মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুন। সিঙ্গাপুর, অগস্ট ২০১৪
ভারত ও সিঙ্গাপুর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ করতে চলেছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে এসে বর্ষব্যাপী উদ্যাপন পর্বের সূচনা করেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব কতটা?
ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনেই ছিল সিঙ্গাপুর। স্ট্যাম্পফোর্ড র্যাফেল সাহেবের সঙ্গে যে সিপাইরা এখানকার মাটিতে প্রথম পা রাখেন, তাঁরা সকলেই বাঙালি সিপাই ছিলেন। সেই সময় থেকে অসংখ্য ভারতীয় এ দেশে চলে এসেছিলেন। এখানকার জনসংখ্যা, সংস্কৃতি এবং সমাজে তারও যথেষ্ট প্রভাব রয়ে গিয়েছে। ভারতই অন্যতম দেশ যারা ১৯৬৫ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রথমেই সিঙ্গাপুরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ২০১৫ সালে আমরা সেই কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালন করব। বহু ভারতীয় কোম্পানি এবং ভারত থেকে সিঙ্গাপুরে এসে থিতু হওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা এ দেশের বিকাশে বড় ভূমিকা নিয়েছেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে, দলনির্বিশেষে রাজনৈতিক সম্পর্কও মজবুত।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর আপনি আসিয়ান দেশগুলির প্রথম বিদেশমন্ত্রী হিসাবে ভারতে যান। কেমন ছিল সেই সফর?
খুবই ভাল। আমি দিল্লি গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীদের সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে দু’দেশের সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গেও দেখা করেছি। হায়দরাবাদে দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই (চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং কে চন্দ্রশেখর রাও) দেখা হয়। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চেন্নাইয়ে কথা বলেছি। প্রত্যেকেই সিঙ্গাপুর নিয়ে আগ্রহী।
তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এখানে আবার কথা হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এক দিন মধ্যাহ্নভোজে অনেক কথা হল। সেপ্টেম্বরেই রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও নিশ্চয় শীঘ্রই এখানে আসবেন। একটা জিনিস বুঝতে পারছি, ভারতের সর্বত্র সিঙ্গাপুর নিয়ে দারুণ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
দিল্লিতে নতুন সরকার আসার পর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করছেন?
এটা বলা বেশ কঠিন। আমাদের সম্পর্ক বরাবরই বেশ ভাল। এখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি আরও জোরদার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্তরেও তা অব্যাহত। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
গত বছর সিঙ্গাপুর থেকেই ভারতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ গিয়েছে...
শুধু তা-ই নয়, আসিয়ান দেশগুলির মধ্যে আমরাই ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য-শরিক (ট্রেডিং পার্টনার)। আসিয়ান অঞ্চল ভারতের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ছ’হাজারের বেশি ভারতীয় কোম্পানি সিঙ্গাপুরের মাটিতে রয়েছে। তারা মনে করে পুঁজি জোগাড়, ব্যবসা করা ও আশপাশের অঞ্চলে কোম্পানির বিস্তারের জন্য সিঙ্গাপুর গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের অনেক কোম্পানিও ভারতে কাজ করছে।
নতুন কোন দিকে বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসারের সুযোগ রয়েছে?
উদাহরণ স্বরূপ বিমান চলাচলের কথা বলা চলে। আমি মনে করি সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ভারতের আরও বেশ কিছু এলাকা, যেমন পুণে, মাদুরাইয়ের মতো শহরের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ চালু হওয়া উচিত। সরাসরি সংযোগের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমার আশা, বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে দুই দেশ আরও উদার নীতি গ্রহণ করবে।
আপনি বলতে চাইছেন, আরও বেশি ল্যান্ডিং রাইটস দেওয়া দরকার?
ঠিক। ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে কথা চলছে। বস্তুত, আমাদের দু’দেশের কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট (সিইসিএ) নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।
আপনি অসম সফরেও গিয়েছিলেন। সিঙ্গাপুর কি ভারতের দ্বিতীয় শ্রেণির শহরগুলির দিকেও নজর দিচ্ছে?
এ বার নয়, ২০১২ সালে আমি অসমে গিয়েছিলাম। সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবেন তার সিদ্ধান্ত কিন্তু সরকার নেয় না। তবে হ্যাঁ, ভারতের উত্তর-পূর্বে সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীরা খুব একটা যাননি। আমার মনে হয়েছিল সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসি। ওই অঞ্চলে পর্যটন ও পরিষেবায় লগ্নির সুযোগ রয়েছে।
আমি এটাও বলতে চাই, লগ্নিকারীরা সব দিক বিচার করে, বিশেষত রাজনৈতিক ঝুঁকি মেপেই সিদ্ধান্ত নেন। নিরাপত্তার দিকটিও রয়েছে। হতে পারে, বাস্তবে কোনও এলাকার পরিস্থিতি শান্ত, কিন্তু যদি কোনও অঞ্চলে হামলার ঘটনা খবরে আসে, তা হলে লগ্নিকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এটা ব্যবসায় ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এগুলো ব্যবসায়ীরা বার বার ভাবেন। তবে চেষ্টা করব যাতে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসাবে উত্তর-পূর্বকে এখানে জনপ্রিয় করা যায়।
দিল্লি সফরে স্মার্ট সিটি, গঙ্গা দূষণ রোধ, দিল্লি-মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর প্রভৃতি প্রকল্প নিয়ে আপনার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কথা হয়েছে। সিঙ্গাপুর কী ভাবে এই সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে?
প্রাথমিক ভাবে সহযোগিতার নানা ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। আরও বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। দু’তরফের অফিসাররা কী কী করা সম্ভব তা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা শুরু করেছেন। জল সংক্রান্ত (গঙ্গা শোধন অভিযান) বিষয়ে আমাদের লোকজন ভারতে গিয়েছে। আমাদের এ নিয়ে কিছু পারদর্শিতা রয়েছে। স্মার্ট সিটি প্রকল্প নিয়েও অফিসাররা গিয়েছেন। আমরা নিজেরাই ছোট দেশ, তবে একটি বা দুটি শহর নিয়ে আমরা কিছু করতে পারি। দিল্লির পাশাপাশি আরও একটি বিশ্বমানের স্কিল সেন্টার তৈরির কাজেও হাত দেওয়া হচ্ছে। কোথায় সেটা তৈরি হবে তার খোঁজ চলছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার কথা হল। কী মনে হচ্ছে?
উনি খুবই প্রাণবন্ত। তাঁর অভিমুখ খুবই স্পষ্ট। তিনি জানেন তাঁকে কী করতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে তাঁর এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেখা করা। লগ্নিকারীরাও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। দেখুন, ওঁরা কী চান মূলত কত তাড়াতাড়ি ছাড়পত্র পাওয়া যাবে? জমি মিলবে তো? শ্রম আইন কেমন? ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের আগে এ সবই জানতে চান। মুখ্যমন্ত্রী আমায় জানিয়েছেন, তিনি রাজ্যে ধর্মঘটের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছেন। শ্রম সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে ভাল পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তিনি ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরি করেছেন, সেখান থেকে জমি পাওয়া যাবে। মধ্যাহ্নভোজের সময় তিনি মূলত আর্থিক বিষয় নিয়েই আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন। আমি অবশ্য ব্যবসায়ী নই। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনও ধারণাও নেই। উনি দাবি করলেন, এখানকার যে সব বিনিয়োগকারীর সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন, তাঁরা রাজ্য নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন।
ভারতের বেশ কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রী বিনিয়োগ পেতে সিঙ্গাপুরে সফর করছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমরা বেশ কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছি যাঁরা বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য উৎসাহী। তাঁরা উন্নয়ন এবং অর্থনীতির ভাষাতেই কথা বলেন। যেমন কে চন্দ্রশেখর রাও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নায়ডু কিংবা জে জয়ললিতা। যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রত্যেকেই সরাসরি বিদেশি লগ্নি, বিনিয়োগ, উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কথা বলেছেন। আমার মনে হয়, ভারতের পক্ষে এ প্রয়াস খুবই ভাল।
মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
সেটা ভালই।
এখানকার লগ্নিকারীরা ভারতের কোনও রাজ্যে বিনিয়োগের আগে ঠিক কী কী দেখে নিতে চান? আদর্শ পরিস্থিতি বলতে কী বোঝাবেন?
ভারত হোক বা অন্য কোথাও, আদর্শ পরিস্থিতিটা সব ক্ষেত্রেই একই। যে সব বিদেশি বিনিয়োগকারী সিঙ্গাপুরে লগ্নি করতে আসবেন তাঁদের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি থাকা দরকার। যখন কেউ বিনিয়োগ করতে যায়, প্রথমেই সে দেখে তা সুরক্ষিত কি না। এটাই প্রথম কথা। যার অর্থ রাজনৈতিক এবং আইনগত স্থিরতা। এই স্থিরতা না থাকলে কেউ বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে না। দ্বিতীয় বিষয় হল নিরাপত্তা। কেউ কারখানা করল বা ব্যবসা শুরু করল, তার পর যদি যে কোনও ধরনের হামলা হতে থাকে, তা হলে লগ্নিকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ ছাড়াও, কারখানা স্থাপনের জন্য জমি, দক্ষ শ্রমিক চাই। ভারতে অবশ্য উচ্চশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব নেই। পাশাপাশি সকলেই সিঙ্গল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্সও চায়।
সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলি বেশির ভাগই পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে বিনিয়োগ করে।
এটা অনেকটা প্রথাগত ভাবেই হয়ে আসছে। ভারতের সেই সব এলাকা সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের লগ্নিকারীরা ভাল বোঝেন, যেখান থেকে অতীতে ভারতীয়রা এ দেশে এসেছিলেন। যেমন মূলত কেরল, তামিলনাডু, মহারাষ্ট্র, গুজরাত বা পঞ্জাব। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সে ভাবে লোকজন আসেননি। তা ছাড়া, আপনাদের মুখ্যমন্ত্রীই আমাকে জানিয়েছেন, বেশ কিছু বছর পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল না। এও জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে দিয়েছেন।
মানে এখনও পরিস্থিতি যাচাই করার পালা...
একেবারেই। পরিস্থিতি যাচাই করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কোনও খোঁজখবর করেননি?
তেমন ভাবে কিছু করিনি। সেটা আমার কাজও নয়। আমি শুনি, জানি, সেই মতো শিল্পপতিদের উৎসাহ দিই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। মুখ্যমন্ত্রী জানালেন অনেকগুলো মউ সই হয়েছে। বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে কয়েকটি বড় সংস্থা। চাঙ্গি বিমানবন্দর সংস্থা ওখানে তুলনায় বড় বিনিয়োগ করেছে। উনি জানিয়েছেন অ্যাসেন্ডাসের মতো সংস্থাও নাকি যেতে আগ্রহী। আমি মনে করি, বিনিয়োগের আগে এই সংস্থাগুলি নিজেরা খোঁজখবর করে নেবে।