প্রবন্ধ ১

বিশুদ্ধ নারী ও বিশুদ্ধ পুরুষের ছক ভেঙে

সর্বোচ্চ আদালতের রায় জানিয়ে দিল, পুরুষ এবং নারীর ধারণাগুলো কোনও ছকে বাঁধা নয়, কেউ পুরুষ বা নারীর আরোপিত জেন্ডার ধারণার বাইরে থাকতেই পারে। যাপিত জীবনের এই বাস্তবতা আইনি স্বীকৃতি পেল। রঞ্জিতা বিশ্বাস।সুপ্রিম কোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় আমাদের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের তৃতীয় জেন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এই রায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share:

স্বীকৃতি। আদালতের রায়কে অভিনন্দন জানাতে রূপান্তরকামীদের সমাবেশ। দিল্লি, এপ্রিল ২০১৪। এপি।

সুপ্রিম কোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় আমাদের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের তৃতীয় জেন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এই রায়। সাধারণত রূপান্তরকামী সকল মানুষকেই আমরা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত হিজড়াদের সঙ্গে একই গোষ্ঠীভুক্ত করে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন যে, প্রত্যেক রূপান্তরকামী মানুষের, এমনকী হিজড়াদেরও, আত্ম-পরিচিতির স্বার্থে নিজস্ব জেন্ডার নির্বাচনের, নির্ধারণের স্বাধীনতা তার মৌলিক অধিকার। এক কথায় এই রায় সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ এবং জেন্ডার বা সামাজিক লিঙ্গের কার্যকারণ নির্ধারিত একমুখী সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এ যাবত্‌ যেহেতু আমরা সেক্সের সঙ্গে জেন্ডারকে একাকার করে দেখতে অভ্যস্ত, তাই কোনও এক সেক্সের মানুষ সেই সেক্স নির্ধারিত জেন্ডার ব্যতিরেকে অন্য জেন্ডার পরিচিতি গ্রহণ করলেই সমাজ এবং রাষ্ট্র তার সেই অধিকারকে অস্বীকার করে এসেছে। ভিন্ন জেন্ডার পরিচয় তাকে ঠেলে দিয়েছে প্রান্তে অপমান, বঞ্চনা, নিগ্রহের পরিসরে। এই সামাজিক অস্বীকৃতি, প্রান্তিকীকরণ, বঞ্চনা দূর করার তাগিদে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তৃতীয় জেন্ডারের মানুষদের সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, যাতে তারাও রাষ্ট্রের সকল কল্যাণমূলক কর্মসূচির অংশীদার হয়ে উঠতে পারে। হাজার হাজার রূপান্তরকামী মানুষের কাছে এই আইনি স্বীকৃতি তাই খুব বড় আনন্দের।

Advertisement

আমরা প্রত্যেকেই একটা জেন্ডার পরিচিতি নিয়ে বড় হয়ে উঠি। পরিচিতির এই বীজ বোনা হয়ে যায় আমাদের জন্মমুহূর্তেই; যখন নার্স শিশুর জড়ানো কাপড় সরিয়ে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজনকে বলেন: দেখে নিন ছেলে না মেয়ে; যখন সরকারি সিলমোহর পড়ে জন্মের সার্টিফিকেটের খোপে: পুং/স্ত্রী। এমনকী অস্পষ্ট যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মাল যে শিশু তাকেও এই দুটির কোনও একটি খোপে পুরে দেওয়া হয়। কিনে ফেলা হয় টিক দেওয়া খোপ অনুযায়ী জামাকাড়, খেলনা। এ বার আর প্রশ্ন নয়। খোপকে নিয়ে বড় হও, বাঁচো। গাছে উঠেছিস কেন, তুই কি ছেলে? পা ফাঁক করে বসিস না মা, লোকে খারাপ বলবে। ছোট প্যান্ট পরে ছেলেদের মাথা বিগড়ে দিয়ো না; সন্ধের পরে বাইরে থাকিস না, বিপদ হতে পারে। উল্টো দিকে, এ মা, বেটাছেলে হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছিস? বোনের জামাকাপড় পরেছিস কেন, তুই কি হিজড়ে সাজতে চাস? ছেলে হয়ে নাচ শেখার বায়না কোরো না, বন্ধুরা লেডিস বলে প্যঁাক দেবে। জন্মের আগেই ঠিক হয়ে থাকা এ এক আদর্শ অলঙ্ঘ্য অবশ্যপালনীয় ভূমিকা। এ আবার কী? পুরুষালি বা মেয়েলি, এই সামাজিক ভূমিকায় কিছুটা এ-দিক ও-দিক সহ্য করা হয়, যদি তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু খোপের নিয়ম না মেনে যদি বেচাল হও, যদি লাইন টপকাও, যদি খোপ ভাঙার সাহস দেখাও, তা হলেই তুমি বিকৃত, অসহ্য, সন্দেহজনক তুমি পতিত। তাই প্রান্তে থাকো, সুযোগসুবিধা চেয়ো না, চোখের সামনে এসো না। এলে বরাদ্দ চোখরাঙানি, বাড়াবাড়ি করলেই উত্তমমধ্যম।

আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই খোপের এই বেঁধে দেওয়া আচরণবিধি মেনে নিয়ে দিব্যি সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিলেও অনেকেই বিদ্রোহ করে বসে। নিজের উপর চেপে বসা জেন্ডার পরিচিতির অলঙ্ঘ্যতা মেনে না নিয়ে ‘বিপরীত’ সেক্স নির্ধারিত জেন্ডারের ভূমিকায় ও আচার-আচরণে তাদের অনায়াস যাতায়াত দেখায় যে, নারী ও পুরুষ দুটি পরস্পর বিপরীত অটুট জল-অচল বর্গ নয়। আমরা যারা নারী বলে নিজেদের পরিচয় দিই, দিয়ে সুখে থাকি, তারা অনেকেই রান্না করতে বা নাচতে ভালবাসি, আবেগপ্রবণ হয়ে প্রকাশ্যে সশব্দে কেঁদেও ফেলি। আবার ধূমপান করি, ‘ছেলেদের মতো’ চুলের ছোট ছাঁট দিয়ে বাইক চেপে উদ্দাম হতে চাই। অন্য দিকে, যারা ‘পুং’ খোপে টিক দিয়ে আছি, তাদের মধ্যে অনেকেই মন দিয়ে রাঁধতে ভালবাসি, ‘মেয়েদের মতো’ নাচতে-গাইতে চাই, সেজেগুজে নিজেকে সুন্দর দেখতে চাই বা সোফায় পা ছড়িয়ে বসায় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। একই সঙ্গে হয়তো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দুঃসাহসিক হয়ে উঠি, জমিয়ে ফুটবল খেলি, আবার বৈবাহিক জীবনেও সুখী থাকি। জেন্ডার বহিঃপ্রকাশের এমনই সহনীয় গণ্ডির মধ্যে আমাদের বিচরণ। আমরা চাই না আমাদের আচরণ বা প্রকাশগুলোতে সব সময় পুং/স্ত্রী এই দুই বিধিবদ্ধ জেন্ডার ভূমিকার তকমা সেঁটে যাক; চাই না সমাজ আমাদের বিকৃত বলুক বা ‘সবই পশ্চিমী সংস্কৃতি বা বিশ্বায়নের ফল’ বলে আক্ষেপ করুক বা মস্করা করুক। এমন আচরণ আমাদের কষ্ট দেয়, দূরে সরিয়ে দেয়; নিজেদের অবাঞ্ছিত, একঘরে ভাবতে বাধ্য করে।

Advertisement

কিন্তু আমাদের কারও কারও কাছে জেন্ডারের প্রদত্ত ছক ভাঙাটা কোনও পছন্দ বা শখের বিষয় নয়। বরং নিজের মতো বাঁচার, আত্মপ্রকাশের অত্যাগসহন তাগিদ। আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচরণ, যাপন অপর জেন্ডার-সুলভ। যাঁরা আমাদের বুঝেছেন তাঁদের কাছে আমরা রূপান্তরকামী, কিন্তু অনেকেই আমাদের ‘বিকৃত’ বা ‘অস্বাভাবিক’ ভেবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন, নিজেদের আচরণ বদলাতে বাধ্য করতে চেয়েছেন, প্রয়োজনে আমাদের উপর নামিয়েছেন শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়ন। স্কুলকলেজ থেকে, বাড়ি থেকে, কাজের জায়গা থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; পরিবারের সম্মান ধরে রাখতে মেরেও ফেলা হয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়েছি ভিক্ষা করতে বা আত্মহননের পথ বেছে নিতে।

আমাদের এমনই এক রূপান্তরকামী বন্ধু কেবল অপর জেন্ডার অনুসারী আচরণ বা পোশাক-আসাকে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, সে বদলে ফেলতে চায় তার শরীরকেও। জন্মেছে সে স্ত্রী যৌনাঙ্গ নিয়ে। পরিবার সমাজ চেয়েছে সে নারী হয়ে উঠুক। কিন্তু শরীরে-মননে সে তো নিজেকে পুরুষ বলে মনে করে, সে ভাবেই বাঁচে এবং বাঁচতে চায়। তার এই ‘অবাধ্য’ বাঁচা তাকে ঠেলে দেয় মার্জিনে, তার জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সে তার নারীশরীরে নিজেকে বন্দি মনে করে। সে তার শরীর-মনকে যত দূর সম্ভব পুরুষ করে তুলতে চায়। আমরা অনেকেই তাকে অসুস্থ, পাগল বা সমাজবিরোধী বলতে দ্বিধা করি না। খুঁজে বেড়াই তার এই আকাঙ্ক্ষার জৈবিক, সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণ। যদিও জৈবসত্তা বা সামাজিক পরিমণ্ডল কোনওটাই জেন্ডারের অমোঘ নির্ণায়ক হিসেবে প্রমাণিত নয়। জেন্ডারকে এ-রকম কোনও যান্ত্রিক কার্যকারণ সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

বিজ্ঞান এবং সাধারণ বুদ্ধি, দুইই বলে যে, মানুষ নামক প্রজাতির দুটি সেক্স বা জৈবিক লিঙ্গ: পুরুষ বা স্ত্রী। এই দুই শরীর যৌনাঙ্গ, ক্রোমোজোম, হরমোন, মস্তিষ্কের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের তফাত নিয়ে জন্মায় এবং তাদের জেন্ডার বা সামাজিক লিঙ্গও সেই অনুসারেই বিবর্তিত হয়। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিনতায় আমি নিজেকে কোন জেন্ডারের সঙ্গে কতটা একাত্ম বলে মনে করব, বিজ্ঞান কিংবা সামাজিক পরিমণ্ডল কেউই সেটা ঠিক করে দিতে পারে না। ক্রোমোজোম, হরমোন, পরিবেশের প্রভাবকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, একটি শিশু অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের নানান উদ্দীপনায় সাড়া দিতে দিতেই নিজের সত্তাকে খুঁজে পায়, জেন্ডার পরিচয় যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ এক জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া।

আমরা যারা নিজেদের অন্য রকম মনে করি, তারা এত দিন হয় প্রান্তিক হয়ে ছিলাম, অদৃশ্য হয়ে ছিলাম, নয়তো তীব্র বঞ্চনার শিকার হয়ে ছিলাম, কারণ নিজেদের উপর জন্ম থেকে চেপে বসা জেন্ডার পরিচয়কে আমরা কোনও দিনই মেনে নিতে পারিনি। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ আমাদের নিজেদের কথা শোনানোর সুযোগ করে দিয়েছে। অন্য রকম হয়েও, অন্য রকম থেকেও সমান অধিকার দাবি করার অবকাশ দিয়েছে। কথা, আচরণ, পোশাক, এমনকী শরীর পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নিজের জেন্ডার পরিচিতি জানানোর স্বাধীনতা পেয়েছি। অর্থাত্‌, সর্বোচ্চ আদালতের এই ঘোষণা জানিয়ে দিল, পুরুষ এবং নারীর ধারণাগুলো কোনও ছকে বাঁধা নয়, অপরিবর্তনীয় নয় এবং কেউ পুরুষ বা নারীর আরোপিত জেন্ডার ধারণার বাইরে থাকতেই পারে। এতদিনকার যাপিত জীবনের এই বাস্তবতা আইনি স্বীকৃতি পেল।

তবে এই রায় যেমন নতুন ভাবে বাঁচার আশা জাগায়, তেমনই সংশয়ের কাঁটার খোঁচাও লাগে। তৃতীয় জেন্ডারের স্বীকৃতি নারী-পুরুষের আধিপত্যকারী দ্বিত্ববাদী ছকটাকে হয়তো ভাঙতে সাহায্য করবে, কিন্তু আর একটা নতুন খোপ তৈরি করবে না তো? এতদিনকার চেনা দুই খোপের মধ্যে যাকে আঁটা যাবে না, তাকেই পাইকারি ভাবে তিন নম্বর খোপে পুরে দেওয়া হবে না তো? এক দিকে থাকবে ‘বিশুদ্ধ নারী/পুরুষ, আর যারা ‘এলোমেলো’ ‘পাঁচমিশেলি’ তারাই হয়ে যাবে তৃতীয় জেন্ডার? অর্থাত্‌, দুইয়ের আধিপত্য থেকে তিনের আধিপত্য, বা দুইয়ের আধিপত্য আরও আঁটোসাঁটো ও জোরদার হয়ে উঠবে। যারা নিজেদের তৃতীয় জেন্ডার বলে অভিহিত করতে চায়, তারা তা নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু যারা তা চায় না, যারা নিজেদের কোনও একটি খোপের মধ্যে পুরে দিতে অনিচ্ছুক, বা যে নারী বা পুরুষ তার প্রদত্ত জেন্ডার পরিচিতি ত্যাগ করে অপর জেন্ডার পরিচয়ে বাঁচতে চায়, তাদের সকলেরই যেন সে স্বাধীনতা থাকে। অর্থাত্‌, এক দুই তিন বা সাতের বর্ণালিকে ছাপিয়ে আমরা যেন জেন্ডার পরিচিতির সকল সম্ভাব্য রংকেই ধারণ করে চলতে পারি।

মন-চিকিত্‌সক; যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবী বিদ্যা চর্চা কেন্দ্র-র সঙ্গে যুক্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement