ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনের প্রত্যাশিত ফলই মিলিয়াছে। বিজেপির সরকার ক্ষমতাসীন হইতে চলিয়াছে। সাত মাস আগে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যের ১৪টি আসনের মধ্যে ১২টিই বিজেপির দখলে যায়। ইতিমধ্যে এমন কিছু ঘটে নাই, যাহাতে বিজেপির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়িতে পারে। নির্বাচনী ফলাফলের মধ্যে তাই কোনও চমক নাই। তবে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সরকার ও তাহার মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন-তনয় হেমন্ত সোরেনের হাত হইতে রাজ্যপাট চলিয়া যাওয়ার অর্থ, জনজাতীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডে জনজাতির নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠনের আধিপত্য আর রহিল না। ইহা ভবিষ্যতের পক্ষে তাত্পর্যপূর্ণ।
সত্য যে, ছত্তীসগঢ় ও উত্তরাখণ্ডের মতো ঝাড়খণ্ডেও জনজাতীয় আত্মশাসনের দাবিকে শিরোধার্য করিয়া পৃথক রাজ্য গড়ার ভগীরথ হিসাবে বিজেপিই কৃতিত্বের দাবিদার। দাবিটি বহু কাল যাবত্ উত্থাপিত হইলেও এবং সেই দাবিতে আন্দোলনও যথেষ্ট দীর্ঘকালীন হইলেও কংগ্রেস জনজাতীয় স্বাধিকারের দাবিটি মানিয়া লয় নাই। তাই প্রথমাবধি জাতীয় দলগুলির মধ্যে বিজেপি এই রাজ্যগুলির জনজাতির কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য থাকিয়াছে। ঝাড়খণ্ডে জনজাতির নিজস্ব সংগঠন এক কালে যথেষ্ট জনপ্রিয় হইলেও সেই সব সংগঠনের জনজাতীয় নেতাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি, পারিবারিক স্বজনপোষণ এবং স্বজাতির সহিত আচরণে ঔদ্ধত্য ক্রমশ সংগঠনগুলির গণভিত্তি দুর্বল করিতে থাকে। তবু তাহারই মধ্যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা জনজাতির মধ্যে আপন প্রভাব কিছুটা ধরিয়া রাখিতে সমর্থ হয়। এ বারের নির্বাচনে মুক্তি মোর্চার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইলেও শিবু সোরেন-হেমন্ত সোরেনের দল যে দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে, তাহাতে বুঝা যায়, জনজাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এই সংগঠন ও তাহার নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনও লুপ্ত হয় নাই, দুর্নীতি এখনও সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে সম্পূর্ণ হরণ করিতে পারে নাই। তবে দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দলের মতো জনজাতীয় রাজ্যগুলির মানুষও বুঝিয়াছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কোনও না কোনও জাতীয় দলের সহিত রাজনৈতিক জোট রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থেই জরুরি। আর সেখানেই জাতীয় দল হিসাবে অতীতে যেখানে কংগ্রেসকেই বুঝাইত, সেই স্থানটি দখল করিয়া লইয়াছে বিজেপি। তাই প্রদেশের উন্নয়নের স্বার্থেই বিজেপির ঝুলি ভরিয়া দিয়াছেন ঝাড়খণ্ডের ভোটদাতারা।
বিজেপি যে সুশাসনের স্লোগান দিয়া ক্ষমতাসীন হইতে চলিয়াছে, তাহা কার্যকর করাই অতঃপর রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের কাজ হইবে। তাহার পরিবর্তে যদি সংঘ পরিবারের সংগঠনগুলি জনজাতির মধ্যে হিন্দুত্ব বেচিতে তত্পর হইয়া পড়ে, তবে ভবিষ্যতে তাহার পরিণাম ভাল হইবে না। এমনিতেই জনজাতি ও প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীগুলির আর্যীকরণ তথা সংস্কৃতায়নের সামাজিক প্রক্রিয়া ফল্গু স্রোতের ন্যায় সতত বহমান। অতঃপর যদি ‘ঘর-ওয়াপসি’ নামের পাল্টা ধর্মান্তর ঘটাইয়া খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনজাতিগুলিকে হিন্দুত্বে ফিরাইবার যাগযজ্ঞ শুরু হইয়া যায়, তবে জনাদেশ ভবিষ্যতে বিপরীত হাওয়ায় গা ভাসাইতে পারে। বিজেপির রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাই সুশাসন, অনগ্রসর রাজ্যটির যথার্থ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পরিকাঠামোর বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের বন্দোবস্তের দিকে মনোনিবেশ করিতে হইবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়াই কিন্তু বিজেপি জনাদেশ চাহিয়াছিল।