকলের নতুন ভাবে চিন্তা করা দরকার, নতুন পথ বার করা দরকার। ৪৯ দিনের সংকটসঙ্কুল দিল্লি শাসনের পালা যখন শেষ হয়েছিল, তখনও নাকি এই কর্মীরা পাততাড়ি গুটিয়ে পালাননি, বরং প্রত্যেক নির্বাচনী কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে জনসংযোগ ও জনচেতনা উন্মেষের কাজটা করতে থেকেছিলেন। এই অর্থে তাঁদের কাজটা ছিল প্রথমত সামাজিক, তার পর রাজনৈতিক। তা, আন্দোলনের মধ্যে যে সামাজিক উন্মেষের লক্ষ্য, এক বার ক্ষমতাসীন হয়ে গেলে যে সেটা বন্ধ রাখতে হবে, এমন কোনও কথা তো থাকতে পারে না! আপ-এর অন্যান্য অ্যাজেন্ডার মতো এই কথাটার মধ্যেও বিরাট নতুন কিছু নেই, কিন্তু একটা স্পষ্টতা আছে, অন্য রকম করে ভাবার সাহস আছে। সেটা অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক।
কিন্তু ৭০-পয়েন্ট নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় আপ জিতে আসার পরও যে প্রশ্নটা অশান্তির তরঙ্গ তুলেছিল, আজ যোগেন্দ্র যাদবদের আন্দোলন দেখেও সেই একই চিন্তার উদয় হয়। বিজেপি-র বিরুদ্ধে এই যে তাঁদের পুরনো রাজনীতির নতুন মোড়কের অভিযোগ, এটাতে শেষ পর্যন্ত আপ-নেতারা নিজেরাও প্রভাবিত বা নিমজ্জিত হয়ে যাবেন না তো? প্রশ্নটা উঠছে এই জন্য যে, জনবিরোধী রাজনীতির গড্ডলিকা পথটি তো কোনও রাজনৈতিক দলের একচেটিয়া নয়! রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজের যে ত্রিকোণ সম্পর্কটা আপাতত দৃশ্যমান, তারই অবধারিত ফল এই পথ। ক্ষমতায় যে-ই আসে, সে-ই শেষ পর্যন্ত রাজ-অলিন্দের কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা এই ত্রিকোণ গর্তের ফাঁদে পা দিয়ে তলিয়ে যায়। বাজার-অর্থনীতির নামে একটা বিকৃত, সীমিত, দুর্নীতিগ্রস্ত, সম্পর্কপোষণ-ভিত্তিক অর্থনীতির প্রবল প্রবাহে টুপ করে ডুবে যায় যাবতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক দায় ও দায়িত্ব। নেতৃসমাজের সঙ্গে জনসমাজের এই অবধারিত বিসংযোগ কাটিয়ে ওঠা নিশ্চয়ই তত সহজ নয়, যতটা যোগেন্দ্র যাদবরা বলছেন?
আন্দোলন, আবার
তবু তাঁরা বলছেন। এবং শুনতে শুনতে একটা পুরনো আদর্শ, পুরনো দায়বদ্ধতার রাজনীতির কথা আমাদের মনে পড়ছে। এবং ভাবার অবকাশ হচ্ছে যে, সমাজতন্ত্র বা নেহরুতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত যে সব আদর্শকে ইতিমধ্যেই ত্যাজ্য বলে ভাবা হচ্ছিল, সেগুলো তবে তত ত্যাজ্য নয়! নেতৃত্বের লাগাতার ব্যভিচার, অনাচার, অবিচার দেখতে দেখতে ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ হয়ে অর্থহীন অনৈতিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিকদেরই আসলে আমরা ত্যাগ করতে চাই, সেই রাজনীতির পুরনো আদর্শগুলোকে ত্যাগ করতে চাই না। না হলে, ২০১৪ সালে যারা কংগ্রেসের অনেকটা সমমনোভাবাপন্ন অ্যাজেন্ডাকে সমূলে বর্জন করেছিল, ২০১৫ সালে তারাই কেন আবার আপ-এর মৌলিক জনমুখী অর্থনীতির আশ্বাসের উপর ভরসা রাখে? যে মোদীর নামে গোটা দেশের মতো রাজধানীও ভেসে গিয়েছিল, সেই মোদীর থেকে নয় মাসের মধ্যে দিল্লি কেন সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয়? ঝুড়ি ঝুড়ি জনমুখী সংস্কার সমেত কংগ্রেস রাজপুত্রের ব্যালট-কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সামান্য বিজলি-পানির প্রতিশ্রুতিতে ছাপ দিয়ে আপ-এর মাফলার-নেতাকে কেন ভোটসাগরে ভাসিয়ে আনে? সন্দেহ নেই, এর মধ্যে একটা দোলাচল আছে। ‘আন্দোলন’ আছে। অবিশ্বাস-কণ্টকিত দুর্দান্ত এই দোলাচলের মধ্যে বিশ্বাসের ঢেউ তুলে মানুষকে আবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধিয়েছে যারা, তাদের আন্দোলনকারী না বলে উপায় কী।
এখানে একটা কথা বলার আছে। এন-রেগা বা একশো দিনের কাজ বা খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প ইত্যাদি ইউপিএ সরকারের জনমুখী সংস্কারের অভিমুখটা ঠিক যে দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ছিল, সেটা তো এই দিল্লির জনসমাজ নয়। বরং আপ-এর যে মধ্যবিত্ত কিংবা শহুরে নিম্নবিত্তমুখী অ্যাজেন্ডা, সেটাই দিল্লির জন্য একেবারে উপযুক্ত, তার জয় না হওয়াই কঠিন। নিজের এই মূলত নাগরিক চরিত্রের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই নিশ্চয় আপ-এর কিষাণমুখিতার আন্দোলনের পুনঃপ্রয়াস। দেখা যাক না, তার কতখানি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় কৃষিমুখী ও কৃষিজীবী সমাজের কাছে। কিন্তু এ সবের চেয়েও বড় কথা, কেবল সংস্কারের প্রয়াসই যে যথেষ্ট নয়, কে সেই প্রয়াস করছে, কী ভাবে করছে, সেটাও মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কংগ্রেসের ব্যর্থতাই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, রাহুল গাঁধীর মতো নেতা, কিংবা এ রাজা বা পবনকুমার বনশলের মতো মন্ত্রী তৈরি করে ‘জনমুখিতা’র রাজনীতি তৈরি করা মুশকিল। তার জন্য ‘অন্য কিছু’ দরকার। বোধহয় একটা আদর্শ, একটা আস্থা। সেই আদর্শ বা আস্থার কিছু স্পষ্ট আভাস কেজরীবাল-যাদবদের দল ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে; জনমুখিতার অন্যান্য দাবিগুলিও তারা পূরণ করতে পারবে কি না, এটাই এখন প্রশ্ন।
একটা শব্দ এখন বড্ড বেশি ব্যবহার হয়: ‘ইনক্লুসিভ’। বিজেপি-র ভাবনাচিন্তার মূলেই যেহেতু এই সমন্বয়বাদিতার অভাব, কংগ্রেস তার ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সার্বিক উন্নয়নের মডেল দিয়ে এবং সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার ‘ইনক্লুসিভ’ আদর্শ দিয়ে একটা ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতি তৈরি করবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। সেই প্রত্যাশা এই মুহূর্তে দুমড়ে মুচড়ে ধ্বস্ত বললে অত্যুক্তি হবে না। কংগ্রেসের উন্নয়নের সর্বজনীনতার দাবি যেমন রোধ করে দাঁড়ায় তার কু-নেতৃত্ব নিজেই, একই ভাবে, সামনে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আউড়ে পিছনে ধর্মতোষণের কংগ্রেসি চালও তেমনই আজ নিপাট স্পষ্টতায় উজ্জ্বল।
বরং আপ-এর মধ্যেই একটা নতুন ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতি আজ দেখতে পাওয়া সম্ভব। তাদের ছোট ছোট বিজলি-পানি সংস্কারের অ্যাজেন্ডার মধ্যে একটা সর্বজনীনতার সম্ভাবনা উঁকি মারছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে, এর জন্য শত কোটি টাকার বাজেট ধার্য না করলেও চলবে, এবং, হয়তো, বিকৃত অর্থনীতির দ্বারস্থ না হলেও কাজ চলে যাবে। দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার মহান বাণী নিয়ে উঠে-পড়ে না লেগে কাজের কাজটুকু করলেও হয়তো ধর্ম জাতি বা অন্য সব আইডেন্টিটির বেড়াগুলো টপকানো যাবে। লক্ষণীয়, কেজরীবালদের শাহি ইমামের আশীর্বাণীর উপরও ভরসা করতে হয়নি, ত্রিলোকপুরী দাঙ্গার পরও দলিতদের কাছে টানার জন্য হিন্দুত্বের দ্বারস্থ হতে হয়নি। একটা দিকেই তাঁরা একাগ্র লক্ষ রেখে গিয়েছেন। সেটা হল, সংখ্যালঘুদের (নিহিতার্থে মুসলিমদের) দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাধাবিপত্তিগুলো সরানোর দাবিদাওয়া। সংস্কারের কাজে তাদের কোনও বৈষম্যের শিকার না হতে দেওয়া। বিপক্ষের পাতা ফাঁদটা বুঝে নিয়ে সেটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে নিজের মতো করে খেলার এই কায়দাটা অন্তত দিল্লির নির্বাচনে কেজরীবালকে খুবই সাহায্য করল।
অর্থাত্ বলা চলে, ছোট ছোট দৈনন্দিনতার সংস্কারের মধ্য দিয়ে আপ রাজনীতিতে একটা নতুন সামাজিক (এবং রাজনৈতিক) ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা সমন্বয়বাদ উঁকি দিচ্ছে। দেখাই যাক না, এই ছোট ছোট আদর্শের পথের উপর ভরসা করে চলতে চলতে জনমুখিতার রাজনীতি আর জনমনোরঞ্জনের (পপুলিস্ট) রাজনীতির মধ্যে আপ নেতৃত্ব একটা পার্থক্য বজায় রাখতে পারে কি না। জনমুখী রাজনীতি হয়তো আজও চলনশীল রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে, তেমন তেমন নেতৃত্ব পেলে।
এই নতুন সর্বজনীন রাজনীতি আরও একটা আশা জাগায়। রাষ্ট্রের দিকে চেয়ে বসে না থেকে নাগরিকের নিজের হাতগুলি সরাসরি রাষ্ট্র গড়ার কাজে লাগানোর আশা। ছোট ছোট কাজ যখন, সে তো নিজেরাও করা যায়, ছোট সংস্কারের স্বপ্ন পূর্ণ করার চেষ্টায় নিজেরাও লাগা যায়। একেই হয়তো ‘পার্টিসিপেটরি ডেমোক্র্যাসি’ বা অংশগ্রহণের গণতন্ত্র বলে। আজ সত্যিই আর আধুনিক গড়নের ‘রেপ্রেজেন্টেটিভ ডেমোক্র্যাসি’ বা প্রতিনিধিত্বের গণতন্ত্রকে একেবারে ছেড়ে দিয়ে সেই প্রাচীন আথেন্স-এর অংশগ্রহণের গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক মডেলটার মধ্যে প্রাচীন মডেলের ব্যবহারটুকুও কি অসম্ভব? আপ-কে দেখে আশা হয়, হয়তো এই দুই মডেলের মিশেল তেমন কোনও চেষ্টার অপেক্ষায় রয়েছে। এই নেতারা না পারলেও হয়তো অন্য নেতারা এঁদের দেখে উঠে আসবেন। চেষ্টাটা করতে পারবেন।
মুহূর্ত
এক দিকে ভয়, অন্য দিকে আশা: ভারতীয় গণতন্ত্রে এমন একটা দ্বন্দ্বদীর্ণতা যে এই ২০১৫ সালেও আসতে পারল, এটাই কিন্তু আপ-এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। অদ্ভুত একটা আশাময় মুহূর্ত এখন। নির্ঘাত সেটা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু স্থায়িত্বের কথা ভুলে অন্তত কিছু কাল মুহূর্তটাকে উদ্যাপন করা যাক।