‘অপর’? দিল্লিতে উত্তর-পূর্বের পড়ুয়াদের গণধর্ষণের প্রতিবাদ। ফেব্রুয়ারি, ২০১৪।
মাসখানেক আগে পুজো-পুজো গন্ধটা যখন আকাশের গায়ে লাগতে শুরু করেছে, অথচ গোলাপি-বেগুনি দোপাটি ফোটার পালা শেষ হয়ে যায়নি, সেই সময়ে এক বিকেলে শান্তিনিকেতনের মেলার মাঠের সামনে থেকে শুরু হওয়া একটি মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। সিকিম থেকে যে মেয়েটি ওখানে পড়তে এসে প্রথম দু’মাসের মধ্যেই কলেজের দাদাদের যৌন বিকৃতির শিকার হয়, সেই পাহাড়ি মেয়ের জন্মদিন ছিল সে দিন। শারীরিক ও মানসিক আঘাতের ভারে সে তখন হাসপাতালে ভর্তি। তার ওপর ঘটা অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে, তার জন্মদিনে, এই মিছিলের মূল উদ্যোগ নেয় পাহাড় থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা। শামিল হয় কয়েক জন সমতলের ছাত্রছাত্রী, যারা কেউ কেউ আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে স্মারকলিপি পেশ করেছিল। পরের দিন কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল বেরোয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত উত্তরবঙ্গের কিছু ছাত্রছাত্রীর উদ্যোগে।
শান্তিনিকেতনের মিছিলে কোনও স্লোগান ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের হাতে ছিল কয়েকটি প্রতিবাদী পোস্টার, মাঝে মাঝে কারও কারও গলায় গান। কলকাতাবাসী আমাদের পাঁচ জনের দলটি অবশ্যই সেখানে ‘বহিরাগত’। বাইরে থেকে গিয়ে পড়েছি বলেই লক্ষ করলাম কোথায় যেন একটা গভীর অভিমান কাজ করছে মিছিলে-হাঁটা পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের অধিকাংশর মধ্যে। ভিনরাজ্যের এক দিশেহারা দম্পতি ও তাঁদের মেয়ের পাশে সত্যিই কত জন সহপাঠী ও শিক্ষক আছেন, সেটা যেন বুঝে উঠতে পারছে না অনেকেই। তাদের এই স্পর্শকাতর অবস্থার সুযোগ নিয়ে সমতলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের বিভেদ বাড়াতে চাইছে কোনও কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী। অন্য দিকে, যে-সব ছাত্রছাত্রী বিশ্বভারতীতে ‘জেন্ডার সেন্সিটাইজেশন কমিটি এগেনস্ট সেকশুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ দাবি করছে, তারা সিকিমের মেয়েটির ভাল থাকা নিয়ে ঠিক কতটা ভাবছে, সে বিষয়ে পাহাড় থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা যেন নিশ্চিত নয়।
প্রথম বছরে ভাষা ও সংস্কৃতিগত ফারাকের সঙ্গে দৈনন্দিন বোঝাপড়ার তাগিদে যে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে বেঁধে-বেঁধে থাকতে শুরু করে, কিছু দিনের মধ্যে তাদের সঙ্গে অন্য অনেকের প্রীতির সম্পর্ক তৈরি হলেও খুব একটা নৈকট্য যে সাধারণত রচিত হয় না, এই মিছিল যেন পরোক্ষে সেই কথাই বলছিল। সেই সঙ্গে এটাও দেখলাম, এই অত্যন্ত সংযত, প্রায়-মৌনী মিছিলে কিন্তু স্থানীয় মানুষজন প্রায় অনুপস্থিত। হয়তো অনেকেই মিছিলের খবর পাননি। অনুপস্থিতির অর্থই যে মেয়েটি ও তার বন্ধুদের প্রতি সহমর্মিতার অভাব, সেটা ধরে নিচ্ছি না। জানি, শান্তিনিকেতনে বহু সংবেদনশীল মানুষ আছেন, যাঁরা কেউ কেউ অপ্রকাশ্যে নানা ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। তবু সেই মিছিলে ছাত্রদের পাশে চেনা-অচেনা স্থানীয় মানুষদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, কিছুমাত্র বাহুবল প্রয়োগ না করেও এখানকার হাওয়ায় যেন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রবল ত্রাস। যে দেশে ইচ্ছা থাকলেও নিয়মের বিরুদ্ধে গেলে পেতে হয় কঠোর শাস্তি, যেন সেই তাসের দেশের মধ্যে দিয়ে চলেছে অল্পবয়সিদের এই সাহসী মিছিল।
শান্তিনিকেতনে উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে প্রতি বছরই অনেক ছেলেমেয়ে পড়তে আসে, যেমন আসে যাদবপুরে। বিশ্বভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের মধ্যে তারা অনেকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করলেও, ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বেশ কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বাজার করতে গেলে বা বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে অনেক সময়েই জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা হিন্দুস্থানি কি না। যদিও, সমস্যাটা কলকাতায় যতটা প্রকট শান্তিনিকেতনে হয়তো ততটা নয়।
মেয়েদের সমস্যা আরও জটিল। পথেঘাটে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকা বহু পুরুষ মেপে নিতে চায় এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। তাদের চাউনি, ইঙ্গিত, মন্তব্যের মধ্যে অনেক সময়েই একাকার হয়ে যায় জাতি/বর্ণ-বিদ্বেষ ও যৌন-হিংসা। চলাফেরায় সাবলীল, সাধারণত জিন্স/স্কার্ট পরিহিত, ইংরেজি বা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা-বলা এই মেয়েদের আলাদা বা ‘অপর’ বলে মনে করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরক্ত করা ও যৌন-ইঙ্গিত ছুড়ে দেওয়াটা যেন অধিকার বলে ধরে নেয় অনেকেই। অধিকার থেকে আগ্রাসনের পথটা সবচেয়ে সহজ, যখন টের পাওয়া যায় একটি মেয়ের নানা অসহায়তা। যেমন, বাড়ি থেকে দূরে, অপরিচিত জায়গায় নতুন-এসে-পড়া, ভিন্ন সাংস্কৃতিক চিহ্ন বহনকারী কোনও মেয়ের বহুমাত্রিক অসহায়তা। অথচ সমস্যার অঙ্কুরোদ্গমেই, তা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই হোক অথবা বাইরে, যদি ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা আলোচনার জায়গা, ভরসাস্থল খুঁজে পায়, তা হলে তাদের পড়া ছেড়ে চলে যেতে হয় না।
ভাষা ও সংস্কৃতির ফারাকের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার পর্বে, নিজেদের সংকটগুলো নিয়ে কথা বলার বিশ্বাসযোগ্য ও খোলামেলা পরিসর দরকার এই ছাত্রী ও ছাত্রদের। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা কোনও সেল থাকলে তারা দূর থেকে এসে কিছুটা কম অসহায় বোধ করে। তা ছাড়া জাতি/বর্ণ-বিদ্বেষের সঙ্গে যৌন হিংসা কী ভাবে জড়িয়ে থাকে, সেটা নিয়েও অনেক বেশি আলোচনা জরুরি। বাঙালিরা এদের সম্বন্ধে এত কম জানে কেন বিশেষত যখন তারা অনেকেই পর্বতপ্রেমী এই প্রশ্ন এদের কুরে কুরে খায়। নৈকট্য রচনা করার দায়টা সম্পূর্ণ ওদের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমরা আশা
করতে পারি না যে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে উঠবে। সংকীর্ণতা ও দূরত্ব কমিয়ে আনতে যাদবপুর ও বিশ্বভারতী সহৃদয় উদ্যোগ না নিলে অনেক না-জানা ও ভুল-জানা থেকে দূরত্ব বেড়েই চলবে।
আন্তর্জাতিকতাবাদ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের মধ্যেই নিহিত, এই নয়া উদারনীতি ও ভেদ-বিভেদের রাজনীতির রমরমার সময়, সেখানেও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন, যাতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চিহ্ন বহনকারী মানুষজন নিজস্বতা বজায় রেখে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পারেন। আমি শুধু প্রতিষ্ঠান-নির্ভর, বহুল প্রচারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা বলছি না। বলতে চাইছি ছাত্রছাত্রী পরিকল্পিত ঘরোয়া অনুষ্ঠান, বিতর্ক ও আলোচনা সভার কথা যেগুলো বছরভর শান্তিনিকেতনের সর্বত্র খুবই হত, যার কোনও বাঁধাধরা মঞ্চ ও অনুষ্ঠানসূচি অনেক সময়েই থাকত না। ছাত্রছাত্রীদের এ ব্যাপারে উত্সাহ ও স্বাধীনতা দিলে নতুন নতুন ভাবে পুরনো ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটে, তারা কী ভাবছে ও কী ভাবে ভাবছে, সেটাও টের পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নানা ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের যাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জ থেকে আসা অনেকেই পড়ে ভয়-ভাবনা-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করার একটা জায়গা বলতে মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া ‘সেন্টার ফর কাউন্সেলিং সার্ভিসেস অ্যান্ড স্টাডিজ ইন সেল্ফ-ডেভেলপমেন্ট’-এর কথা। অনেক ধরনের সমস্যা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা সেখানে কথা বলতে পারত।
এই সেন্টারের যাঁরা স্থপতি, তাঁরা কিন্তু একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন। বিভাগগুলোর, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগগুলোর দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে প্রতি বছর তাঁরা সেন্টার সম্বন্ধে ছেলেমেয়েদের ওয়াকিবহাল করাতেন। সেই সঙ্গে র্যাগিং ও যৌন-হেনস্থা নিয়েও নতুন ভর্তি-হওয়া পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলা হত তাঁদের তরফে। শুধু নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত ও শাস্তিপ্রদান নয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে একটা সচেতনতার পরিমণ্ডল গড়ে তোলা ছিল তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশাখা নির্দেশিকার তো সেটাই অন্যতম মুখ্য বক্তব্য।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও কালেই কি নির্দেশিকার এই দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে সচেতনতা প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছেন কলা-বিজ্ঞান-ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ নির্বিশেষে? না কি মনে করা হয়েছে, এগুলো শুধু মেয়েদের বিষয়, বড়জোর কলা বিভাগের ছেলেমেয়েদের? প্রশ্নগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক ও ছাত্র সংসদগুলোর ভাবা দরকার। মেয়েদের শুধুই যৌনবস্তু হিসেবে দেখতে শেখার সঙ্গে যৌন হয়রানির যে প্রত্যক্ষ যোগ, সেটা নিয়ে সব ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বেশি-বেশি আলোচনা হোক।
কথাটা এই জন্য বলছি যে, সারা বছর খবরের কাগজের শিরোনাম হওয়ার মতো যৌন হয়রানির ঘটনা না ঘটলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের জীবনে এগুলো কমবেশি ঘটতেই থাকে। যেমন, মূল ক্যাম্পাসের মধ্যে যে ছেলেদের হস্টেলগুলো আছে, তার পাশ দিয়ে অন্যান্য বিভাগে যাতায়াতের সময় দিন-দুপুরেও মেয়েদের অশ্লীল উক্তি/ইঙ্গিত সহ্য করে যেতে হয় দিনের পর দিন। হস্টেলগুলোর আশপাশের কোয়ার্টার্সে যাঁরা থাকেন, তাঁরা অনেকেই রাতের দিকে ছেলেদের হস্টেলে নানা রকম যথেচ্ছাচার সয়ে যেতে বাধ্য হন। ছেলেদের বেলায় নিয়মের কোনও বালাই নেই তো হস্টেলে, ‘বহিরাগত’ বলে কোনও কনসেপ্টই কাজ করে না সেখানে। যে কেউ দিনের পর দিন সেখানে বসবাস করতে ও মোচ্ছব করতে পারে। ছেলেদের তো অলিখিত লাইসেন্স দিয়েই দেওয়া হয়েছে মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে মন্তব্য করার, এমনকী তাদের চোখে ‘দৃষ্টিকটু’ পোশাক-পরা মেয়েদের ছবি ফেসবুকে চিহ্নিত করে ছড়িয়ে দেওয়ার!
এক একটা করে ‘বড়’ ঘটনা ঘটে আর সর্বত্র মেয়েদের হস্টেলে/বাড়িতে কড়াকড়ি বাড়তে থাকে, বাড়ির লোকেরা চিন্তিত হয়ে মেয়েদের ওপর চাপ দেয় নিজেদের যথাসম্ভব গুটিয়ে রাখতে। সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হওয়ার আর দরকার নেই, শর্টস পরে খেলার মাঠে প্র্যাকটিস করতে হবে না, নাম-না-জানা শক্তিমান-রা যদি সে দিন রাতে তোমার গায়ে খারাপ ভাবে হাত দিয়েও থাকে, তুমি সেটা নিয়ে থানা-কোর্ট করতে যেয়ো না।
কিছু কিছু ছেলেদের ওপরেও আর এক রকম মারাত্মক চাপ পড়ে সেই যারা মেয়েদের নিয়ে ‘পুরুষালি’ মশকরা দেখলে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রশ্ন তোলে, ‘হিরো’ হতে চায় না, মেয়েদের সঙ্গে সহজ বন্ধুত্বের সূত্রে লিঙ্গ-ন্যায়ের দাবি তোলে। শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় সম্প্রতি এ রকম বেশ কিছু ছেলেকে দেখে ভাল লাগল। তাদের জন্যেও লড়াইটা খুব কঠিন। সেই লড়াইয়ের পরতে পরতে থাকা সংশয়-বেদনার কথাও আমাদের কান পেতে শুনতে হবে।