সম্পাদকীয় ১

পুরাতন নীতি

নরেন্দ্র মোদী ভারত হইতে আক্ষরিক অর্থেই যোজনা কমিশনের নাম মুছিয়া দিয়াছেন। নূতন বত্‌সরে নূতন নাম পাওয়া গেল। নীতি আয়োগ। কিন্তু, যোজনা কমিশনকে যে নামেই ডাকা হউক, তাহার শ্বেতহস্তীসুলভ চরিত্রটি দুরপনেয়। নীতি আয়োগেও সেই চরিত্র বিলক্ষণ বর্তমান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

নরেন্দ্র মোদী ভারত হইতে আক্ষরিক অর্থেই যোজনা কমিশনের নাম মুছিয়া দিয়াছেন। নূতন বত্‌সরে নূতন নাম পাওয়া গেল। নীতি আয়োগ। কিন্তু, যোজনা কমিশনকে যে নামেই ডাকা হউক, তাহার শ্বেতহস্তীসুলভ চরিত্রটি দুরপনেয়। নীতি আয়োগেও সেই চরিত্র বিলক্ষণ বর্তমান। তবে, এই নূতন উদ্যোগটি কেন্দ্র-রাজ সম্পর্কের রাজনীতির ক্ষেত্রে খানিক ইতিবাচক ভূমিকা লইতে পারে। প্রশাসনিক দৃষ্টিতে তাহা নগণ্য নহে। তবে, লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের ভাষণের প্রাবল্যের সহিত এই প্রাপ্তি তুলনীয় নহে। অনুমান করা চলে, মোদী নেহরু-যুগের নীতির পথ ত্যাগ করিয়া নূতন রাস্তার সন্ধানে ছিলেন। তাঁহারই কথার সুর ধরিয়া বলা চলে, সেই পথ প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার। নূতন বত্‌সরে নূতন নাম মিলিল, কিন্তু তাহাতে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার আদর্শের দিকে অগ্রসর হওয়া গেল না। প্রধানমন্ত্রীই সেই পথ মারিয়া রাখিলেন। নীতি আয়োগে প্রতিটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঠাঁই পাইলেন, কিন্তু তাঁহাদের হাতে কোনও আর্থিক ক্ষমতা থাকিল না। তাঁহারা শুধু পথনির্দেশ করিবেন। সেই পথে হাঁটিবার টাকার জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের দ্বারস্থ হইতে হইবে। নেহরু যুগের ভূতটি কিঞ্চিত্‌ বেয়াড়া রকম, শাসকদের স্কন্ধ হইতে সহজে নামিবার নাম করে না, এমনকী শাসক সচেতন ভাবে নামাইতে চাহিলেও নহে।

Advertisement

নামমাহাত্ম্য সর্বশক্তিমান। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের নামে যেহেতু কেন্দ্র এবং অর্থ, উভয়ের অচলা অবস্থান, অতএব নামমাহাত্ম্যে তাহা দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবেই বিবেচিত হইয়া থাকে। ইহা ভিন্ন এই মন্ত্রকের হাতে নূতনতর আর্থিক ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়ার কোনও কারণ নাই। সিদ্ধান্তটি প্রকৃতার্থে রাজ্যগুলিকে ক্ষমতাহীন করিয়া কেন্দ্রের হাতেই যাবতীয় আর্থিক ক্ষমতা রাখিয়া দেওয়ার চেষ্টা। এত দিন সরকার পিছনের দরজা দিয়া যোজনা কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করিত। বর্তমান ব্যবস্থায় সেই আব্রুটিরও আর প্রয়োজন থাকিবে না। রাজ্যগুলির মধ্যে টাকা বাঁটিতে হইলে অর্থ কমিশন আছে। নীতি নিয়োগ গঠনের বা অর্থ মন্ত্রককে অনর্থক আরও ক্ষমতাবান করিবার পরিবর্তে এই কমিশনটিকেই স্থায়ী এবং সম্পূর্ণ স্বনিয়ন্ত্রিত করিয়া তোলা বিধেয় ছিল। সেখানেই রাজ্যগুলির প্রতিনিধি থাকিত। প্রক্রিয়াটিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নাই। বস্তুত, হস্তক্ষেপের সুযোগ বাঁচাইয়া রাখা আসলে নেহরু জমানার কেন্দ্রিকতার নীতিরই সম্প্রসারণ।

কোনও একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হইতে রাজ্যগুলির মধ্যে টাকা বাঁটিয়া দেওয়ার নীতিটিই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধর্মের বিরোধী। কেন্দ্র কোন অধিকারে করের সিংহভাগ আদায় করিয়া ফের তাহা রাজ্যগুলির মধ্যে বণ্টন করে? প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার যুক্তি বলিবে, আমদানি শুল্কের ন্যায় হাতে গোনা কয়েকটি কর বাদে আর সব কর আদায়ের অধিকার রাজ্যের হাতে থাকা বিধেয়। প্রয়োজনে রাজ্যগুলি কেন্দ্রকে অর্থ সাহায্য করিবে। নিজের রাজকোষের দায়িত্ব রাজ্যগুলির থাকিবে। যে রাজ্য পারিবে, তাহা অগ্রসর হইবে। যাহারা পারিবে না, তাহাদের দুর্ভাগ্য। প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের অসমতা খণ্ডনের যুক্তিটি ব্যবহার না করাই ভাল, কারণ সেই নীতি ব্যবহারের সত্তর বত্‌সরে দেখা গেল, ঝাড়খণ্ড বা ছত্তীসগঢ়ের ন্যায় সমৃদ্ধ অঞ্চল উন্নয়নের সিঁড়িতে সবার পিছনে পড়িয়া আছে। বণ্টনের সমতাবিধানের নীতিটি বিপরীত ফলদায়ী। যে রাজ্যগুলির প্রাকৃতিক সম্পদ নাই, তাহাদের শিখিতে হইবে, কী ভাবে নিজেদের তুলনামূলক সুবিধা ব্যবহার করিয়া উন্নয়নের দৌড়ে শামিল হইতে হয়। গুজরাত বা কেরলের ন্যায় রাজ্যগুলি তাহা বিলক্ষণ জানে। এই বার অন্যদের শিখিবার পালা। তবে, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার এই পথে নরেন্দ্র মোদী হাঁটিবেন কি না, সংশয় আছে। পণ্য ও পরিষেবা কর লইয়া তত্‌পরতাই হউক অথবা বর্তমান নীতি আয়োগ, তাঁহার নীতিগুলি কিন্তু নেহরু-ঘরানার কেন্দ্রিকতার দোষ হইতে মুক্ত হইতে পারে নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement