প্রবন্ধ ২

পৃথিবীর সংঘাত অন্তত এখনও মহাকাশে পৌঁছয়নি

২০১৪’য় মহাকাশেও বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর মানুষই ঘটিয়েছে। মারামারি, হানাহানি নয়, অন্য রকম ঘটনা।২০১৪ শেষ সূর্যাস্তের প্রতীক্ষায়। বছরটা ভাল কাটল, বলা শক্ত। নাইজিরিয়া, গাজা, ইউক্রেন, তাইল্যান্ড, পাকিস্তান... পৃথিবী জুড়ে মারামারি, হানাহানি, চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা। শেষ প্রহরে মালয়েশিয়ার বিমান আবারও হারিয়ে গেল। বছরের শুরু থেকে শেষ, বেশির ভাগ ঘটনাই দুর্ঘটনা। আমার কর্মজগৎ যেহেতু মহাকাশ, তাই বিপরীত একটা ছবি আমার চোখের সামনেই থাকে।

Advertisement

অমিতাভ ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

অন্য গ্রহ। শিল্পীর চোখে মঙ্গল এবং মঙ্গলযান।

২০১৪ শেষ সূর্যাস্তের প্রতীক্ষায়। বছরটা ভাল কাটল, বলা শক্ত। নাইজিরিয়া, গাজা, ইউক্রেন, তাইল্যান্ড, পাকিস্তান... পৃথিবী জুড়ে মারামারি, হানাহানি, চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা। শেষ প্রহরে মালয়েশিয়ার বিমান আবারও হারিয়ে গেল। বছরের শুরু থেকে শেষ, বেশির ভাগ ঘটনাই দুর্ঘটনা।

Advertisement

আমার কর্মজগৎ যেহেতু মহাকাশ, তাই বিপরীত একটা ছবি আমার চোখের সামনেই থাকে। সেখানেও ২০১৪’য় বেশ কয়েকটা বড় ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর মানুষই ঘটিয়েছে। মারামারি, হানাহানি নয়, অন্য রকম ঘটনা। কয়েকটার কথা বলি।

গত ২৭ জুলাই নাসা-র ‘মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার’ প্রকল্পের মঙ্গলযান ‘অপারচুনিটি’ রোভার পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে বা উপগ্রহে চলমান যে কোনও যানের চেয়ে বেশি দূরত্বে পাড়ি দিল। কথাটার মানে ঠিক কী? কোন রেকর্ড ভাঙল অপারচুনিটি? ১৯৭৩ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি রোভার চাঁদের মাটিতে ২৪.২ মাইল চলেছিল। অপারচুনিটি ২৭ জুলাই মঙ্গলের মাটিতে ২৫.০১ মাইল পথ চলে সেই রেকর্ড ভেঙেছে। পৃথিবীর যে ক’জন রিমোট কন্ট্রোলে মঙ্গলগ্রহে অপারচুনিটিকে চালাচ্ছেন, ঘটনাচক্রে আমি সেই গোষ্ঠীর সদস্য। যে যন্ত্রের মঙ্গলগ্রহে কাজ করার কথা ছিল ৯০ দিন, আজ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে আমরা চালনা করছি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, পৃথিবীতে আমার একটানা দু’দিনের বেশি গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। মঙ্গলের সূর্যালোক, বাতাস, তেজস্ক্রিয়তা, ধুলোর ঝড়, সব সামলে অপারচুনিটি কাজ করে চলেছে। আমরা গর্বিত।

Advertisement

২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর নাসা পাঠিয়েছিল মার্স অ্যাটমস্ফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল ইভলিউশন (মাভেন) নামক মহাকাশযান, এ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সেটি মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে। মাভেন কী কাজ করছে? মঙ্গলে এক সময় প্রচুর জল ছিল, সেটা এখন প্রমাণিত। এই জলরাশিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বায়ুমণ্ডল। বায়ুস্তর বজায় রাখে গ্রহের প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা। কোটি কোটি বছর আগে কোনও এক রহস্যময় কারণে হারিয়ে যায় মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল। মাভেন জানার চেষ্টা করবে, কী ভাবে তা হারাল।

ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র মঙ্গলযান যাত্রা শুরু করে ২০১৩-র ৫ নভেম্বর। দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি এই যান নিয়ে গেছে ১৫ কেজি পে-লোড। এটি মঙ্গলের পরিমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের খোঁজ করবে, সেই গ্রহের ভূসংস্থান দেখবে এবং মঙ্গলের দুই উপগ্রহ ফোবস ও ডিমস-এর বিবরণ দেবে। মঙ্গলযান তার কর্মসূচি পালনে সক্ষম হলে গোটা বিশ্ব উপকৃত হবে, সক্ষম না হলেও কেবল প্রথম প্রচেষ্টায় সাফল্যের জন্যই এই অভিযান ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

এ বার একটু অন্য ধরনের সাফল্যের কথা বলি। ইউরোপের কুড়িটি দেশের সম্মিলিত উদ্যোগে চালিত ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইসা-র গায়া স্পেস অবজার্ভেটরি কাজ শুরু করে গত ২৫ জুলাই। পাঁচ বছরে একশো কোটি তারাকে সত্তর বার পর্যবেক্ষণ করে তাদের পরিবর্তন দেখাই তার কাজ। ইসার এই পর্যবেক্ষক মহাকাশযানটি দু’মাসের মধ্যেই প্রথম সুপারনোভা দেখতে পায়। সুপারনোভা হল সূর্যের থেকে সাধারণত অনেক বড় একটি তারার নিভে যাওয়ার আগে দারুণ ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে ওঠা। গায়া-র দেখা সুপারনোভাটি পৃথিবী থেকে পঞ্চাশ কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্যালাক্সিতে।

ইসা-র আর এক উদ্যোগ রোসেটা। ২০০৪ সালে এই ফ্লাই-বাই মহাকাশযানটি পাঠানো হয় বহু দূরের এক চলন্ত ধূমকেতুতে একটি ‘ল্যান্ডার’ স্থাপনের লক্ষ্যে। আজও পৃথিবীতে এমন শক্তিশালী কোনও রকেট নেই, যা এই বিশাল মহাকাশযানটিকে সরাসরি ধূমকেতুতে পাঠাতে পারে, তাই পৃথিবী, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহের পাশ দিয়ে গিয়ে রোসেটা তার নিজের গতি অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে— গ্রহের অভিকর্ষ মহাকাশযানকে দ্রুততর গতিতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, মহাকাশযানের গতি হয় দ্রুততর। এই ভাবে রোসেটা পৃথিবীর পাশ দিয়ে চলে যায় ২০০৫, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে, মঙ্গলের পাশ দিয়ে যায় ২০০৭-এ। মোট ৬০০ কোটি কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এই যানটি গত ১২ নভেম্বর সেকেন্ডে ১৮ কিলোমিটার বেগে চলমান একটি ধূমকেতুতে একটি ল্যান্ডার নিক্ষেপ করেছে। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এটি কোনও ধূমকেতুতে প্রথম সফ্ট ল্যান্ডিং। এর পর রোসেটাই হবে প্রথম মহাকাশযান, যা খুব কাছে থেকে ধূমকেতুটির দশ লক্ষ কিলোমিটার মহাকাশে ব্যাপ্তি প্রত্যক্ষ করবে।

এগুলি ছিল এ বছরের বড় ঘটনা। দুটি ‘সাইড স্টোরি’ দিয়ে শেষ করি। প্রথম কাহিনি ‘স্পেস ট্যাক্সি’র। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন-এ নভশ্চরদের যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট নাসা-র শাট্লগুলি অবসর নেওয়ার পর দুটি কোম্পানিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মহাকাশের ট্যাক্সি তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে। এই ট্যাক্সিগুলি পৃথিবী থেকে ‘লো আর্থ অরবিট’-এ যাওয়া-আসা করবে। দ্বিতীয় ঘটনাটি স্পেস পোর্ট বা মহাকাশ বন্দর নিয়ে। চিনের দক্ষিণাঞ্চলে ওয়েনছাং শহরে দেশের বৃহত্তম মহাকাশ বন্দরের নির্মাণ শেষ, এটি মহাকাশযান উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত। ভবিষ্যতে চাঁদে, মঙ্গলগ্রহে অথবা একাধিক স্পেস স্টেশনে যাওয়ার জন্য চিন এখন চারটি মহাকাশ বন্দরের অধিকারী।

মহাকাশ এখনও, অন্তত এখনও, হানাহানিমুক্ত। ইউক্রেনে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর সমালোচনা আছে, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে রাশিয়ার সভ্য-পদে থাকা নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কোনও মতবিরোধ নেই। ইউরোপের অন্তর্দ্বন্দ্বে গায়া বা রোসেটার কিছু যায় আসে না। পৃথিবীর সীমানা পার হলেই কি আমরা উদার হয়ে যাই? মহাকাশই কি পৃথিবীর শেষ ভরসা?

নাসা-র সায়েন্স অপারেশনস ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর চেয়ারপার্সন, মঙ্গল অভিযানে রোভার মিশনের সঙ্গে যুক্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement