নদী শিকার। ব্রহ্মপুত্রে জাংমু বিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধার, তিব্বত, চিন। ছবি: এএফপি।
২২ নভেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বতে ভারত-সীমান্ত থেকে অদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরে চিন একটি ড্যাম তৈরির কাজের শেষে সেখানে একটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও তৈরি করে তা থেকে ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে।
খবরটা আমাদের দেশে পৌঁছেছে একমাত্র এই কারণেই সম্ভবত যে, জায়গাটা উত্তর ভুটানের সোজা উত্তরে ও কাছে। আর পাহাড়ে বহু দূরের আলোও দেখা যায়— এটা দূরও নয় তত। কিন্তু আমাদের দুটো-একটা কাগজে এক দিন ভুল ম্যাপ-সহ যা খবর বেরিয়েছে, তাতে অরুণাচল প্রদেশের কথাই বলা হয়েছে, যেহেতু তিব্বতের ওই ব্রহ্মপুত্রই আরও খানিকটা প্রায় সরলরেখায় বয়ে এসে সমকোণে ডাইনে বেঁকে আমাদের ব্রহ্মপুত্র হয়ে অরুণাচলে ঢুকে, একটা সেকেন্ডে ব্র্যাকেটের মতো অসম পেরিয়ে বাংলাদেশের মেঘনায় পড়েছে।
তিব্বতের ও অরুণাচলের ব্রহ্মপুত্রের নানা নাম আছে— নদীর নাম বাঁকে-বাঁকে যেমন বদলায়, কিন্তু যে-নামে সে সবচেয়ে বেশি নদী বলে পরিচিত ও ব্যবহৃত, শেষ পর্যন্ত সেটাই তার নাম থেকে যায়। আমাদের যে দু-একটি কাগজে খবরটা দেওয়া হয়েছে, তাতে এই নামবিভ্রাটের ফলে কেন এ বাঁধ ভারতের পক্ষে বিপদের সমূহ কারণ, সেটাই গুলিয়ে আছে।
২০০১-এ অরুণাচলের এই নদীতে আকস্মিক প্রবল বন্যার ফলে ২৬ জন ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল, যদিও তখনই জানা ছিল যে আরও অনেকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এই বন্যাটা ঘটেছিল একটা বড় পাহাড়ের অনেকটা ধসে আটকে-পড়া নদীটা হঠাৎ প্রাকৃতিক কোনও কারণেই ছাড়া পাওয়ায়। বেশি বৃষ্টির খুব উঁচু পর্বতে এমন আকস্মিক নদীপ্রপাত ও আরও উপরে তুষার অঞ্চলে তুষারপ্রপাত ঘটতেই পারে।
তিব্বতের ব্রহ্মপুত্রের ওপর ড্যামের কথাটা প্রথম উঠেছিল ২০০৯ সালের অগস্টে, কাঠমান্ডুতে স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপ-এর এক পাঠশালায়। সেখানে চিনা প্রতিনিধিরা এই বাঁধ তৈরির কথা অস্বীকার করে বলেন, ২০০১ সালের বন্যাটা হয়েছিল সিয়াঙ নদীতে। সিয়াঙ ব্রহ্মপুত্রেরই একটি অংশের নাম।
২০১০-এ চিন স্বীকার করতে বাধ্য হয় বটে, কিন্তু বলে ওগুলো ড্যাম নয়, নদীর ভিতরে আল বেঁধে নদীর জল স্থানীয় ভাবে ব্যবহারের প্রচলিত পদ্ধতি। আমাদের সুন্দরবনে এই পদ্ধতি খুবই ব্যবহৃত হয়।
২০১০ থেকে তিন বার তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ চিনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কথাটা তুলেছিলেন। বার বারই তিনি একই জবাব পান যে, ‘এই ড্যাম নদীর প্রবাহপথে কোনও পরিবর্তন ঘটাবে না, এবং ভাটির দেশ হিসেবে নদীর জলের ওপর ভারতের অধিকার লঙ্ঘিত হবে না।’
জল নিয়ে বোধহয় সবচেয়ে বেশি মিথ্যে বলা হয়। এই সে দিন তামিলনাড়ু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নালিশ করেছে যে, কর্নাটক চুক্তির চাইতে কম জল ছাড়ছে। তিস্তা নিয়ে সিকিম সরকার দিনের পর দিন বলে যাচ্ছেন যে, তাঁরা জলে শুধুই আল বাঁধছেন, অথচ সেই জলের আল থেকেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছেন! প্রতিরক্ষার কারণে এ বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয় না। ফলে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর ড্যাম যে উত্তরবঙ্গের পক্ষে কী বিপদ ঘনিয়ে তুলেছে, সে বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকার, কেন্দ্রের সরকার, আমাদের রাজ্যের বা কেন্দ্রের জলমন্ত্রক বা কমিশন, আমাদের জনপ্রতিনিধি— সকলেই একেবারে নিঃসাড়।
ব্রহ্মপুত্রের প্রধানতম উপনদী রাইডাক, সঙ্কোশ ও সন্নিহিত মানস উত্তর বাংলার নদী। তিস্তা জলপাইগুড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে ঢুকে ব্রহ্মপুত্রে পড়েছে। তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করে আলাদা খাল কেটে গাজোলডোবা থেকে তিস্তার জল কিছু দূর পর্যন্ত হারা উদ্দেশে বওয়ানো হয়েই চলেছে— প্রশ্ন করলে কেউ জবাব দেয় না, মনে হয় গাজোলডোবা তিব্বতের চাইতেও দূরবর্তী। বামফ্রন্টের সঙ্গে তৃণমূলের এমন ঘোর শত্রুতা সত্ত্বেও তৃণমূলের কেউ কখনও এই কথাটা তুলে বামফ্রন্টকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেনি যে, এই ব্যারাজ ও খালটা বানানো ও কাটা হয়েছিল কেন। ফলে, আমাদের মতো পাবলিক ঢাকঢাক গুড়গুড় না করেই জানিয়ে আসছে যে, এই ব্যারাজ ও খালের ফলে তিস্তার উপর নির্ভরশীল জলপাইগুড়ির কৃষির ক্ষতি হচ্ছে এবং সে ক্ষতি কোনও দিন পূরণ হবে না। এ নিয়ে উত্তরবঙ্গের লোকজনেরও মাথাব্যথা নেই, কারণ উদ্ভিদব্যাধি সংক্রমণের কারণে উত্তরবঙ্গের কৃষিপণ্যের গঙ্গা পেরনো নিষিদ্ধ; ভায়া পূর্ণিয়া পশ্চিম বিহার ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশে উত্তরবঙ্গের সব্জি তা-ও তো একটা বাজার পাচ্ছে। এ দিকে তিস্তা ব্যারাজের এবং খালের ফলে বাংলাদেশের উত্তরের ডাঙায় এক দিন কৃষির যে বান ডেকেছিল, তা গত পাঁচ-সাত বছরে ধসে যাচ্ছে।
তিব্বতের ব্রহ্মপুত্রে চিন সবে একটা ড্যাম খাড়া করে ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি শুরু করেছে। এই ড্যামের ডাইনে দুটো ও বাঁয়ে একটা ড্যাম হবে ও এই চারটি ড্যাম মিলে মোট ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। পাশাপাশি চার-চারটি ড্যাম থেকে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি হলে ব্রহ্মপুত্রের জল ও স্রোতের ওপর তার প্রভাব না পড়েই পারে না। চিন কখনওই তাদের পুরো পরিকল্পনা প্রকাশ করে না। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বই ও লেখাপত্রে ম্যাপ ও নকশা-সহ বলা হয়েছে যে, চিন এই বিদ্যুৎ উত্তর তিব্বতের শিল্পের কাজে লাগাতে চায়। যাঁরা এ-সব তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণিত। তাঁদের দু-এক জন তো ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের নামে প্রকৃতিলুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে কাজ করে চলেছেন।
আমরা এমন একটা বাস্তব আশঙ্কার মুখে এসে পড়েছি যে বছর পঞ্চাশের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যাবে। সেই কাজে আমরা সাহায্য করছি তিস্তা ব্যারাজ বেঁধে নিম্ন ব্রহ্মপুত্রকে শুকিয়ে দিয়ে আর চিন সাহায্য করছে উচ্চ ব্রহ্মপুত্রকে শুকিয়ে দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর এমন বিরল নদী, যে নদীতে ওই উচ্চতায় জোয়ার-ভাঁটা খেলে ও নদীখাত বদলায়। ময়মনসিং ও সিলেটে ব্রহ্মপুত্রের পুরনো খাত এক-একটা ভৌগোলিক চিহ্ন। কিন্তু এখন আমরা এটাকে ভাবি— বাংলাদেশ আর অসমের নদী।
সেটা নিশ্চিত হয়েছে উনিশ শতকে ইংরেজদের তিব্বত অভিযানের ফলে। এত বড় ও প্রধান একটা নদীপথ কেমন একটু সাংস্কৃতিক আড়ালে থেকে গেল। এ নদী প্রধানত অসমের একটি দিক দিয়ে বয়ে তখনকার বাংলা প্রেসিডেন্সির এক পাশ— এখনকার বাংলাদেশ দিয়ে নেমে মেঘনা-পদ্মা হয়ে সমুদ্রে মিশে গিয়েছে। যেন একটু আড়ালে-আড়ালে এসে সমুদ্রে ডুবে গেছে। অসম বলে একটা লেবেলে ঈশান কোণের ভারতের বিপুল ও অনির্দিষ্ট বিবিধকে ঠেসে রেখেছিল সাহেবরা। গত শতকের সত্তর-পঁচাত্তর পর্যন্ত আমরাও তা-ই করে গিয়েছি।
সেই অজ্ঞানতা বিষ হয়ে উঠেছে। বিশ্বভারতী, দিল্লি, বেঙ্গালুরু— এ সব জায়গাতে উত্তর-পূর্বের তরুণতরুণীরা নানা রকম সন্দেহে অপমানিত হয়েই চলেছেন। তাঁরা ভারতীয় হিসেবে চেনা নন। ব্রহ্মপুত্রও যেন ততটা চেনা নয়।
এখন আত্মরক্ষার কারণে চেনা দরকার। একই সঙ্গে তিস্তা ব্যারাজ ভেঙে ফেলে চিনকে তাদের ড্যাম ভেঙে ফেলতে বাধ্য করা।