সু দূর অতীতে ক নামে এক জন অতীব অসাধু ব্যক্তি ছিলেন। ইতিহাস বইতে এমনই লিখিয়াছে। ইতিহাস বইতে আজ অবধি যাহা যাহা লেখা হইয়াছে, সে সকলই যে বিনা তর্কে শিরোধার্য, তাহা নহে। তবু, তর্কের খাতিরে না হয় ধরিয়া লওয়া গেল, ইতিহাস পুস্তক ঠিকই বলিতেছে, ক লোকটি সুবিধার ছিলেন না। অতঃ কিম্? অনাগত ভবিষ্যতের গোটাটা ধরিয়া ক শব্দটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করাই কি উচিত কাজ? মনুষ্যসভ্যতার বিচিত্র বিপুল সমগ্রতা হইতে ক অক্ষরটিকে মুছিয়া ফেলিলেই কি ইতিহাসের প্রতি পরম সুবিচার হইবে? শুনিতে অদ্ভুত ঠেকিলেও ভারতের জনসমাজের একাংশ বর্তমানে এমনই মনে করে, দেখা গেল। সদ্যোজাত শিশুর নাম তৈমুর রাখায় তাই প্রচণ্ড শোরগোল, আক্রমণের বন্যা। তৈমুর শাহ লঙ্গ যেহেতু অত্যাচারী যুদ্ধবাজ ছিলেন বলিয়া জানা যায়, দিল্লি আক্রমণ ও লুণ্ঠন করিয়াছিলেন বলিয়া শোনা যায়, তাই আর কোনও দিন কাহারও নাম তৈমুর রাখা যাইবে না, এই হইল গোঁয়ার্তুমি। এই গোঁয়ার্তুমি ২০১৬ সালের সাম্প্রতিকতম সাংস্কৃতিক গুন্ডাগিরি। এই গুন্ডাগিরির সামনে শিশু তৈমুরের পরিবার সাহসভ’রে দৃঢ় থাকিতে পারিবেন, এই আশা রহিল। আশাটি জরুরি। কেননা অন্যায় অসভ্যতার নিকট কোনও ভাবে মাথা নত করার অর্থ গুন্ডাগিরিকে জিতাইয়া দেওয়া। ভারতের চরিত্রে তাহা একটি গভীর ও স্থায়ী কালো দাগ ফেলিয়া যাইবে।
মনে রাখিতে হইবে, তৈমুর কিন্তু একটি অতি-প্রচলিত তুর্কি শব্দ। অর্থটিও কম প্রচলিত নহে, লৌহ। অর্থাৎ ব্যাকরণগত ভাবে ইহা বস্তুবাচক বিশেষ্য। অতি-প্রচলিত নামও বটে। ইসলামীয় দুনিয়ায় তৈমুর যথেষ্ট বহুশ্রুত নাম। হঠাৎ একটিমাত্র বিশেষ চরিত্রের অনুষঙ্গ টানিয়া তাহাকে ব্রাত্য করিয়া দিবার মধ্যে যে মূর্খামি বা গোঁড়ামির পরিচয়, কথোপকথন বা যুক্তি-প্রতিযুক্তির দ্বারা তাহার প্রতিকার অসম্ভব। আর, মধ্যযুগীয় ভারতের অনুষঙ্গ টানিয়া যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রকাশ, তাহার প্রতিকারের আশা তো ক্রমে দুরাশা হইয়া দাঁড়াইতেছে। প্রকৃতপক্ষে তৈমুর-বিরোধিতার মধ্যে কোনও ইতিহাসমনস্কতা নাই, রহিয়াছে কেবল রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের বিকৃত ব্যবহার। সংকীর্ণমনা নেতাদের সহিত সাধারণ মানুষও মহানন্দে সেই বিকৃতিতে তাল মিলাইতেছেন। অতীব দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই দুই দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সাংস্কৃতিক হিংস্রতার প্রকাশ দেখা গেল, তাহাই প্রমাণ করে, জাতীয় জীবনের মান কত দ্রুত তলানির অভিমুখে দৌড়াইতেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার চরিত্রগত কটুকাটব্য-প্রিয়তা তাহাতে কতখানি ইন্ধন জোগাইতেছে। অন্যের ব্যক্তিগত জীবন, দাম্পত্য নিভৃতি, একটি শিশুর জন্মমুহূর্ত, কোনও কিছুকেই সম্মান না করিয়া সেই হিংস্রতা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ভাবে প্রবাহিত হইতেছে। ইহাই একবিংশ শতকের ভারতের প্রামাণ্য নিশানা বটে!
নামে কী আসে যায়, কথাটি বেশি ব্যবহারে জীর্ণ ঠিকই। কিন্তু কখনও কখনও বহু-উচ্চারিত ‘ক্লিশে’র মধ্যেও গুরুতর সত্য নিহিত থাকে। পুরাতন হইয়াছে বলিয়া সেই সত্য মানিব না, ইহাও এক ধরনের মৌলবাদ। তৈমুর বিতর্কের অবকাশে ভারতীয় জনসমাজের তাই এক বার ফিরিয়া ভাবা উচিত যে তাহার লঘু-গুরু জ্ঞান ফিরাইবার দরকার আছে কি না। দেশের সমস্যা কিছু কম নয়, ভাবিবার বিষয়ও কম নয়। রাজনীতি করিবার সময় থাকিলে সংকটের জোগানও বর্তমান জাতীয় জীবনে সুপ্রচুর। না কি নাম-আদিখ্যেতা দিয়াই সে সকল সারবস্তু বা সার-বিষয় হইতে নজর ঘুরাইয়া রাখা যাইবে? অসুস্থ রাজনীতির এই দুর্বিপাক শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পঙ্কিলতায় দেশকে নিক্ষেপ করিবে, এই আতঙ্ক দিয়াই বৎসর-শেষের সূর্য অস্তে ঢলিতেছে।