ব্যর্থতার মুখ। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। ছবি: প্রেম সিংহ।
যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, পরিবেশের জন্য আপনি কী চান?
কথার দিন চলে গিয়েছে। ‘আমি খুব পরিবেশের কথা ভাবি’, এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। সবাই তো এই কথাই বলে। দরকার হল ভেঙে যাওয়া ব্যবস্থাটাকে নতুন করে গড়ে তোলা। নদীর দূষণ নিয়ে হাহুতাশ করলেই হবে না। সেই দূষণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন নগরপালিকার পরিবেশ নীতি ঠিক করতে হবে, যাতে নদীর জলে দূষণ না বাড়ে। এখানেই মুশকিল। কোনও দলই এই কঠিন কাজগুলোয় নামতে প্রস্তুত নয়। সবাই বড় বড় নীতি তৈরি করে। কিন্তু সেগুলির বাস্তবায়নের তাগিদ কারও নেই। পরিবেশের জন্য স্বচ্ছ নীতি তৈরি করতে হবে, যাতে সবাই বুঝতে পারে, কোনটা চাওয়া হচ্ছে আর কোনটা নয়। আমাদের এখানে ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা রীতিমত কড়া, কিন্তু তার পর নজরদারির প্রায় কোনও ব্যবস্থাই নেই। ফলে, এক বার ছাড়পত্র পাওয়ার পর কোনও প্রকল্প পরিবেশের কথা কতখানি ভাবছে, সেটা দেখা হয় না। এই ব্যবস্থা বদলানো দরকার। নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। কঠোর জরিমানা করার অধিকারও দিতে হবে।
আর যাই হোক, পরিবেশবান্ধব রাজনীতিক হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর সুনাম নেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে পরিবেশের প্রশ্নে ভারত ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
ভারত কিন্তু এখনও বিশেষ ভাল জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। নরেন্দ্র মোদী এলে সব কিছু আরও খারাপ হবে, এমন কথা ভাবার মতো অবস্থাই নেই এখন। এক জন প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের প্রশ্নে ব্যক্তিগত ভাবে যতই উদাসীন হোন, তিনি তো দেশের আইনের বাইরে যেতে পারবেন না। ভারতে পরিবেশের প্রশ্নে অনেকগুলো আইন আছে, অনেক রকম লক্ষ্মণরেখা আছে, যা অতিক্রম করা নরেন্দ্র মোদীর পক্ষেও সম্ভব হবে না বলেই মনে করি। তিনি পরিবেশের বিষয়টিকে অবহেলা করতে পারেন সে তো সব প্রধানমন্ত্রীই করেন কিন্তু পরিবেশ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা তাঁর পক্ষেও কঠিন হবে। এখানে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। আদালত আছে, আইন আছে, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আছে। তার বাইরেও স্থানীয় মানুষের চাপ আছে। সেগুলো যাতে ঠিক ভাবে কাজ করে, সেটা দেখতে হবে।
কিন্তু গুজরাতেই মোদীর শাসনকালে আদানির প্রকল্পে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়নি কি?
হয়েছে। আদানি প্রকল্পের ক্ষেত্রে যে পর্যবেক্ষক টিম তৈরি হয়েছিল, আমি নিজে তাতে ছিলাম। আদানি গোষ্ঠীকে ২০০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিলাম। কিন্তু, আদানি গোষ্ঠী যেটা করেছে, সেটা ততটাই খারাপ যতটা রায়গড়ের জিন্দালদের ইস্পাত কারখানা বা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। প্রশ্নটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার। গোটা দেশের প্রায় সব রাজ্যের সরকারই চেষ্টা করে, কী ভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত নজরদারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখা যায়। এবং, সেটা অনেক দূর অবধি হয়েছেও। কাজেই, নরেন্দ্র মোদীকে একা দায়ী করা মুশকিল। অনস্বীকার্য, তাঁর উন্নয়নের মডেলটি কর্পোরেটমুখী, সেখানে পরিবেশের জন্য জায়গা নেই। কিন্তু এটাও একই রকম অনস্বীকার্য যে আমরা না চাইলে তাঁর পক্ষেও গোটা দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মবিধি শিকেয় তুলে উন্নয়নের রথ চালানো সম্ভব হবে না। এখানেই আমি ইউপিএ-কে দায়ী করব। এই সরকার দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যবস্থার মেরুদণ্ডটা কার্যত ভেঙে দিয়ে গেছে।
পরিবেশের প্রশ্নে ইউপিএ সরকার সম্বন্ধে আপনি সম্ভবত খুব একটা ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না।
করার কোনও উপায় নেই। এই সরকারের কাছে আমাদের মস্ত প্রত্যাশা ছিল। আমি এখনও বলব, পরিবেশ নীতি বিষয়ে এতখানি যথাযথ মনোভাব নিয়ে কোনও সরকার আজ অবধি ক্ষমতায় আসেনি। এদের নীতি ঠিক ছিল, মানসিকতা ঠিক ছিল, কাজ করার ইচ্ছেও ছিল। প্রথম পাঁচ বছর যে খুব খারাপ কাজ হয়েছিল, তা-ও বলব না। কিন্তু তার পর সম্পূর্ণটা গুলিয়ে গেল। উন্নয়ন আর পরিবেশের মধ্যে যে ভারসাম্য বজায় রাখার কথা ছিল, সেটা উধাও হয়ে গেল। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেল, উন্নয়ন ভুলে শুধুই পরিবেশের প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছে। এবং, তাতে উন্নয়নের কতখানি ক্ষতি হয়েছে, সেই প্রশ্নটা এত বেশি গুরুত্ব পেল যে কাকে পরিবেশের প্রশ্নটির স্বার্থ লঙ্ঘিত হল। আর অন্য দিকে দেখা গেল, পরিবেশের প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ চুলোয় পাঠিয়ে শুধু উন্নয়নের অঙ্ক কষা হচ্ছে। এই যে জয়রাম রমেশকে নিয়ে এত কথা হয়, তিনি নাকি অনেক বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রকল্প পরিবেশের স্বার্থে আটকে দিয়েছেন আমি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারি, তাঁর আমলে যত প্রকল্প পরিবেশ-ছাড়পত্র পেয়েছে, সেটা আগে কখনও হয়নি। মোট দু’লক্ষ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতার তাপবিদ্যুত্ প্রকল্প ছাড়পত্র পেয়েছে। ভাবা যায়! অথচ, ইউপিএ-র কাছে মস্ত প্রত্যাশা ছিল, এরা পরিবেশ সংক্রান্ত নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তপোক্ত করবে, নজরদারি ব্যবস্থার জোর তৈরি করবে। এমন ভাবে, যাতে পরবর্তী কোনও প্রধানমন্ত্রী নিজে পরিবেশ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন হলেও সেই কাঠামোর বিরুদ্ধে যেতে না পারেন। আমি এখনও বলব, পরিবেশের প্রশ্নে আমি নরেন্দ্র মোদীকে যতখানি বিশ্বাস করতে পারি, তার চেয়ে ঢের বেশি বিশ্বাস করেছিলাম ইউপিএ-কে। কিন্তু সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছি।
কিন্তু, অন্য কারও ওপর আশা করার ও কোনও কারণ আছে কি? দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের কথাই ধরুন। অরবিন্দ কেজরীবাল বিদ্যুতের মাসুল অর্ধেক করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরিবেশের ওপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে, ভাবেননি। তাঁর দেখাদেখি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানাও একই কাজ করেছে।
এটাকে জনপ্রিয়তার রাজনীতি বললে ভুল হবে। এটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার রাজনীতি। দিল্লির ক’জন গরিবের বাড়িতে আইনি বিদ্যুত্ সংযোগ আছে? ক’জনের বাড়িতে জল আসে? কেজরীবাল মধ্যবিত্ত তোষণ করছিলেন, গরিবের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। অসম্ভব বিপজ্জনক খেলা। কিন্তু মজাটা হল, এই খেলায় বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। মাসুল কমালেই তো হল না, বিদ্যুত্ দিতেও তো হবে। সে খরচ জোগাবে কে? কেজরীবাল তিন মাসের বেশি সরকারে থাকলে বুঝতেন, এ ভাবে হয় না। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানাও বুঝবে। সবাইকে ভর্তুকি দেওয়া যায় না। এক জায়গা বা অন্য জায়গা থেকে টাকাটা আনতে হবে। কাজেই, এই রাজনীতি, বিপজ্জনক হলেও, পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।
সাক্ষাত্কার: অমিতাভ গুপ্ত।