সম্পাদকীয় ১

ফিতার দৌরাত্ম্য

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কোথায় নিতান্ত আবশ্যক, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু যদি কোনও একটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ছড়ি সংশায়তীত ভাবেই কাঙ্ক্ষিত বা শুভ না হয়, তবে তাহা শিক্ষাক্ষেত্র। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অভিজ্ঞতাই বলিতেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রিক তর্জনী কতখানি অবাঞ্ছিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কোথায় নিতান্ত আবশ্যক, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু যদি কোনও একটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ছড়ি সংশায়তীত ভাবেই কাঙ্ক্ষিত বা শুভ না হয়, তবে তাহা শিক্ষাক্ষেত্র। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অভিজ্ঞতাই বলিতেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রিক তর্জনী কতখানি অবাঞ্ছিত। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কোন পথে, কী ভাবে, কোন মতে চলিবে, প্রত্যেক দিন তাহা স্থির করিয়া দিবার জন্য রাজধানীতে যে ভাবে একটি পৃথক কমিটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করিতেছে, এই অতিবৃহত্‌ দেশের কোণে কোণে একমেবাদ্বিতীয়ম্ কমিটির সেই তর্জনীসঙ্কেত যে ভাবে নিয়মিত অনর্থ ঘটাইতেছে, তাহাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জয়গান গীত হইতে পারে, কেন্দ্রীকরণ সার্থক প্রতিভাত হইতে পারে, কিন্তু শিক্ষামানের একবিন্দু উন্নতিও সাধন হয় না, বরং তাহা উত্তরোত্তর অবনতি-মুখী হয়। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিকেই দায়িত্ব লইতে হইবে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষণীয় বিষয়ের সন্তোষজনক মান রাখিবার স্বাধীনতা পাইতে হইবে। ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা এই মৌলিক সত্যটি গলাধঃকরণ করিয়া তাহার অপরিমেয় নিয়ন্ত্রণেচ্ছা দমন করুক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বশাসন উপহার দিক, তাহাতেই শিক্ষাব্যবস্থার স্বাস্থ্যোন্নতির সম্ভাবনা। বহু বার এই সব যুক্তি বেণুবনে মুক্তার মতো বিতরিত হইয়াছে। কলিকাতা সফররত নারায়ণমূর্তির কণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন স্পষ্টতায় আবারও একই যুক্তি শোনা গেল। প্রধানমন্ত্রী মোদীর কানে গেল কি?

Advertisement

বাস্তবিক, নারায়ণমূর্তির সতর্কবাণীটি উত্তম মুহূর্তে আসিয়াছে। সম্প্রতি মুম্বই-এ সর্বভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম বার্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা গিয়াছে একটি ব্যতিক্রমী উচ্চারণ: বিজ্ঞানচিন্তা ও গবেষণার প্রসারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারি ফিতার ফাঁস হইতে মুক্তির মাধ্যমে কিয়ত্‌ মাত্রায় স্বশাসন-দানের প্রস্তাব। অবশ্য, ‘কিয়ত্‌’ স্বশাসনের গুণগত ও পরিমাণগত চরিত্র সম্পর্কে দুশ্চিন্তা থাকিয়াই যায়, কেননা একই সঙ্গে শিক্ষানীতির মাধ্যমে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার দুর্ভাবনাও প্রকাশিত হইয়াছে বই কী। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নীতির এই ভ্রান্ত পরিচর্যার মধ্যে ভারতীয় ব্যবস্থার ঐতিহ্যগত দ্বিধা নিহিত। পূর্বতন নেতাদের মতো মোদীও নির্বাচনী গণতন্ত্রের তাগিদে এই একই পরিচর্যায় ব্যস্ত। মুশকিল এই যে, শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষার মান কোনও ‘তন্ত্র’-এর বাধ্যবাধকতা মানিয়া চলে না। বিপরীতে, ন্যায় ও সাম্যের নীতি মানিয়া শিক্ষার যে প্রসার, তাহা কিন্তু রাষ্ট্রের বদলে বাজারের আপন পদ্ধতি দিয়াই সাধন করা যায়।

ফলত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সর্বযজ্ঞ-কান্ডারির ভূমিকাটি মোদী পুনর্বার খতাইয়া দেখিবেন কি না, না কি তাঁহার মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীও পূর্বসূরি কপিল সিব্বলের অনুগামিনী হইবেন, ইহাই মূল প্রশ্ন। এখনও অবধি বক্তৃতায় যাহাই শোনা যাক, ইউপিএ সরকারের নীতিগুলিই কিন্তু এনডিএ আমলেও অক্ষরে অক্ষরে মান্য হইতেছে, চার বত্‌সরের স্নাতক পাঠক্রমই হউক, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষাশিক্ষা উঠাইয়া দিবার ফরমানই হউক, আইআইটি-র প্রবেশিকা নীতিই হউক, দিল্লি আইআইটি ও এনসিইআরটি-র মতো খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরদের পদত্যাগেই হউক, স্মৃতি ইরানির দাপটই সর্বত্র দৃষ্টিগোচর। অথচ কোনও আত্মসম্মানবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই ছড়ির তলায় থাকিয়া উত্‌কর্ষে মনোনিবেশ অসম্ভব। আর্থিক মঞ্জুরির জন্য অর্থ কমিশনের বন্দোবস্তটুকুর বদলে একটি গোটা কেন্দ্রীয় কমিশনের রোজকার দৌরাত্ম্য হজম করিয়া শিক্ষাব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধার অসম্ভব। মোদী যতই ‘লাল ফিতা হ্রাস’ ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি বর্ষণ করুন, তাঁহার কার্যক্রমে এই ভাবনাগুলি না থাকিলে ফিতাই আবার শেষ হাসিটি হাসিবে, সন্দেহ নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement