যাদবপুর ও বিশ্বভারতী একটি রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যটি কেন্দ্রের। দুটিই আপাতত উত্তাল যৌন হয়রানি ও সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার অভিযোগে। অভিযোগটি আরও বেশি চিন্তার, কারণ সে হয়রানি এসেছে সতীর্থদের মাধ্যমে। এ ধরনের ঘটনা আটকাতে নানান দাওয়াইয়ের কথা বলা হচ্ছে। আরও নিরাপত্তাকর্মী, আরও সিসিটিভি, আরও নজরদারি। এবং রকমারি নিষেধাজ্ঞা, কোথাও সূর্যাস্তের পর ছাত্রীদের হস্টেল থেকে বেরনোয়, তো কোথাও সব ছাত্রছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বচ্ছন্দ ঘোরাফেরায়। বলতে হচ্ছে, বন্ধু বাছো সাবধানে, বিশ্বাস নয়, অবিশ্বাস হোক তোমার যাপনের অভিজ্ঞান। ২০১৪ সালে এটাই কি আমরা ছাত্রছাত্রীদের শেখাব?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকশিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের একটা উঁচুনিচু সম্পর্ক থাকেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবন শেখায় প্রশ্ন করতে নয়, মান্য করতে। আমরা গুরুকুলের প্রতিনিধিরা সবাই এক-একটি যাজ্ঞবল্ক্য। গার্গীরা প্রশ্ন করলেই জানি আমাদের হাতে আছে অমোঘ অস্ত্র, ‘আমার থেকে বেশি জানো?’ সব সময় উচ্চস্বরে নয়, ঠান্ডা চোখ তুলে তাকানোই যথেষ্ট। ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দেওয়া, তাদের জায়গাটা ঠিক কোথায়। সেই আবহে শিক্ষকশিক্ষিকারা এই বাধ্যতার, ক্ষমতার সম্পর্কের সুযোগ নিয়েছেন, এ রকম কাহিনি যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরে অহরহ ঘোরাফেরা করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গত বেশ কয়েকটি যৌন হয়রানির নানান রকমফেরের অন্যতম হল, ঘটনাগুলি ঘটছে সতীর্থদের হাতে। আসানসোল পলিটেকনিকে ছাত্রছাত্রীদের একটি অনুষ্ঠানের পর একটি ছাত্রীকে নেশার ওষুধ মেশানো পানীয় খাইয়ে নিগ্রহের পর একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে হাসনাবাদে। বিশ্বভারতী বা যাদবপুরে সে রকম না ঘটলেও সতীর্থরাই প্রধান ভূমিকায়। যাদবপুরে আরও একটু এগিয়ে হস্টেলের ছাত্ররা নৈতিক পুলিশির ‘গুরুদায়িত্ব’ কাঁধে তুলে নিয়েছে। চিন্তাটা এখানেই। অনেকেই বলছেন, তারা নজরদারি করে ঠিক করেনি, সেটা তো কর্তৃপক্ষের কাজ। বলছেন, আরও দেওয়াল, আরও নিরাপত্তা কর্মী, আরও সিসিটিভি, সব ঝোপঝাড় কেটে ফেলো, আরও আলো লাগাও, কেউ যেন ভুলেও কোনও নিভৃতি না পায়।
১৬ ডিসেম্বরের ঘটনার পর তৈরি ইউজিসি’র এক টাস্কফোর্সের পাঠানো প্রশ্নাবলির উত্তরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানিয়েছেন, প্রয়োজন আরও উঁচু পাঁচিল, আরও সিসিটিভি, আরও নজরদারি, অভিভাবকদের অবিলম্বে জানানো। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি বা ক্যাম্পাসের মধ্যের যে কোনও অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী দুজনেরই ব্যবহার করার বা যোগ দেওয়ার সমান অধিকার আছে কি না তাতে তাঁরা জানিয়েছেন আলাদা ব্যবস্থাপনার কথা, সময় আলাদা করে দেওয়া, এমনকী আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা করা।
তরুণতরুণীরা পরস্পরকে জানবে না, চিনবে না, তা হলেই কি হয়রানি এড়ানো যাবে? অনেকেই যে সেটায় আস্থা রাখেন, সেটা বোঝা যায় যখন দেখি এই পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিতে মেয়েদের জন্য নাকি আলাদা বসার ব্যবস্থা হবে, যেমন হয়েছে মেয়েদের জন্য একটি আলাদা আস্ত বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাত্, মেয়েরাও যেন এটাই জেনে বড় হয় পুরুষ আসলে কখনও বন্ধু হতে পারে না, কারণ তারা এক কিম্ভুত জন্তু। ‘লভ জেহাদ’ আটকাতে হিন্দুত্ববাদীদের দাওয়াইয়ের সঙ্গে এ তো দিব্যি মিলে যায়। তবে আর সভা করে ‘সাম্প্রদায়িক’দের নিন্দাবাদ কেন?
নৈতিক নজরদারির প্রশ্নে ডান-বাম সংস্কৃতি মোটামুটি এক রকম। কেউ কোনও আনন্দ-হুল্লোড় করবে না, কোনও যুগল কোনও নিভৃতি পাবে না। সব পার্কে থাকবে উজ্জ্বল তীব্র আলো। রাত ন’টায় পার্ক বন্ধ হবে। কারণ, তারুণ্যকে আমরা বিশ্বাস করি না। আমাদের রাজনীতি-সমাজনীতি বয়স্কদের আখড়া, জীবনেও আমরা গোমড়াথেরিয়াম হয়ে, অন্যের আনন্দ লুটে বেঁচে থাকব। মেয়েদের সহজ ভাবে নিতে, তাদের প্রয়োজনীয় ট্রফি হিসেবে না দেখে কেন বন্ধু হিসেবে দেখতে শিখব না? পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বভারতী আর যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠান সহজে ছাত্রছাত্রীর মেলামেশার সুযোগ করে দেয়। এই সব চত্বরে নানা কারণে ছাত্রছাত্রী হিসেবে প্রবেশের সুযোগ পাননি যাঁরা, অন্যত্র সেই সহজতার অভাবই তাঁদের অনেকের আক্ষেপের অন্যতম কারণ। সেই সহজতাকে নজরদারি, সে সতীর্থদের হোক বা কর্তৃপক্ষের, দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে?
একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোশাকআশাকে, যন্ত্রপাতিতে, প্লেসমেন্টে ঝাঁ-চকচকে হবে আর মনগুলো পড়ে থাকবে আদ্যিকালে? কোনও ছাত্রের পুরুষ সত্তাটাই এত প্রবল হবে, যা তাকে এক সহপাঠিনীকে যৌন হয়রানি করতে বা তার উপরে নজরদারি চালাতে আত্মবিশ্বাস জোগাবে? নজরদারদের নজরদারি করবে কে, সে প্রশ্ন তো উঠবেই, তার সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে না যে, কেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রয়োজনে রাত দুটো পর্যন্ত লাইব্রেরিতে কাজ করে, সভা করে, আলোচনা সেরে এক কাপ চা খেয়ে নিজের হস্টেলে ফেরা যাবে না? যেমন হয় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে? বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে? জেএনইউ’তে তো লাইব্রেরির বেসমেন্টে গরমের দিনে ঠান্ডা বলেই অনেকে গিয়ে পড়ে থাকেন। সেই স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলে কখনও তো একটি ছেলে একটি মেয়েকে ‘আসলে’ নিজের সমান বলে ভাবতে পারবে না, ভাল চাকরি পেলেও সহকর্মী মেয়েটিকে কখনও নিজের সমকক্ষ বলে মনে করতে পারবে না, মেয়েটি ভাল করলে হীনম্মন্যতায় ভুগবে।
কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে করব না, তা আমরা অনেক ভাবে শিখি। আমাদের বাড়ি, পাড়া, ইস্কুল থেকে যে ছেলেটি বা মেয়েটিকে দেখে আসছি, হয়তো বা একসঙ্গে বেড়ে ওঠার কারণেই তার উপর ততটা দখলদারি জন্মায় না যতটা হয় উত্তর-কৈশোরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে একটি মেয়ে ও একটি ছেলের মধ্যে। সেই সম্পর্কের সহজতাকে নষ্ট করছে আজকের আবহ, কেউ বা বলবেন বিশ্বায়ন। তা যেমন ফেসবুকে ‘ফেক’ প্রোফাইল তৈরি করে ঠকাতে শেখাচ্ছে, তেমনই তো কামদুনির জন্য মোমবাতি হাতে দাঁড়াতে শেখাচ্ছে। তাই ফেসবুকের ‘ফেক’ প্রোফাইল নিয়ে আমরা যেমন সতর্কবার্তা দিই, তেমনই কি সত্যিকারের বন্ধুদেরও এ বার চিনতে হবে বলে বার্তা দেব?
নিশ্চয়ই না। কারণ এখনও সত্যি বন্ধুত্বের গল্পগুলোই সংখ্যায় বেশি। কত ধরনের অসুবিধের মধ্যে থেকেও একটি মেয়ে একটি ছেলের পাশে, কয়েকটি মেয়ে একটি ছেলের পাশে, একটি ছেলে একটি মেয়ের পাশে বা কয়েকটি ছেলে একটি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে, তার অসংখ্য আখ্যানও এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে ছড়িয়ে আছে। আমরা শুধু যারা দল পাকিয়ে বদমায়েশি করেছে, তাদের কথাই খেয়াল রাখব? সব বন্ধুরা মিলেই এই সব নজরদারি, তা সতীর্থদের হোক বা কর্তৃপক্ষের, তা নিয়ে যেন প্রশ্ন তোলার সাহস যেন রাখি। না হলে আমরা মুক্তমনের ক্যাম্পাসের ঠিক উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারব না, সে জিআরই আর টোয়েফ্ল-এ যতই ভাল ফল করি না কেন।