প্রবন্ধ ১

পেরুমল মুরুগান কেন ‘আত্মঘাতী’

মুরুগান চেয়েছিলেন সমাজের বহুত্বকে সম্মান করতে, তাকে বুঝতে। অতএব তাঁর উপর নেমে আসে বিরাট বিকট গোঁড়া মৌলবাদী দাপট। চেতনার এই আধিপত্যবাদকে প্রতিহত করার দায় ভারতীয় সাহিত্যের পাঠককুলকেই নিতে হবে।লেখক পেরুমল মুরুগান মৃত। পুনর্জন্মে তাঁর বিশ্বাস নেই। এক সাধারণ শিক্ষক, পি মুরুগান নামেই তিনি বেঁচে থাকবেন এ বার থেকে। তাঁকে একা ছেড়ে দিন।’— এ কথা নিজ ফেসবুকে লিখলেন লেখক স্বয়ং। মুরুগান তামিল ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক লেখক, যিনি ইতিমধ্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন।

Advertisement

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

লেখক পেরুমল মুরুগান মৃত। পুনর্জন্মে তাঁর বিশ্বাস নেই। এক সাধারণ শিক্ষক, পি মুরুগান নামেই তিনি বেঁচে থাকবেন এ বার থেকে। তাঁকে একা ছেড়ে দিন।’— এ কথা নিজ ফেসবুকে লিখলেন লেখক স্বয়ং। মুরুগান তামিল ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক লেখক, যিনি ইতিমধ্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন। গত ২৬ ডিসেম্বরে তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘মাধোরুবাগান’ (অর্ধেক রমণী) নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছিল তাঁর শহর থিরুচেঙ্গুড়ুর স্থানীয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও আঞ্চলিক দলিত সম্প্রদায়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বদলে লেখককে নিজ বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দেয় পুলিশ। আঠারো দিন টানা বিক্ষোভে বন্ধ থাকে মুরুগানের নিজের শহর এই অভিযোগে যে, ওখানকার দলিত গোষ্ঠীর একটি ন্যক্কারজনক উপস্থাপনা হয়েছে ওই উপন্যাসে, এবং তার ফলে হিন্দু রমণীর সম্মানহানি হয়েছে। অর্থাত্‌ একসঙ্গে আঘাত লেগেছে দলিতত্বে ও হিন্দুত্বে। তার ফলে, সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারা মোতাবেক ব্যক্তির মতপ্রকাশের যে অধিকার আছে, প্রশাসনের আছে সেই অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায়, দায়িত্ব নেওয়ার আছে লেখক ও তাঁর পাশে থাকা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে সুরক্ষা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা— এ সব কার্যক্ষেত্রে দূর অস্ত্। সেটাই হয়, কেননা দেশটা ভারতবর্ষ। প্রশাসনের পক্ষে এক শুল্ক আধিকারিকের দায়িত্বে বিক্ষোভকারী ও মুরুগানের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়, সেখানে গোষ্ঠী ভাবাবেগে অনিচ্ছাকৃত আঘাত লাগার জেরে লেখককে দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইয়ে মুচলেকা নিয়ে নেওয়া হয়।

Advertisement

যখন জঙ্গি আক্রমণে মৃত সহকর্মীদের রক্ত মুছে শার্লি এবদো দফতর খুলে ফের কার্টুন ছাপাল, তখন তা কথা বলার স্বাধীনতাকে পুনর্জন্ম দিল। তেমন কোনও সম্ভাবনা না দেখতে পেয়ে লেখক মুরুগান এ ভাবে ‘আত্মঘাতী’ হলেন। এই অভিব্যক্তিকে আমরা যেন শুধু শিল্পীর নাজুক অভিমান বলে ভুল না করি, ধরে না নিই যে, মুরুগান আর কোনও দিনও কলম ধরবেন না, ক্ষতিপূরণ দিয়ে সব প্রকাশকের থেকে সব বই তুলে নেবেন, এমন ঘোষণা করলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সরকারি চাকুরে, ওই গঞ্জেই মুরুগানের জন্মকর্ম, বেড়ে ওঠা। ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁর পক্ষে শুধু এ কারণেই নির্বাসন নিয়ে গুপ্ত বাসস্থানে চলে গিয়ে আরব্ধ কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাঁর কাজ ওই অঞ্চল নিয়েই। আর তাই অন্যত্র বাঁচতে গেলে বা সেখানেই থেকে অন্য কিছু নিয়ে লিখতে হলে, জীবন মৃত্যুবত্‌ই।

পেরুমল মুরুগান গত ১৭ বছর ধরে সরকারি আর্ট কলেজে তামিল পড়ান। অনেক ধ্রুপদী তামিল গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন। যে অঞ্চলের কথা বলছি— কোঙ্গুনাড়ু— মুরুগান সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাবিশেষজ্ঞ, সে ভাষার অভিধান রচয়িতা। থিরুচেঙ্গুড়ু এলাকায় পূজিত দেবদেবীদের নিয়ে নানা কাল্ট, রিচ্যুয়াল, লোককথা, লোকগাথা, উপকথা সংগ্রহ করে ওই অঞ্চলটির না-চর্চিত না-কথিত না-গ্রন্থিত একটি সমান্তরাল সামাজিক ইতিহাস নির্মাণের কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই অঞ্চলে কিছু মানুষ কেন নিজেদের ‘স্বামী কোদুথা পিল্লাই’ বা ঈশ্বরপ্রদত্ত সন্তান বলেন, তার নৃতাত্ত্বিক কারণ খুঁজতে গিয়ে মুরুগান দেখেন, তা এসেছে একটি রিচ্যুয়াল থেকে। এই মানুষগুলির কারও বয়সই পঞ্চাশের কম নয়, এবং তারা যে প্রথার সঙ্গেই যুক্ত, তা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্ধনারীশ্বর শিবের বার্ষিক পূজার রথযাত্রা উত্‌সবে, এলাকার সন্তানহীন রমণীরা ওই কার্নিভালে যোগ দিতেন এবং পছন্দমত পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতেন, যে সব পুরুষকে আবার ওই একটি দিনের জন্য ঈশ্বরের অবতার বলা হত। এই মিলনের সন্তানরাই ঈশ্বরপ্রদত্ত হিসেবে পরিবারে ও সমাজে মান্যতা পেত। মুরুগানের উপন্যাস এই রিচ্যুয়ালের ওপর ভিত্তি করেই। বিষয়টা ব্যক্তি-অভিপ্রায় ও গোষ্ঠীচেতনার দ্বন্দ্ব। ওই স্বাধীনতার পর পর যে সময়টা, তখনও এই রিচ্যুয়াল চলছে যেমন চলার কথা আঞ্চলিক গোষ্ঠীর জীবনে। কালী ও পোন্না বিয়ের বারো বছর পরেও সন্তানহীন, অথচ তারা এটা নিয়ে হাহাকার করার বদলে পরস্পরের প্রতি খুবই নিবেদিত। কিন্তু, পিসিশাশুড়ি, তালুইমশায় আর সমাজ তাবিচ কবজ জলপড়া ঝাড়ফুঁক কিছু করতে বাকি রাখে না। শেষে পোন্নাকে ধরে বেঁধেই পাঠানো হয় ওই রথের মেলায়, গর্ভাধান করতে। ঈর্ষা দ্বন্দ্ব ব্যক্তি-আশংকায় শেষ হয়ে যায় দম্পতির প্রেম।

Advertisement

ভাবাবেগে আঘাত দোরোখা। এক, হিন্দু রমণীকে এ ভাবে অসতী কুলটা হিসেবে দেখানো হল যে, তারা বিয়ের বাইরে পুরুষসঙ্গ করেছে— প্রশ্ন হিন্দুত্বের। আর দুই, আমাদের দলিত গোষ্ঠীর নারীকে এ ভাবে দেখানো মানে আমাদের গায়ে রক্ত বইছে ব্যভিচারের রক্ত— প্রশ্নটা দলিত আত্মচিহ্নের। লক্ষ করুন, মুরুগানের এই কাজ ছোট ছোট বই হিসেবে প্রকাশ পেত যদি, ফোকলোর সিরিজে, কারও কোনও মাথাব্যথা থাকত না, কে-ই বা পড়ে ওই সব। আর তা ছাড়া সেগুলি একটা বদ্ধ অতীতের বর্ণনার মতো, তাতে মানুষ নিজেকে যোগ করে না, মানে তা দিয়ে নিজের দিকে তাকায় না। উপন্যাস মানে তো অধিক প্রসারণ। অর্থেরও। সাহিত্যই কথন ও জীবনকে ইতিহাসের সঙ্গে যোগ করার দাবি নিয়ে আসে, বাধ্য করে একটা সমাজের বাঁধা গতের মধ্যবিত্তপনার বাইরের যে বহুত্ব, প্রতিটি সমাজের, বা গোষ্ঠীর, সেই সব নানা ধরনের বেঁচে থাকা, বিশ্বাস, আচার, নানা মতাদর্শ, সব মিলিয়ে একটা বহুস্বরবাদী ভারতের চেহারা তুলে ধরতে। সেই প্রক্রিয়ায় নিজের অস্তিত্বকে চলমান ইতিহাসের ফল হিসেবে দেখা যায়, ভারতীয় হিন্দু বা অন্য কোনও স্থিত নির্দেশিত আত্মপরিচয়ের যে সংকীর্ণতা, তার বাইরে নিয়ে যায়। আমরা যে কোনও প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্যে সেই ব্যাপক ও অফুরান বেঁচে থাকার হদিশগুলি পাই। ফোকলোর বর্ণনা করে, কিন্তু সাহিত্য সমাজের ডাইনামিজমকে দেখায়, যাতে সর্বদা থাকে নিজের বেঁচে থাকার দিকে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নও, এই উপন্যাসটি যেমন।

আমাদের তো সেই সন্ধানই করার কথা যে, হ্যাঁ, প্রাক-আধুনিক অনেক সমাজেই ছিল নানাবিধ যৌন আচার ও সামাজিক মতাদর্শ, যার রিচ্যুয়াল মর্যাদা ছিল। নিয়োগ প্রথার রিচ্যুয়াল মর্যাদাবলেই তো বহুপুরুষগামী কুন্তী পঞ্চসতীর অন্যতমা। কিন্তু মুশকিল হল, আর্য ও নানা অনার্য লোকজ সমাজের যৌন আচার খুব একটা আলাদা ছিল না কিছু এ প্রশ্ন তোলা গেলে তো ভারী বিপদ: আর্য ভারতকে রক্ষা করার জন্য ভারতীয় নারীর সতীত্ব নিয়ে এত যে মহত্তর আয়োজন, সেটা অমনি ধসে পড়বে না? রিচ্যুয়াল যৌনতাকে আমাদের বলে স্বীকার করে নিতেই এখন এত অসুবিধে, যে সব যৌন অভ্যাসের রিচ্যুয়াল মর্যাদা ছিল না, তাদের কথা না তোলাই ভাল। অতএব, কোথায় এই সন্ধান করব যে, ঈশ্বরপ্রদত্ত কন্যাগুলির কী হল, তা না করে প্রতিটি সমাজের বিবর্তনের নানাবিধ পদ্ধতি নানা গতিকে মেপে ছেঁটে একই হিন্দুত্ববাদী উচ্চবর্ণীয় মধ্যবিত্তের নারী ও যৌনতা বিষয়ক মূল্যবোধে এঁটে ফেলার ভয়াবহ চেষ্টা। আর দলিত, সে-ও তো এতাবত্‌ কালের অসম্মান পেরিয়ে যেতে নিজ ভিন্ন অতীত ঘসে মুছে ফেলতে চায়, তা হলে, ভিন্ন গতিকে জায়গা না দিলে তবেই এই জাতীয় উচ্চবর্ণীয় যাত্রায় সে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে।

লক্ষণীয়, গোলযোগটি শুরু হল গত বছর উপন্যাসটির ইংরিজি অনুবাদ প্রকাশের পরে, ২০১০ সালে মূলটি প্রকাশের চার বছর পরে। যখন ভারতীয় সাহিত্য ইংরিজিতে ছাপা হয়ে তৈরি করছে বিরাট একটা পাঠকবলয়, যাতে ভেঙে পড়ছে অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে অনতিক্রম্য দূরত্ব; প্রদেশ, অঞ্চল ও গোষ্ঠীকে বোঝার বাঁধা পুরানো জাতীয়তাবাদী গত্‌ ভেঙে তৈরি হচ্ছে অন্য ও অপর ইতিহাসচেতনা, তখন সেই ইতিহাসচেতনা যাদের আঘাত করছে সেই বিরাট বিকট গোঁড়া মৌলবাদী চেতনাকে প্রতিহত করার দায় এই ভারতীয় সাহিত্যের পাঠককুলকেই নিতে হবে।

আমরা জানি, কে কখন কোন ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারবে, তা-ও আজ রচে তোলা একটা ক্রিয়া। শার্লি এবদোর মতোই আরও অনেক কিছু দাবি করে আমাদের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদী মনোযোগ। আমরা জানি, তামিলনাড়ুর মিডিয়া মুরুগানের ওপর এই মৌলবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছে, তাঁর প্রকাশকরা একবাক্যে তাঁর পাশে, রয়েছে নানা স্তরের বিপুল বুদ্ধিজীবী সমাজ। কিন্তু প্রশাসনের মাথায় থেকে গেছেই বিপুল দলিত ভোটব্যাঙ্ক, তাই ভাবাবেগে আঘাত করা এই কথাটা আমাদের দেশে একটা ভোটাভুটির ও ক্ষমতার অলিন্দে গেঁড়ে বসা সুবিধেবাদ হয়ে থেকে যায়, কখনও তার রাজনৈতিক মাত্রায় আলোচিত হয় না।

শেষাবধি তাই এঁটে ওঠা যায় না ভাবাবেগকে। মৌলবাদী ধর্ম দিয়ে তৈরি হওয়া ভাবাবেগ যখন বর্ণজাতপাতের ভাবাবেগের সঙ্গে একযাত্রার শরিক, তখন তৈরি হয় এক অতি-মঞ্জুল হ্যান্ডশেক। আমরা প্রস্তুত তো?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement