আজও আন্দোলন। প্রতিবাদী মিছিল, নিউ উয়র্ক, ১ ডিসেম্বর। ছবি: এএফপি।
নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে কৃষ্ণাঙ্গ ইমিগ্র্যান্ট আমাদু দিয়ালো পকেট থেকে ওয়ালেট বার করছিল নিজের বাড়ির দরজার কাছে। পুলিশ অফিসাররা ভাবল তার কাছে বন্দুক আছে। একচল্লিশটা গুলি ছুড়ে তার শরীর ঝাঁঝরা করে দিল। বিচার: অফিসারপুঙ্গবরা বেকসুর খালাস।
নিউ ইয়র্কের কুইন্সে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক সন বেল তার বিয়ের আগের রাতে উদ্দাম ব্যাচেলর পার্টি করে বেরোচ্ছিল। বেরোবার সময় তার গাড়ি এক পুলিশের গাড়িতে মারল ধাক্কা। কী দুঃসাহস! আরও পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল। তারা পঞ্চাশটা গুলি ছুড়ে সনের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিল। বিচার: পুলিশবাহিনী বেকসুর খালাস।
গত সাত বছরের সামগ্রিক রিপোর্টে দেখা গেছে, গড়ে প্রতি সপ্তাহে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে মারা গেছে। হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, এ দেশের পুলিশি বর্বরতার ৯৯ শতাংশেরই কোনও তদন্ত হয় না।
এ বারে মিসৌরি প্রদেশে ফার্গুসন-এ যা ঘটল, সেটা অতএব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কালো ছেলে মাইকেল ব্রাউনকে হত্যার জন্য শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসনের বিরুদ্ধে মিসৌরি কোর্ট কোনও চার্জই আনল না। উইলসন বেকসুর খালাস। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া হিংসা, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, পেট্রোল বোমা, গুলিগোলা, সবই চেনা ছবি। চেনা গল্প। চেনা অবিচার। আমেরিকার রাস্তায় দাঙ্গার সঙ্গে ভারতের দাঙ্গার খুব একটা তফাত নেই।
অগস্ট মাসের ৯ তারিখে দুপুরবেলা মিসৌরির সেন্ট লুইস শহরের উপকণ্ঠে ফার্গুসন নামক কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় আঠেরো বছরের কৃষ্ণাঙ্গ মাইকেল ব্রাউন একটি দোকান থেকে এক বাক্স চুরুট চুরি করে পালাচ্ছিল। পুলিশ দফতরে দোকানের মালিক রিপোর্ট করতে ওয়্যারলেসে অফিসার ড্যারেন উইলসনের কাছে বার্তা আসে ব্রাউনকে ধরার জন্য। পরে অবশ্য জানা যায়, স্টোর থেকে কোনও কর্মচারী পুলিশকে ফোন করেনি। ব্রাউন মারা যাওয়ার আগে কেউ দোকানের ভিডিয়ো সার্ভিলেন্স ফুটেজ দেখেওনি। ফলে, সরকারি বয়ানের সত্যতা সম্পর্কেই সন্দেহের অবকাশ আছে।
সরকারি বয়ান বলছে, উইলসন তখন আর একটি কেসে ওই এলাকায় তার গাড়ি নিয়ে টহল দিচ্ছিল। জিপিএস ও দফতরের বার্তা অনুসরণ করে কিছুদূর গিয়ে উইলসন মাইকেল ব্রাউন ও তার সঙ্গীকে দেখতে রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখে ও তাদের থামতে বলে। এর পর কী ঘটেছিল তা সঠিক কেউ জানে না। উইলসনের বিবৃতি অনুযায়ী, ব্রাউন পুলিশের আদেশ অমান্য করে, এবং শুধু তাই নয়, তেড়ে আসে এবং উইলসনকে মুখে ঘুষি মারে। ফলে, উইলসন গাড়ির মধ্যে থেকে গুলি চালাতে বাধ্য হয় এবং ব্রাউন মারা যায়। অন্য যারা সাক্ষ্য দিয়েছে, তাদের অনেকে কিন্তু বলেছে, ব্রাউন যখন বেশ কিছুটা দূরে ছিল, তখনই গুলি করে উইলসন তাকে হত্যা করে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিচারের রায় বেরোয়। বারো জন সদস্যের গ্র্যান্ড জুরি সাক্ষ্যপ্রমাণ, জবানবন্দি, শারীরিক নানাপ্রকার পরীক্ষা, ময়নাতদন্ত, পোস্ট মর্টেম ইত্যাদির ভিত্তিতে উইলসনকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে।
দেশ জুড়ে উত্তাল হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, এমনকী হিংসা। এক দিকে রাস্তায় পুলিশের মেশিন গান ও মিলিটারি নেমে আসে, টিয়ার গ্যাস চলে, অন্য দিকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পেয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অগস্ট মাসের ১৮ তারিখে তাদের টিম পাঠায়। ওবামা ও তাঁর অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে বার বার আবেদন করেন। প্রসঙ্গত, ওবামা ও হোল্ডার দুজনেই কৃষ্ণাঙ্গ।
প্রশ্ন হল, কেন বার বার এমন ঘটনা ঘটে? কারণ বোঝা কঠিন নয়। চরম দারিদ্র্য, অশিক্ষা, চরম বেকারি, আকাশচুম্বী অর্থনৈতিক বৈষম্য ও হতাশা। অথচ এই আলোচনা বিশেষ চোখে পড়ে না। কোথাও বলা হয় না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ধনী, পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। বহুকথিত ‘আমেরিকান ড্রিম’ কবেই শেষ হয়ে গেছে। নোম চমস্কি এক কথোপকথনে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কলঙ্কিত অধ্যায় শুরু হয়েছিল লক্ষ লক্ষ নেটিভ ইন্ডিয়ানকে নির্বংশ করে দিয়ে, তারই পরের অধ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর দুশো বছরের চরম নির্যাতন। অর্ধশতক আগে সিভিল রাইটস অ্যাক্ট পাশ হয়েছে, ১৯৬৪ সালের সেই আইনের পর ইমিগ্র্যান্ট আইন পাশ হয়। তবু এখনও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি কালোদের ওপর পুলিশি বর্বরতায়, গরিব অভিবাসীদের ওপর সরকারি নিপীড়নে। এই মুহূর্তে আমেরিকায় দশ লক্ষ কালো মানুষ জেলে বন্দি, অনেকেই বিনা বিচারে। সিভিল রাইটস নেতা জেসি জ্যাকসন বলেছেন, এ দেশে যত কালো ছেলেমেয়ে কলেজে পড়ার সুযোগ পায়, তার চেয়ে বেশি জেলে বন্দি থাকে। অধ্যাপক চমস্কি সারা জীবন ধরে আমেরিকার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের কথাও বলে এসেছেন। মার্কিন মিডিয়াতে তিনি ব্রাত্য।
ফার্গুসন। নিউ ইয়র্ক। ফ্লোরিডায় ট্রেভন মার্টিনের হত্যা। লস এঞ্জেলেসে রডনি কিং-এর ওপর পুলিশি নির্যাতন। নিউ ইয়র্কের এবনার লুইমা নামে হাইতির যুবককে ধরে তার মলদ্বারে বাথরুমের ঝাঁটার হাতল ঢুকিয়ে দেওয়া। সবই এ দেশের পুলিশের কীর্তি। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন অথবা ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল এই রকম অধিকাররক্ষা সংগঠনগুলো তাদের রিপোর্টে সে হিসেব প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু আরও অনেক ঘটনা কোনও হিসেবে প্রতিফলিত হয় না। চোখের সামনে থেকেও দৃষ্টির অলক্ষ্যে থেকে যায়। ঠিকই, স্কুলে কলেজে, দোকানে বাজারে, বাসে ট্রেনে বা প্লেনে এখন শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গরা একসঙ্গে যাওয়া-আসা করেন, তাঁদেরকে ‘হোয়াইটস ওনলি’ বাথরুম থেকে বার করে দেওয়া হয় না, ওয়াল স্ট্রিটে ও স্টক মার্কেটে, বা বিভিন্ন কর্পোরেশনে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এখন বেশ উঁচু পোস্টে কাজ করেন, গানে অভিনয়ে পেশাদারি জগতে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মুখ। কিন্তু এ দেশের এক বিরাট সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনের মধ্যে এখনও তীব্র বৈষম্যবোধ, বিশেষত এই মহাদেশের মধ্য ও দক্ষিণ অংশের রক্ষণশীল এলাকাগুলিতে। যেমন, কৃষিপ্রধান টেক্সাস, মিসিসিপি, এলাবামা, জর্জিয়া, কেনটাকি, টেনেসি, লুইসিয়ানা, ক্যারোলাইনা, কিংবা শিক্ষার হারে পশ্চাত্পদ কলোরাডো, ওয়ায়োমিং, ডোকোটা, ইন্ডিয়ানা। এ সব জায়গায় কালো মানুষরা সব সময়েই নিজেদের ‘অন্য রকম’ ভেবে সচেতন থাকেন। দৈনন্দিন জীবনে তাঁদের অধিকার লঙ্ঘন হোক না হোক, এই ভাবনাই তাঁদের আলাদা করে রাখে। লক্ষণীয়, এই সব অঞ্চলে আবার চার্চের প্রাধান্য বেশি। ‘বাইবেল বেল্ট’-এই বৈষম্যবোধটা বেশি শক্তপোক্ত। অর্থাত্ বাইরের বৈষম্যের চেহারাটা পাল্টালেও ভেতরের বৈষম্য কিন্তু তেমন পাল্টায়নি।
নোম চমস্কি-র মতে, শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিদের একটা অংশ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকেন। তাঁরা মনে করেন, এক দিকে কালোরা, অন্য দিকে মেক্সিকো ইত্যাদি দেশ থেকে আসা নতুন ইমিগ্র্যান্টরা ‘গড’স কান্ট্রি’ আমেরিকাকে ধ্বংস অধিকার করে ফেলছে। তাঁদের বোঝানো খুব সহজ যে, তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে বন্দুক, রাইফেল ও গোলাবারুদ রাখাটা একান্ত জরুরি। ওয়াল মার্ট বা গ্রামাঞ্চলের পাড়ার দোকানেই নানা ধরনের রিভলভার ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল কিনতে পাওয়া যায়। তার পরিণাম বোঝার জন্য বেশি কষ্ট করতে হয় না। অর্থাত্, এ দেশে বারাক ওবামাও যেমন ঘটতে পারেন, অতি-দক্ষিণপন্থী ‘টি পার্টি’ও তেমনই জনসর্থন কুড়োতে পারে। এমনকী, কু ক্লাক্স ক্ল্যান ও তাদের নানা প্রকার উপ্ত ও গুপ্ত সংগঠন এখনও বেশ ভালভাবেই বেঁচেবর্তে আছে, টি পার্টি ও চরমপন্থী ব্র্যান্ডের রিপাবলিকানরা তাদের ভরণপোষণ করছে।
একটা কথা না বললেই নয়। অভিবাসী যাঁরা, তাঁদের মানসিকতা অন্য রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ভারতীয় উপমাহাদেশের যে মানুষরা অভিবাসী হিসেবেই এ দেশে এলেও তাঁদের মধ্যে সমানাধিকারের সংজ্ঞাটা আশ্চর্য অদ্ভুত। কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এই ‘ভারতীয়’দের হয় গা-বাঁচানো, নয়তো সরাসরি আক্রমণাত্মক। সুযোগ পেলেই এঁরা কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক কথাবার্তায় মজে যান। অন্য জাতের এবং অন্য দেশের অভিবাসীদের সম্পর্কেও একই মনোভাব। আমি কোনওদিন কোনও বাঙালি বা ভারতীয় পরিবারে বা সোসাইটিতে ফার্গুসন বা ট্রেভন মার্টিন সম্পর্কিত আলোচনায় পুলিশি অত্যাচার, বর্বরতা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনও নিরপেক্ষ বা সহানুভূতিমূলক কথাবার্তা শুনিনি। প্রায় সকলেই দেখে দেখে কালো-মানুষদের পাড়ার বাইরে থাকতে চান। আমাদের ব্রুকলিন অঞ্চলে তাঁরা যখন বেড়াতে আসেন, অনেককে কালো মানুষের ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে থাকেন।
মার্কিনি সন্ত্রাসের এই বাস্তবে ভারতীয় উপমহাদেশের কিন্তু একটা অন্য ভূমিকা আছে। এ দেশের প্রতিবাদী ধারায়, শান্তি-আন্দোলনের কর্মীদের মুখে মুখে ফেরে মোহনদাস কর্মচন্দ্ গাঁধীর অহিংসার বাণী। ভারতীয় ‘যোগ’-এর মতো গাঁঁধীও সে দেশে খুবই ‘পপুলার’। রবীন্দ্রনাথের কথা অবশ্য কেউ জানে না!