বিশ্বভারতী কি নিজেকে বিশ্বভারতী হিসাবে দেখিতে চাহে, না কি কূপভারতী হিসাবে? এই গভীর আত্মদার্শনিক প্রশ্নটির বল আপাতত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কোর্টে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লইতে চলিয়াছেন, কোন অভিমুখে তাঁহার বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি চালিত করিতে চান। তাঁহার সিদ্ধান্তটি সহজ বলিয়া মনে হইলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথটি মোটেই সহজ নয়। তবে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের পথ কবেই বা সহজ হইয়াছে? বিশ্বভারতীর মান টানিয়া নামাইবার আয়োজন অত্যন্ত পরিপাটি, পরিপূর্ণ। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের সমস্ত ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, কর্তাব্যক্তি, সকলে কোমর বাঁধিয়া প্রস্তুত, তাঁহাদের দাবি মানিতে হইবে। পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ আসন বিশ্বভারতীতে রাখিতেই হইবে। অর্থাত্ শিশুবেলায় যাঁহারা ছাত্রছাত্রী হইবেন, ‘বড়বেলা’য় তাঁহাদের বিশ্বভারতীর উচ্চশিক্ষা আটকানো যাইবে না। গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠায়, তাঁহাদের দীর্ঘ হইহল্লা, আন্দোলন, ঘেরাও-এর চোটে ব্যতিব্যস্ত উপাচার্য তাঁহার স্বভাব-দৃঢ়তা সরাইয়া রাখিয়া কথা দিলেন: তিনি ভাবিয়া দেখিবেন।
সিদ্ধান্ত এখনও বাকি, সুতরাং প্রতিবাদের এই মহা আয়োজনের মধ্যেও উপাচার্য তাঁহার মনোমত অভিমুখটি রাখিতে পারেন কি না, ইহাই আপাতত প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে একটিই কথা বলার। উপাচার্য যখন পাঠভবন-শিক্ষাসত্রের জন্য বিশ্বভারতীর সংরক্ষণ উঠাইয়া দিবার কথা ভাবিয়াছিলেন, নিশ্চয়ই কোনও নীতিদর্শনের ভিত্তিতেই ভাবিয়াছিলেন। অতঃপর যদি তিনি পশ্চাদপসরণ করেন, তাহার অর্থ দাঁড়াইবে, সেই নীতি ও দর্শন বিসর্জন দেওয়া। হল্লাকারী জনগণের মোকাবিলা না করিতে পারিয়া এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সমঝোতা করিয়া ফেলা কি বিজ্ঞজনোচিত? শেষ অবধি কি তাহা হইলে হল্লার নিকট নীতির পরাজয় হইবে, রাস্তার রাজনীতির ভয়ে উত্কর্ষের অভিমুখ বিনষ্ট হইবে? বিবিধ প্রবল প্রতিপক্ষের সহিত লড়াই করিয়া উপাচার্য ক্লান্ত, ধ্বস্ত হইতে পারেন, কিন্তু তিনি জানেন, কত সুদূরপ্রসারী হইতে পারিত এই প্রস্তাবিত নীতি? কেবল পদ্ধতির দিক হইতে ভাবিলে, কোনও সারস্বত প্রতিষ্ঠান উত্কর্ষমুখী হইতে চাহিলে মাছিমারা গণতন্ত্র দিয়া তাহার কোনও উপকার হইবে কি?
আর পদ্ধতির প্রশ্ন পার করিয়া সারবত্তার দিক হইতে ভাবিলে, সত্যই এই সংস্কার ঘটিলে বিশ্বভারতী হয়তো আর এক বার তাহার নামের যোগ্য হইয়া উঠিবার সুযোগ পাইত। রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতীর কল্পনা করিয়াছিলেন, তাহাকে একটি বিপুল সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসাবেই ভাবিয়াছিলেন, যেখানে সর্ব বিষয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমাবেশ হইতে পারে, জ্ঞানের সত্য আদানপ্রদান এবং মুক্ত আলোচনায় বিশ্বের প্রতিকৃতি নির্মিত হইতে পারে। পাঠভবন বিদ্যালয়ই এক দিন বিস্তৃত হইয়া বিশ্বভারতীতে পরিণত হইয়াছিল, ইহা যেমন ঠিক, তেমনই নূতন বৃহত্তর উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চিরকালই তাহার উত্স-প্রতিষ্ঠানের লেজুড় হিসাবে চলিতে থাকিবে, তাহা নিশ্চয় তিনি ভাবেন নাই। একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ ও নিবদ্ধ থাকাই নিশ্চয়ই বিশ্বভারতীর ভবিতব্য হইতে পারে না। বরং রবীন্দ্রনাথের মৌলিক অভিপ্রায়টিতে যে উদার আহ্বান ছিল, কালের যাত্রায় তাহার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয় নাই, তাহা মধ্যমেধার পীঠস্থানে পরিণত হইয়াছে। বর্তমান উপাচার্য এই দুরবস্থা দূর করিবার কথা ভাবিতেছিলেন। মধ্যমেধার গণতন্ত্র সংকীর্ণতাতেই তুষ্ট ও পুষ্ট হয়, সুতরাং উদার উত্কর্ষের পথে যাত্রা করিতে চাহিলে তাঁহাকে ‘গণ’-র তন্ত্রের কোপ হইতে সবলে বাহির হইতে হইবে।