কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নায়কনায়িকা এবং আধিকারিকদের হাতে যদি কাজ কম থাকে, তবে তাঁহারা খই ভাজিতে পারেন, চাহিলে পপকর্নও। কিন্তু কাজ নাই বলিয়া উর্বর মস্তিষ্ক হইতে উদ্ভট পরিকল্পনা খুঁড়িয়া বাহির করিবেন এবং তাহার হ্যাপা সামলাইতে বড়দিনের দিন সিবিএসই-র স্কুলে স্কুলে পড়ুয়াদের ‘সু-রাজ দিবস’ লইয়া রচনা প্রতিযোগিতা, ক্যুইজ প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে যোগ দিতে হইবে, ইহা কীরূপ আবদার? খ্রিস্টমাসের ছুটি একটি সর্বজনীন অবকাশ, বিশ্বের সকল দেশেই ছাত্রছাত্রীরা এ সময় ছুটি উপভোগ করিয়া আসিয়াছে। এমন আনন্দ ও অবকাশ যাপনের উপলক্ষকে রচনা-প্রতিযোগিতার বিড়ম্বনায় জর্জরিত করার এই বিচিত্র অতি-ইচ্ছা দেখাইয়া দেয়, সদর দফতরে কিছু গোলযোগ আছে।
দেশব্যাপী তুমুল প্রতিবাদের মুখে পড়িয়া সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী যখন বলেন, এ ধরনের নির্দেশিকা কোনও কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় নাই, তখন কুনাট্যে দ্বিতীয় অঙ্ক যুক্ত হয়। ‘নির্দেশিকা’র অর্থ কী, তাহা লইয়া সূক্ষ্মবিচার সম্পূর্ণ অনর্থক, কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি প্রস্তাব যে ভাবেই পাঠাইয়া থাকুন, তাহা নির্দেশেরই শামিল। শিক্ষক দিবসে স্কুলে স্কুলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনাইবার পরিকল্পনাটিও একই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছিল। বড়দিনের ‘টাস্ক’ দেওয়ার বুদ্ধিটিকে বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক বলিয়া তুচ্ছ করা কঠিন। সে বারেও কর্তাদের সংশোধনী বিবৃতি জারি করিয়া বুঝাইতে হইয়াছিল যে, ভাষণ শ্রবণ আবশ্যিক নহে, ঐচ্ছিক। এ বারেও আধিকারিকরা নির্দেশিকাটি এই মর্মে সংশোধন করিয়াছেন যে, ‘সু-রাজ দিবস’ লইয়া এই প্রবন্ধ রচনা পড়ুয়াদের পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়, তাহারা ইচ্ছা করিলে এই প্রতিযোগিতায় অংশ লইতে পারে এবং এ জন্য স্কুলে যাওয়ারও প্রয়োজন নাই, বাড়িতে বসিয়া কম্পিউটারেও তাহা লেখা যাইতে পারে। ছেলেমেয়েরা খ্রিস্টমাসের দিন বাড়িতে কম্পিউটারের সামনে বসিয়া প্রবন্ধ রচনা করিবে কেন, এ প্রশ্ন তুলিয়া লাভ নাই।
কেহ কেহ একটি বঙ্কিম সংশয় তুলিয়াছেন— তাহা হইল, দীপাবলি, দোলযাত্রা, রামনবমী কিংবা জন্মাষ্টমীর ছুটির দিনেও কি কেন্দ্রীয় শিক্ষা আধিকারিকরা ছাত্রছাত্রীদের এমন একটি ‘হোম-টাস্ক’ দিতে পারিতেন? প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক নহে, কারণ অধুনা হিন্দু রাষ্ট্রীয়তার বন্দনাগান গাহিবার প্রয়াস অতি প্রকট। কিন্তু সেই কূটপ্রশ্ন দূরে সরাইয়া রাখিলেও অবান্তর বিষয়ে সময় এবং মনোযোগ নষ্ট করিবার সমস্যাটি থাকিয়া যায়। লক্ষণীয়, শাসক দলের প্রতিনিধিদের, ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রীদেরও, এই সব অকাজ লইয়া চর্চা ও প্রতিবাদেই নির্বাচিত সংসদের অমূল্য সময় অপব্যয় হইতেছে, জরুরি বিল লইয়া আলোচনা শুরুই হইতে পারিতেছে না। বুঝিতে অসুবিধা নাই, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কোনটি নহে, তাহার বিচারে কোনও কোনও মন্ত্রকের বিভ্রম ঘটিতেছে। এ ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব সমধিক, কারণ শিক্ষার ভবিষ্যৎ অনেকাংশে তাঁহাদের হাতে। তাঁহাদের মনে রাখিতে হইবে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে স্বাধীন, মুক্তচিন্তার পরিবেশ না থাকিলে শিক্ষার প্রসার অসম্ভব। এমনিতেই ভারতীয় শিক্ষাজগতে মুক্তচিন্তার হাল ভাল নহে। যাহাও বা আছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রক হইতে রচনা লিখিবার নির্দেশ দিয়া সেইটুকুও সংহার করা ভিন্ন অন্য কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে না।