পাল্টা আক্রমণ ছাড়া উপায় নেই মমতার

সারদা নিয়ে বিক্ষোভকে দিল্লি পর্যন্ত এনে সহানুভূতি চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।পশ্চিমবঙ্গকে এ ভাবে উত্তাল অনেক দিন পর দেখছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সে সময়ে নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পর গোটা রাজ্যজুড়ে এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছি। জ্যোতি বসুর আমলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জঙ্গি আন্দোলন দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক অসন্তোষকে মূলধন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতারূঢ় হওয়া কিন্তু এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনের সেই বাম আধিপত্যের অবসান ঘটানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভূতপূর্ব সাফল্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share:

পশ্চিমবঙ্গকে এ ভাবে উত্তাল অনেক দিন পর দেখছি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সে সময়ে নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পর গোটা রাজ্যজুড়ে এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছি। জ্যোতি বসুর আমলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জঙ্গি আন্দোলন দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক অসন্তোষকে মূলধন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতারূঢ় হওয়া কিন্তু এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনের সেই বাম আধিপত্যের অবসান ঘটানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভূতপূর্ব সাফল্য। তিল তিল করে তিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। অসাধ্যসাধন যাকে বলে। সুতির সস্তা শাড়ি পরিহিতা, পায়ে নীল হাওয়াই চটি এই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্র্যান্ড ইকুইটি। সততার মূর্ত প্রতীক। জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুর দুর্নীতি নিয়ে তখন মমতা সোচ্চার হয়েছিলেন। সে সব অভিযোগ আজও প্রমাণিত হয়নি। চন্দন বসুকে কখনও সিবিআই হেফাজতে থাকতে হয়নি, যদিও চন্দন বসুর দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছিল বিরোধীরা।

Advertisement

আজ মাত্র তিন বছরের মধ্যে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে বিরোধী দলগুলি। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর এই আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভৈরব গতিতে এগোতে চাইছেন। সারদা কেলেঙ্কারি আর সিবিআইয়ের তদন্ত এই দুর্দম বেগে এগোনোর এক অন্যতম হাতিয়ার। অন্য দিকে, বর্ধমানের বিস্ফোরণ নাশকতাও পশ্চিমবঙ্গকে তালিবানিকরণের প্রচেষ্টার মতো বিষয়কে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারছেন কংগ্রেস বা সিপিএম এখন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, বরং ধীরে ধীরে বিজেপি-ই প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

Advertisement

এ হল রাজনৈতিক পরিসর দখলের লড়াই। প্রশ্ন হচ্ছে, বিজেপি কি এ কাজে সত্যি সত্যিই সফল হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন যে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইছেন, সেটা হল কেন্দ্র বিরোধী ভিকটিম স্ট্যাটাস পাওয়ার রাজনীতি। অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হচ্ছে। আগে সিবিআইকে বিজেপি বিরোধী দল হিসেবে বলত, ‘কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’। আর এখন বিজেপি-ও সেই একই ভাবে সিবিআইকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে। এ হল খোদ মমতার অভিযোগ। সিআইডি তদন্তের ফলে কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু সিবিআই তদন্তের ভিত্তিতে মদন মিত্রর বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি মমতা। কারণ একটাই, আক্রমণই হল আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। এখন সিবিআইকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে দলীয় মন্ত্রীকে বিতাড়নের রাজনৈতিক পরিণাম কী হবে সেটাও তো বুঝতে হবে। মদনকে তাড়ালে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যেতে পারে। আর অনেক তৃণমূল নেতাকে সিবিআই গ্রেফতার করতে পারে। তার চেয়ে সারদা ও সিবিআই নিয়ে বিক্ষোভকে দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে এসে মমতা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ‘আহা রে মমতা!’ এই সহানুভূতি পেতে চাইছেন।

এই সহানুভূতি কি সত্য সত্যই মমতা পেতে পারেন? কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জেলায় জেলায় যে নিম্নবর্গের জনবিন্যাস, তা একদা ছিল সিপিএমের কুক্ষিগত ভোটব্যাঙ্ক। এখন সেই রাজনৈতিক পরিসর দখল করেছে তৃণমূল। এ বার তৃণমূলের এই নিম্নবর্গের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে কি ফাটল ধরবে?

সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে ভারতের অন্যত্র জাতি আর শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে বহু বিতর্ক হয়েছে। এ রাজ্যের বিশেষজ্ঞরা অনেকেই তার খোঁজ রাখেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন যে এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাকি ভারত থেকে আলাদা। এখানে জাতের ভিত্তিতে সংগঠিত আন্দোলন নেই তাই জাতি বৈষম্য পশ্চিমবঙ্গে কোনও সমস্যা নয়। কিন্তু পার্থবাবুই দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এখনও নিম্নজাতির মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ আর কলকাতার হিন্দুদের দুই-তৃতীয়াংশ উচ্চবর্ণ। মমতা নিজে বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও তৃণমূল কংগ্রেস এই উচ্চবর্ণের সামাজিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। একই ভাবে প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যেও আছে এক বিপুল অনভিজাত সমাজ। এ আর দেশাই ভারতের সমাজতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘রুরালাইজেশন অফ এলিটিজম’ (Ruralisation of Elit-ism) বলে একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। কামার-কৈবর্ত্য-দলিত শ্রেণি পশ্চিমবঙ্গে আছে বিপুল ভাবে। এরা আজও মমতার সমর্থক।

বৈষ্ণব ধর্মের আধিপত্য পশ্চিমবঙ্গে দলিত ‘আইডেন্টিটি’কে রাজনৈতিক ভাবে বাড়তে দেয়নি। উচ্চবর্ণের মানুষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কারণে বৈষ্ণব ধর্মের পরিসরে নিম্নবর্গকেও সঙ্গে রেখেছিল। লালু বা মুলায়ম উত্তপ্রদেশ ও বিহারে দীর্ঘ দিন এই জাতপাতের রাজনীতি করে নিজের দুর্গ সুরক্ষিত রেখেছেন। হাওলা কেলেঙ্কারির পরেও লালু কিন্তু নির্বাচনে পরাস্ত হননি, হননি মায়াবতীও।

তা হলে চুরির প্রচার কি মমতার ক্ষেত্রেও গোটা রাজ্যের প্রচারের বিষয় নয়? প্রশ্নটা পশ্চিমবঙ্গের ভাল-খারাপের নয়। এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। কিন্তু ২০১৬ সালের ভোটে একক ভাবে বিজেপি ক্ষমতায় আসীন হবে এটা আজও ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement