প্রবন্ধ ১

বিজেপি যে অস্ত্রে ঘায়েল, সেটি বুমেরাং

রাজধানীর ভোটদাতারা নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর প্রধান সেনাপতিকে কয়েকটা কথা সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এই যে, অহঙ্কার এবং নিজের সম্বন্ধে অতিরিক্ত উচ্চ ধারণা সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন না।আমাদের ঠাকুরদা-ঠাকুমারা একটা কথা বলতেন। অহঙ্কার ও বোকামি: এই দুটি জিনিস যদি কারও চরিত্রে একসঙ্গে মিশে যায়, তবে তার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। ২০১৪ সালের জয়ের পর বিজেপি ভেবে নিয়েছিল, একা নরেন্দ্র মোদীর নাম তাদের হয়ে ভারতে সুনামি বওয়াবে, দেশের যে কোনও জায়গায় তাদের জিতিয়ে দেবে।

Advertisement

পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

সম্মার্জনী। দিল্লি, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। ছবি: এএফপি।

আমাদের ঠাকুরদা-ঠাকুমারা একটা কথা বলতেন। অহঙ্কার ও বোকামি: এই দুটি জিনিস যদি কারও চরিত্রে একসঙ্গে মিশে যায়, তবে তার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। ২০১৪ সালের জয়ের পর বিজেপি ভেবে নিয়েছিল, একা নরেন্দ্র মোদীর নাম তাদের হয়ে ভারতে সুনামি বওয়াবে, দেশের যে কোনও জায়গায় তাদের জিতিয়ে দেবে। এটা একটা অহঙ্কার। আর, দলের পক্ষ থেকে তেমন কিছুই কাজকর্ম না করে শেষে কিরণ বেদীকে দলের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী স্থির করা— চূড়ান্ত বোকামি। ফলে মঙ্গলবার দিল্লির নির্বাচনের ফলাফলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। যা হওয়ার ছিল তা-ই হয়েছে।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর জয়রথ দিল্লিতে প্রথম বড় রকমের ধাক্কা খেল, সেটা অবশ্যই এই নির্বাচনের একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যক্তির আধিপত্য যে ভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, এই ফলাফল তার সীমাবদ্ধতাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাজধানীর ভোটদাতারা নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহকে কয়েকটা কথা সাফ সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এই যে, নেতাদের অহঙ্কার এবং নিজের সম্বন্ধে অতিরিক্ত উচ্চ ধারণা সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন না।

এই ফলাফল থেকে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের গতিপ্রকৃতিতে জাতপাত এবং ধর্মীয় পরিচিতির ভূমিকা ক্রমশ কমছে। দক্ষিণপন্থী আদর্শে বিশ্বাসীরাও এখন স্বীকার করছেন যে, নির্বাচনী রাজনীতিতে ভোটদাতাদের শ্রেণি-চরিত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লির মতো বড় শহরে, যেখানে বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বর্গের মানুষ বসবাস করেন।

Advertisement

আর একটা সত্য এই ফলাফল থেকে বোঝা যায়। মধ্যবিত্ত এবং সম্পন্ন নাগরিকরা যে সব প্রকল্পকে ‘জনমোহিনী’ বলে মনে করেন, যেমন ভর্তুকি দিয়ে নানান জনপরিষেবা সরবরাহ করার কর্মসূচি, সেগুলির মুণ্ডপাত করার কোনও সুযোগ ছাড়েন না। কিন্তু দরিদ্র মানুষের কাছে এগুলি খুবই জরুরি ব্যাপার, তাঁরা সরকারি বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেয়ে সস্তায় জল বা বিদ্যুৎ পাওয়াকে অনেক বেশি মূল্য দেন। এটা আর্থিক অপচয়ের পক্ষে সওয়াল করার ব্যাপার নয়, বলার কথা এই যে, ভর্তুকি ঠিক ঠিক প্রাপকের হাতে না পৌঁছনো নিশ্চয়ই একটা সমস্যা, সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি সাধন করে সেই সমস্যার মোকাবিলা জরুরি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে দানসত্র বা হরির লুঠ বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে হবে বা সেগুলিকে তুলে দিতে হবে কিংবা তাদের বরাদ্দ ছাঁটাই করতে হবে। এই ধরনের সওয়াল আসলে সমাজের সুযোগবঞ্চিত বর্গের মানুষকে অপমানের শামিল হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল এটাই যে, বিজেপির ভোট-যন্ত্রীরা, বিশেষত অমিত শাহ দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো একটা দ্বৈরথে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। লড়াইটা কংগ্রেস ও বিজেপির আদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গাঁধীর ব্যক্তিগত যুদ্ধ। রাজনৈতিক দলের চেয়ে ব্যক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। লোকসভা ভোটে বিজেপির এই কৌশল খুব কাজ দিয়েছে, কিন্তু তাঁরা দিল্লিতেও এই পথে চলতে গিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো ফল পেয়েছেন।

দিল্লি নির্বাচনে কিরণ বেদীকে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে নামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভোটারদের এমন একটা সংকেত দেয়, বিজেপির নেতৃত্ব যার ঠিক উল্টোটা চেয়েছিলেন। প্রথম সংকেত: দল ভোটে জিতলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, বিজেপি সেটা ঠিক করতে পারছিল না বলেই এক বছর ধরে দিল্লি নির্বাচন ঝুলিয়ে রেখেছিল। দ্বিতীয় সংকেত: বিজেপির শীর্ষনেতারা আম আদমি পার্টিকে দুর্বল করতেই বেশি আগ্রহী, আপ-এর কর্মসূচির একটা বিকল্প, এবং একটা উন্নততর বিকল্প পেশ করার উৎসাহ তাদের নেই। তার উপরে, আরএসএস কর্মীরা এমনিতেই হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন, কিরণ বেদীকে ময়দানে নামানোর ফলে তাঁরা আরওই বসে গেলেন, আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ স্থানীয় দলনেতারা যে বহিরাগত কিরণ বেদীর হয়ে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে প্রচারে নামবেন না, সেটা তো জানাই ছিল।

এক কথায়, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির পক্ষে যা কিছু খারাপ হওয়ার কথা ছিল, সবই ঘটেছে। বিজেপির মুখপাত্ররা যখন সওয়াল করেছেন যে, এই নির্বাচনকে মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্ব সম্পর্কে গণভোট হিসেবে দেখা চলে না, সেই সওয়াল কৈফিয়তের মতো শুনিয়েছে, মনে হয়েছে তাঁরা মনে মনে হার মেনে নিয়েছেন এবং সেই পরাজয়ের দায় থেকে আগেভাগে মোদীকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি, স্বয়ং মোদী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সহ দলের বড় বড় নেতারা সবাই মিলে নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়ার ফলে মনে হয়েছে, কেজরীবালকে ঠেকানোর জন্য তাঁরা অতিমাত্রায় তৎপর এবং চিন্তিত।

নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি দাবি করেছে, তারা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এটা খুবই অদ্ভুত দাবি। সবাই জানে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার বরং সেই সুবিধেটা পুরোপুরি জনসাধারণকে নিতে দেয়নি। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী মোদী এ বিষয়ে অনেক বেশি সত্যি কথা বলেছেন, বলেছেন যে, তিনি দেশকে ‘সৌভাগ্য’ এনে দিয়েছেন, তাই তাঁর দলকে ভোট দেওয়া উচিত।

বিজেপি বলেছিল, কেন্দ্রীয় সরকার যে দলের হাতে, দিল্লিতে তাদেরই সরকার থাকলে ভাল। বোঝাই যাচ্ছে, এই যুক্তিকে ভোটাররা বিশেষ পাত্তা দেননি। দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে দলের নীরবতাও এই ভোটে তাদের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে।

প্রচারের শেষ পর্বে যে ভাবে আপ-এর বিরুদ্ধে হাওয়ালায় জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে বিজেপি নেতারা শোরগোল তুলেছেন, সেটাও কিছুটা বুমেরাং হয়েছে। তার কারণ, নির্বাচন কমিশনে নিজেদের অডিট-করা হিসেবনিকেশ দাখিল করার ব্যাপারে বিজেপিও প্রথমে বেশ কিছুটা টালবাহানা করে এবং শেষ পর্যন্ত যখন সেই হিসেব দেয় তখন দেখা যায়, তারা যত অনুদান পেয়েছে তার আশি শতাংশ এসেছে ‘নামহীন’ দাতাদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক দলকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের দেশের আইনে বিস্তর ফাঁক আছে, সেটা সর্বজনবিদিত, তাই বিজেপি এই প্রশ্নে আপ-এর সম্পর্কে অভিযোগ আনলে সেটা অনেকের কানে সূচ সম্পর্কে চালুনির অভিযোগের মতো শুনিয়েছে।

অহমিকার সমস্যাটা সহজবোধ্য। ঔদ্ধত্য মানুষকে বাস্তব থেকে, যে বৃহত্তর জনসাধারণ গণতন্ত্রে যথার্থ শক্তির উৎস, তাঁদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অরবিন্দ কেজরীবালকে তাঁর ঠাকুমা-দিদিমারা নিশ্চয়ই এই সার কথাটা শিখিয়েছেন, এটা মনে রাখলে তিনি ভাল করবেন। আত্মম্ভরী এবং অহঙ্কারী হিসেবে কেজরীবালের যে দুর্নাম রটেছে, নিজের ভালর জন্যই সেটাকে ভুল প্রমাণিত করা তাঁর একটা বড় কর্তব্য। অন্য দিকে, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মুষ্টিমেয় কয়েক জন সহযোগীরও বোধহয় দিল্লি ভোটের ফল থেকে কিছু জরুরি শিক্ষা নেওয়ার আছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement