দু’টি শব্দ নিয়ে কিছু দিন ধরে ঈষৎ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, উভয় শব্দই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বিশেষণের গুণ সম্পন্ন, কিন্তু বিশেষ্য হিসেবেও তাদের প্রয়োগ মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রথম শব্দটি ‘বহিরাগত’, অন্যটি ‘অনুপ্রবেশকারী’। যাঁরা শব্দদ্বয় প্রথম ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের মনে বোধকরি কোনও দ্বিধা ছিল না যে, বহিরাগত তথা অনুপ্রবেশকারীরা ভর্ৎসনা তথা নিন্দার যোগ্য।
ব্যাপারটি কিন্তু তত সহজ নয়। ‘বহিরাগত’ দিয়েই শুরু করা যাক। বহিরাগত, অর্থাৎ যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন, আমাদের কেউ নন, আমাদের থেকে আলাদা। মুশকিল হল, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন। কলকাতা বা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় বসে তিনি যদিও কোনও ডিগ্রি অর্জন করেননি, তাঁর কথা তো এলেবেলে বলে পাশে সরিয়ে রাখা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়! ‘ভারততীর্থ’ শিরোনামে এক কবিতা রচনা করে তিনি সেই কবে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে সব গোত্রের বহিরাগতরা জড়ো হয়েছেন, পরস্পরের সঙ্গে মিলে গেছেন, মিশে গেছেন, ‘শক হুণ দল পাঠান মোগল’ সেই সঙ্গে এমনকী দ্রাবিড় চিন-ও। আরও ঝামেলা, ‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার’, সেখান থেকেই বিস্তর উপহার-উপঢৌকন আসছে, সে-সব বহন করে মানুষজনও আসছেন, তাঁরাও ভারততীর্থে অন্যদের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে সবাই বহিরাগত, কিংবা ঘুরিয়ে বলতে হয়, বহিরাগতরাই ভারতবাসী।
রবীন্দ্রনাথ ভাবালুতার সঙ্গে যে-দাবি পেশ করেছেন, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তার নানা সাক্ষ্য ছড়িয়ে আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘বহিরাগত’দের ঢেউয়ের পর ঢেউ ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। অতিথি হিসেবে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা স্থিত হয়ে বসেছেন, তাঁদের ভারতীয় সত্তা গভীরে প্রোথিত হয়েছে। কিছু কাল বাদে ফের নবীন অতিথিবৃন্দের আগমন, হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিসংবাদ-সংঘাত-ভুল বোঝাবুঝি, তবে সে-সবও ক্রমে থিতিয়ে গেছে, অপেক্ষাকৃত সদ্য আগত অতিথিরাও গৃহী-তে পরিণত হয়েছেন, যেটা কৌতূহলের ব্যাপার। দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলেও এমনতর জন-পুনর্বিন্যাস লক্ষ করা গেছে। গঙ্গার প্রবল জলরাশি অববাহিকা দিয়ে বয়ে আনা পলিমাটি বিহার ও বঙ্গদেশে ইতস্তত ছড়িয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মৌসুমি বর্ষণের প্রসাদ, বিহার-বাংলায় শস্যোৎপাদন প্রাচুর্যে উপচে পড়ে। এই উর্বরভূমির সংবাদ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছয়, অপেক্ষাকৃত খরা জায়গা থেকে কাতারে কাতারে মানুষ শতকের পর শতক ধরে বিহার-বাংলামুখী হয়েছেন, এই পুবের দেশে এসে নতুন করে ঘর বেঁধেছেন, জীবিকার সুযোগ পেয়েছেন। দাক্ষিণাত্যে গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী নদীত্রয়ের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটেছে। নদী যতই সমুদ্রের দিকে এগিয়েছে, পলিমাটির স্তর স্বাস্থ্যবতী হয়েছে, ভূমি-উর্বরতা বেড়েছে, অন্য অঞ্চল থেকে লোকসমাগমের ফলে জনসংখ্যাও দ্রুত বেড়েছে। ‘বহিরাগত’রা এখানেও এক দেহে হল লীন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে ‘বহিরাগত’দের অনুসন্ধানে বেরোলে অন্য একটি ফ্যাকড়ারও আশঙ্কা। কে জানে, হয়তো ছত্তীসগঢ় অথবা কোরাপুট কিংবা পালামু পরগনার কোনও প্রগলভ আদিবাসী যুবক বলে বসবেন, ‘মশাই, আমরাই ভারতবর্ষের একমাত্র অকৃত্রিম আদি অধিবাসী, বাকি আপনারা সবাই বহিরাগত, দয়া করে নিষ্ক্রান্ত হোন।’
মজার ব্যাপার হল, ‘বহিরাগত’ শব্দটি হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে কিছুটা কলরব সৃষ্টি করেছে, যা পুরোপুরি অযৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সমস্ত চিন্তার-ভাবনার-প্রশ্নের-উৎকণ্ঠার বিনিময় ক্ষেত্র। যে-কেউ যে-কোনও সমস্যা নিয়ে এখানে জড়ো হতে পারেন। বাধাবন্ধনহীন তর্ক আলোচনার ঝড় বইবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনও চিন্তাই বহিরাগত নয়, চিন্তার বাহকরাও অবশ্যই বাইরের কেউ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পোশাকি অর্থে যুক্ত না থাকলেও প্রাঙ্গণে প্রবেশে তার অধিকার কোনও ফরমান কেড়ে নিতে পারে না। যিনি এমন ফরমান জারি করবার মতো হঠকারিতা দেখাবেন, তাঁরই বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অধিকার থাকা উচিত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত শতকের তিরিশের দশক থেকে শুরু করে ইউরোপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিদ্বজ্জন, সংগীতজ্ঞ, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি নানা ধরনের গুণী ব্যক্তি মার্কিন দেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় দশকের পর দশক ধরে মার্কিন দেশ যে অন্য সমস্ত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, তার মস্ত বড় কারণ ‘বহিরাগত’দের নিবিড় গবেষণা। পারমাণবিক গবেষণা থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রয়াসে সদ্য আগত বৈজ্ঞানিকরা তাঁদের প্রতিভা যুক্ত করেছেন, মার্কিন প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নততর শাণিততর হয়েছে। মধ্য ইউরোপ থেকে আগত এক ঝাঁক ইহুদি ধনকুবের তাঁদের কূটকৌশল প্রয়োগ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর মার্কিন অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ধ্রুপদী সংগীত চর্চায় যেমন জোয়ার এসেছে, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন সংগীত রচনার ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় প্রজন্মের বহিরাগতদের প্রতিভার বিকিরণ। তালিকার পর তালিকা ঢুঁড়ে দেখুন, হলিউডের সর্বোৎকৃষ্ট চলচ্চিত্রগুলির অধিকাংশেরই প্রযোজক, পরিচালক, সংগীতকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, এমনকী প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের বহিরাগত। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে অনেক বহিরাগত প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-নেত্রীদের একঘরে করা হল, এমনকী চার্লস চ্যাপলিনকে পর্যন্ত ইউরোপে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করা হল। কিন্তু এই সাময়িক উন্মত্ততার পরিণামে মার্কিন সংস্কৃতিরই যে প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছিল, তা এখন অনেকেই মেনে নিচ্ছেন।
আমাদের দেশে যাঁরা ইদানীং বহিরাগত ও অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে চিন্তান্বিত, তাঁরা অবশ্য অত সহজে হাল ছাড়বেন না। বহিরাগতদের ক্ষমাঘেন্না করে তাঁরা সম্ভবত অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গে সোচ্চারতর হবেন। অনুপ্রবেশকারীরাও বহিরাগত, হালের বহিরাগত, বিনা অনুমতিতে বাইরে থেকে যাঁরা প্রবেশ করেছেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত জড়িয়েই এই সমস্যার উদ্ভব। স্বাধীনতা-পরবর্তী অধ্যায়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে, বিনা অনুমতিতে, হাজার-লক্ষ শরণার্থী ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের কিন্তু তখন অনুপ্রবেশকারী বলে অভিহিত করা হত না। তাঁরা উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুরা কবে থেকে অনুপ্রবেশকারীতে রূপান্তরিত হলেন, তা ধন্দের ব্যাপার। দেশ ভাগ হওয়ার মুহূর্তে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উদাত্ত ঘোষণা করা হয়েছিল: যে সব একদা-ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তানে সম্ভ্রম বজায় রেখে স্বচ্ছন্দে জীবিকা অর্জনে অসমর্থ হবেন, তাঁদের সব সময় ভারতে প্রবেশ করবার ও স্থায়ী ভাবে বসবাস করবার অধিকার থাকবে। সেই ঘোষণায় কোনও সময়সীমা নির্দিষ্ট ছিল না এবং তা আজও পর্যন্ত প্রত্যাহৃতও হয়নি। অতএব, হঠাৎ ফতোয়া দিয়ে কাউকে অনুপ্রবেশকারী বলে বর্ণনা করা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অন্যান্য। যে কারণেই হোক, যদি বাংলাদেশের কোনও নাগরিক ওখানে অসুবিধা বোধ করেন এবং ভারতে চলে আসতে চান, তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি কোনও অর্থেই সমর্থনযোগ্য বলে মনে হয় না। আরও যা মারাত্মক, আভাসে-ইঙ্গিতে বলা হচ্ছে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্তদের ক্ষেত্রেই এই নির্দেশ প্রযোজ্য হবে। এর চেয়ে সর্বনেশে প্রথা কিছু হতে পারে না। সীমান্তবর্তী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই ভারত সরকারের প্রগাঢ় সুসম্পর্ক। যে ধরনের ফরমানের কথা বলা হচ্ছে, তা সেই সম্পর্কের ওপর কালো ছায়া ফেলবে। এবং গোটা ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকবে না, বর্ধমানের নজির দেখিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হবে, আপাত-চমৎকার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এ দেশের সরকার ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছে।
অন্য একটি সমস্যাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে সহজ হবে। বিখ্যাত আইনজীবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, যাঁর স্মরণে দেশপ্রিয় পার্কের নামকরণ এবং যাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত একদা জাতীয় কংগ্রেসের সাময়িক সভানেত্রী ছিলেন, চট্টগ্রামের মানুষ। সূর্য সেন-কল্পনা দত্ত-ও তাই-ই, এমনকী ওড়িশার জননায়ক বিজু পট্টনায়কের মামাবাড়িও চট্টগ্রাম। এক বাঙালি ব্রাহ্ম পরিবার। ধরুন, এই পরিবারের অতি নিকট আত্মীয়দের কোনও বংশধর এত দিন চট্টগ্রামে নিশ্চিন্তে বসবাস করছিলেন, এখন তিনি পরিণত বার্ধক্যে উপনীত, তাঁকে দেখাশোনা করবার কেউ নেই, এমন অবস্থায় তিনি যদি কলকাতায় চলে এসে কোনও আত্মজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাঁকে কি অনুপ্রবেশকারী বলে ঘোষণা করে ফেরত পাঠানো হবে?
একটি লঘু কাহিনি দিয়ে এই আলোচনায় ইতি টানছি। গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায় ঢাকায় জনৈকা ধ্রুপদী সংগীতে পারদর্শিনী কিশোরী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, পরে তিনি কলকাতায় কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। দিলীপকুমার রায় ও কাজী নজরুল ইসলাম, উভয় বন্ধুই মাঝেমধ্যে ঢাকায় গেলে কিশোরীটিকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সমাদর করে গান শিখিয়ে আসতেন। পাড়ার বেকার ছেলেদের ব্যাপারটি পছন্দ হত না, এই অনুপ্রবেশকারীদ্বয়কে তাঁরা সমুচিত শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর। এক দিন সন্ধ্যায় কাজী নজরুল শৌখিন ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদরে সুসজ্জিত হয়ে কিশোরীটির পিতৃগৃহের দোরগোড়ায় ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়ি থেকে অবতরণ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি বখাটে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে উত্তম-মধ্যম দিতে শুরু করল। নজরুল তখন কাতরোক্তি করেছিলেন: ‘ওরে তোরা ভুল করছিস! আমি দিলীপ নই, আমি নজরুল!’ ছেলের দল আদৌ ভুল করেনি। তাদের বিচারে দিলীপকুমার এবং নজরুল দুজনেই সমান অনুপ্রবেশকারী!