মা যাহা হইয়াছেন। নিহত তিন সন্তানের মা জরিনা বিবি। লাভপুর, জুন ২০১৪।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা বিষয় প্রধান হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সম্ভবত বিষয়টিকে প্রধান হতে দেওয়া হবে না। ফলে, অবিন্যস্ত রাজনৈতিক পরিসরে রাজ্যের রাজনীতি আরও জট পাকিয়ে যাবে। টানা উন্নয়ন ও নির্বাধ গণতন্ত্র যদি একটা স্থিতিশীল রাজনীতির প্রমাণ হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য তুলনীয় রাজ্যের তুলনায় ক্রমে অবান্তরতর হয়ে যাবে, যদিও রাজ্যের শাসক দলই লোকসভায় চতুর্থ বৃহত্তম।
সেই সম্ভাব্য প্রধান বিষয়টি কী?
ষোড়শ লোকসভার ভোটে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির উত্থানকে নিজ নিজ রাজ্যসীমায় ঠেকিয়ে দিয়েছে তামিলনাড়ু, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের তিন শাসক দল। অন্ধ্রপ্রদেশেও যদি এমন ঘটত, তা হলে বলা যেত ভারতের পূর্ব উপকূলে বিজেপি নেই। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশে কোনও শাসক দলই ছিল না বস্তুত। সুতরাং বিজেপি-বিরোধিতা কোনও রাজনৈতিক চেহারা পায়নি।
তামিলনাড়ু, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এই রাজ্য বিশিষ্ট। রাজ্য সরকারের বয়স সবে তিন পূর্ণ হয়েছে। তামিলনাড়ু ও ওড়িশার রাজনীতি ওই দুই রাজ্যের শাসক দল ও মুখ্যমন্ত্রীরা যেমন স্পষ্টতায় বুঝে নিতে পারেন, তেমন স্পষ্টতা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও মুখ্যমন্ত্রীর আয়ত্তে আসা সম্ভব নয়। এখনও।
ভোটের ফলে দেখা গেল বিজেপি’কে পশ্চিমবঙ্গে রুখে দেওয়ার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও স্বার্থ যাদের সবচেয়ে বেশি ও আন্তরিক, সেই বামফ্রন্ট ও তৃণমূল প্রচারের সময় পরস্পরকে দোষারোপ করে গেছে। বামফ্রন্ট বলেই গেছে, তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে গট-আপ খেলা চলছে। তৃণমূল বলেই গেছে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস-বিজেপি-বামফ্রন্ট গোপনে ঘোঁট পাকিয়েছে।
ফল বেরোলে দেখা গেল, ভোটাররা এঁদের কারও কথাই বিশ্বাস করেননি, বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলকে সম্ভাব্য বিজয়ী ধরে নিয়ে জিতিয়ে দিয়েছেন। যে আটটা আসনে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট-বিজেপি জয়ী, তার একটিও রাজনৈতিক জয় নয়। তৃণমূলের জয়গুলি মুখ্যত রাজনৈতিক।
এই ঘটনার সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ভোটের মিল অবাক করে দেয়ার মতো। তখন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী পার্টিগুলি দুটো আলাদা ফ্রন্টে ভাগ হয়ে গেছে। তাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল কংগ্রেসকে নয়, পরস্পরকে হারানো। প্রমোদ দাশগুপ্ত স্লোগান দিয়েছিলেন: সোমনাথ লাহিড়ীর জামানত বাজেয়াপ্ত করো। বলেছিলেন, এই ভোটে সিপিআই নাশ (পরের ভোটে কংগ্রেস)।
১৯৬৭-র ভোটাররা এ সব কথাকে কোনও পাত্তাই দেয়নি। বিশেষ করে সিপিআই(এম) নেতারা তখন সারা ভারতের কংগ্রেস-বিরোধী সরণ ধরতেই পারেননি। ভোটাররাও কিন্তু তাঁদের ভোটে প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে অনিবার্য করে তুললেন। তা থেকে বামপন্থীরা, বিশেষ করে কমিউনিস্টরা, রাজনৈতিক শিক্ষা নিলেন না। রাজ্যপাল ধরমবীর ও কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের মূর্খতার সৌজন্যে ১৯৬৯-এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল অতি-নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। কিন্তু সিপিআই(এম) অজয় মুখার্জির বিরোধিতা বাড়াতে বাড়াতে এমন এক জায়গায় পৌঁছল, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। ফলে ’৭১-এর বিরোধী-হীন বিধানসভায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। এক দিকে সিপিআই(এম) ঘরছাড়া, পাড়া-ছাড়া, এলাকা-ছাড়া, জিলা-ছাড়া, সংগঠন-ছাড়া। অন্য দিকে সিপিআই, কংগ্রেস-তোষণ করতে করতে এমন প্রবাদের জন্ম দিল: ‘দিল্লি থেকে এল গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ পশ্চিমবঙ্গের আত্মঘাতী রাজনীতিতে আর একটি নতুন শব্দ তৈরি হল ‘কংশাল’ অর্থাৎ নকশালবেশী কংগ্রেসি। প্রমোদ দাশগুপ্ত আরও এক অতুলনীয় রাজনৈতিক সূত্র দিলেন, ‘পুলিশের গুলিতে কি নিরোধ লাগানো থাকে’ (যে নকশালরা মরে না)।
এগুলি বামপন্থী আন্দোলনের সর্বনাশের সূত্র। এ কথাগুলি মনে না রাখলে আবারও একই ভুল ঘটতে পারে।
এ কথাটাও স্মরণীয় যে, এই সিপিআই(এম)-ই ১৯৭৭-এর ভোটের আগে ‘বামফ্রন্ট’ তৈরি করার নেতৃত্ব দিয়েছিল। ’৭৭-এর ভোটে সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্ট, মন্ত্রিসভা বা সরকার তৈরির মতো অবস্থাতেই ছিল না। সিপিআই(এম)-সহ বামপন্থী পার্টিগুলির স্বাধীনতা-উত্তর কালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কীর্তি ‘বামফ্রন্ট’।
ইতিহাসে কোনও ‘যদি’র জায়গা নেই। কিন্তু পরবর্তী বিশ্লেষণে নিশ্চয়ই আছে। যদি দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টকে রক্ষা করা যেত, তা হলে হয়তো সত্তরের রক্তের বন্যা ঠেকানো যেত। তা হলে হয়তো তৃতীয় যুক্তফ্রন্টও তৈরি হত। তা হলে, হয়তো সেই যুক্তফ্রন্ট থেকেই বামফ্রন্টও অনিবার্য আকার পেত।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে, একটি সাংবিধানিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনগুলির মাধ্যমে তৈরি লোকসভা থেকে বিধানসভা থেকে পুরসভা থেকে তিন স্তরের পঞ্চায়েত পর্যন্ত একটি ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অংশত অধিকারেরও এক ও অদ্বিতীয় উপায় হয়, তা হলে রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে মেনে নিতেই হবে যে, তাঁদের কর্মসূচিকে অনিবার্য করে তোলাটাই তাঁদের রাজনৈতিক দায়। ভোটকে শ্রেণিযুদ্ধের রকমফের, বা বিরোধী পক্ষ শূন্য করে দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পশ্চিমবঙ্গে কোনও উন্নয়ন হওয়াও সম্ভব নয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতি হওয়াও সম্ভব নয়।
কিন্তু এখনকার অবস্থাটা কী, যে এমন সব কথা উঠে পড়েছে?
১) লোকসভা ভোটের পর রাজ্যে জেতা-পার্টি ও হারা-পার্টি, সব পার্টিই নিজেদের ভিতরের গোলমালে ছত্রখান হওয়ার মুখে। যে-জেতায় তৃণমূল কংগ্রেসের মাথা আকাশ ছোঁয়ার কথা, তৃণমূলের একমাত্র নেত্রী তেমন জয়ের পর বিজয় উৎসব নিষেধ করে দিলেন। ভোটের পর তৃণমূলের সব স্তরের নেতাদের বিশাল সমাবেশে কিছু সাংগঠনিক সংস্কার করলেন। সেই সংস্কারের বিরুদ্ধে দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থকরা পথ অবরোধ করলেন। শুভেন্দু অধিকারী জনসভায় বক্তৃতা করলেন যে, লোকসভা ভোটে তৃণমূল কয়েকটি বাছাই বিধানসভা আসনে অস্বাভাবিক মার্জিন তৈরি করে জিতেছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট। তাঁর আগে মলয় ঘটক ও পরে অর্জুন সিংহ তৃণমূলের উপপ্রধান নেতাদের মধ্যে বিপজ্জনক অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে দিয়েছেন। সে দ্বন্দ্বে কোনও কোনও সময় প্রশাসন ও পুলিশকেও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। অর্থাৎ, এমন অবাক করে দেওয়া জয়ের পর বিজয়ী এমপি-রা শপথ নেওয়ার আগেই জানা গেল, রাজনীতি আর পার্টির মধ্যে ঘটছে না, প্রশাসনের মধ্যেও ঘটছে, প্রশাসন আর প্রশাসনের মধ্যে থাকছে না, পার্টির মধ্যেও ঢুকছে। ভোটের জয় তৃণমূলকে শক্তি ও সংহতি দিল না, দিল অসংহতি ও আত্মকলহ।
২) ভোটে গো-হারা হারার পরেও কংগ্রেস বেশ আত্মসন্তুষ্ট মারামারিতে জড়িয়ে পড়ল প্রদেশ কংগ্রেস অফিসেই, নির্বাচনী তহবিল তছরুপের অভিযোগ নিয়ে। চার জন এমপিতেই কংগ্রেস খুব খুশি, আরও তো কমতে পারত! ভারতের কথা থাক, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেসের কোনও হাজিরাই নেই।
৩) বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম) ২৯ বা ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েও যে-হারা হেরেছে, তেমন হারের আসামির শাস্তির দাবিতে আলিমুদ্দিনে মিছিলও এল। ‘যৌথ নেতৃত্ব’, ‘পার্টি কংগ্রেস’, ‘রাজনীতির লাইন’ যে বৈশিষ্ট্যগুলি বামপন্থীদের প্রধানতম রক্ষাকবচ, সেগুলো কথার কথা হয়ে গেল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণও নেতৃত্ব বদলের কথা বললেন। তাঁরাও তো একসময় নেতা ছিলেন, তখন কী রকম সঠিক নেতৃত্ব দিতেন?
অর্থাৎ, প্রবল জয় ও নিঃসম্বল পরাজয় যে পার্টিগুলির ঘটেছে, তারা সবাই রাজ্যে ভোটের পর নয়ছয় হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির দিক থেকে দিকহারা। সম্ভবত আতঙ্কিতও। কেন্দ্রীয় সরকারে সংখ্যাধিক্যের খুঁটির জোরে রাজ্য বিজেপি, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ শনাক্তকরণ ও নির্বাসনের দাবিতে জন-আন্দোলন জমাবার চেষ্টা করতে পারে। সেই চেষ্টা প্রতিহত করাকে রাজনীতিগত যাঁরা প্রধান কর্তব্য মনে করেন, সেই পার্টিগুলি এই বিষয়ে একত্রিত হওয়ার একটা জায়গা তৈরি করতে পারে; বামফ্রন্ট, তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসও। এই বিষয়টিতে মতৈক্যের সম্ভাবনা ও স্বার্থ সব পার্টিরই প্রবল। তা হলে একটা আবছা ঐক্যবদ্ধতা তৈরি হতে পারে না?
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়িতে ৫ জুন একটা নতুন কার্যক্রমের কথা বলেছেন: পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য দিল্লির সরকারের কাছে এক সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল যাক।
যদ্দূর জানি, কেউ এখনও আপত্তি করেনি, সব পার্টিই আপাতত রাজি।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে এমন একটা কার্যক্রম কি খড়কুটোর কাজ করতে পারে? আত্মরক্ষার খড়কুটো?