সম্পাদকীয় ১

ভাষণ নহে, শিল্প

সভামঞ্চ হইতে শ্রোতাদের আসনের দূরত্ব অলঙ্ঘ্য। দূরত্বটি প্রতীকী। তাহা প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের দূরত্ব, ক্যালেন্ডারের পাতার হাজার বদলও যে দূরত্বকে মুছিতে পারে না। নেতারা আসিবেন, মঞ্চ হইতে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিবেন, তাহার পর তাঁহাদের ফিরতি কনভয়ের চাকার ধূলির সহিত সেই প্রতিশ্রুতিও উড়িয়া যাইবে— মানুষ যেখানে ছিলেন, সেখানেই থাকিবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

সভামঞ্চ হইতে শ্রোতাদের আসনের দূরত্ব অলঙ্ঘ্য। দূরত্বটি প্রতীকী। তাহা প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের দূরত্ব, ক্যালেন্ডারের পাতার হাজার বদলও যে দূরত্বকে মুছিতে পারে না। নেতারা আসিবেন, মঞ্চ হইতে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিবেন, তাহার পর তাঁহাদের ফিরতি কনভয়ের চাকার ধূলির সহিত সেই প্রতিশ্রুতিও উড়িয়া যাইবে— মানুষ যেখানে ছিলেন, সেখানেই থাকিবেন। ইহাই ভারতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞান হইয়াছে। বঙ্গীয় রাজনীতিতে আরও বেশি। এই রাজ্যের জনসভায় এখন আর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিটুকুও নাই। আছে শুধু ক্ষুদ্র কোন্দল। তেমনই এক জনসভায় যাইতেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার যাত্রাপথে পোস্টার হাতে সমবেত কিছু মানুষ তাঁহার উদ্দেশে জানাইলেন, তাঁহারা শিল্প চাহেন, ভাষণ নহে। কথায় পেট ভরে না। শিল্পতালুকের জন্য জমি দেওয়া এই মানুষগুলির কথা গাড়ির কাচ ভেদ করিয়া মুখ্যমন্ত্রীর চক্ষু-কর্ণ অবধি পৌঁছাইল কি? অবশ্য, কানে পৌঁছাইলেও মরমে পশিবে না, সে ভরসা বিলক্ষণ আছে। তাঁহার শাসনকালের তিন-চতুর্থাংশ অতিক্রান্ত, তিনি এখনও উন্নয়নের গুরুত্ব বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। পারিবেন, তেমন আশাও নাই। তাঁহার রাজনীতিতে এই বিক্ষুব্ধ মানুষগুলি সিপিআইএম বা মাওবাদী বই কিছু নহেন। তাঁহাদের পরিচয়, তাঁহারা আর মুখ্যমন্ত্রীর ভোটার নহেন, জনসভার মুগ্ধ শ্রোতা নহেন। অতএব, মুখ্যমন্ত্রীর মানসিক মানচিত্রে তাঁহারা থাকিবেন না, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁহাদেরই মতো দাবি বহিয়া বেড়ানো অন্য মানুষগুলিও থাকিবেন না।

Advertisement

তাঁহাদের দাবিটি কিন্তু থাকিবে। মুখ্যমন্ত্রী সেই দাবিকে স্বীকার করিলেও থাকিবে, না করিলেও। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই থাকুন অথবা অন্য কেহ, ভাষণের বদলে শিল্পের দাবির গুরুত্ব এবং বাস্তবতা তিলমাত্র হ্রাস পাইবে না। গত বত্‌সরের শেষ লগ্নে খড়্গপুরের বিক্ষুব্ধ মানুষগুলি যে দাবিটি পেশ করিলেন, তাহাই নূতন বত্‌সরের বীজমন্ত্র হইতে পারে। আর প্রতিশ্রুতি নহে, আর তরজা নহে— এই বার কাজ হউক। এই বার মানুষের কর্মসংস্থান হউক, তাঁহাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হউক। একমাত্র শিল্পায়নই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্যাধি দূর করিতে পারে। যথেষ্ট কর্মসংস্থান হইলে আর উপার্জনের জন্য সিন্ডিকেটের মুখাপেক্ষী হইতে হয় না। ফলে, নিছক আর্থিক নিশ্চয়তার স্বার্থেই শাসক দলের আশ্রয় গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও থাকে না। তাহাতে রাজনীতিতে ‘ক্লায়েন্টেলিজম’-এর বিষটিও খানিক হইলেও কমে। যথেষ্ট শিল্প হইলে হয়তো শাসক দলের মিছিলে পতাকাবাহকের সংখ্যা কমিবে। কিন্তু, ইহা ভিন্ন শিল্পায়নে পশ্চিমবঙ্গের আর কোনও ক্ষতি নাই। শিল্পায়নই এই রাজ্যের মৃতসঞ্জীবনী হইতে পারে। কিন্তু, নবান্নের শীর্ষে যত ক্ষণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিষ্ঠান, তত ক্ষণ পশ্চিমবঙ্গের আশা ক্ষীণ।

যে শাসক শিল্পায়নের রথটিকে গতিশীল করিতে পারেন, যিনি শিল্পের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করিতে পারেন, তিনিই সুশাসক। তাঁহার আর কোনও পরিচয় প্রয়োজন নাই। তাঁহার অতীত লইয়া কাটাছেঁড়াও অনাবশ্যক। কথাটি দুই ভাবে সত্য। এক, যেহেতু শাসকের কাজ অধিকতম মানুষের কল্যাণসাধন, এবং যেহেতু সেই কাজটির জন্য শিল্পায়ন অপেক্ষা শ্রেয় পন্থা নাই, অতএব যিনি শিল্পায়নে প্রকৃত আগ্রহী, তিনিই প্রকৃত সুশাসক। দুই, শিল্পায়নের সাধনা পূর্ণ সময়ের কাজ। যে শাসক সেই কাজে প্রকৃত মনোনিবেশ করেন, তাঁহার পক্ষে আর ক্ষুদ্র দলতন্ত্র, বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় মন দেওয়া সম্ভব হয় না। শিল্পায়নের যজ্ঞই তাঁহাকে অবাঞ্ছিত কাজ হইতে দূরে রাখে। ইঙ্গিত বলিতেছে, নরেন্দ্র মোদী সেই সুশাসক হইয়া উঠিবার পথে পা ফেলিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার সহযাত্রী হইবেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তেমন আশা নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement